মুন্ডা বিদ্রোহ

 ঔপনিবেশিক আমলে সংঘঠিত আদিবাসী বিদ্রোহ গুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি আদিবাসী বিদ্রোহ ছিলো - "মুন্ডা বিদ্রোহ" বা "মুন্ডা উলগুলান"

মুন্ডা বিদ্রোহ
মুন্ডা বিদ্রোহ 

মুন্ডাদের পরিচয় ও আদি বাসভূমি

মুন্ডারা ভারতের একটি প্রাচীন উপজাতি গোষ্ঠী ছিলো। এরা কোলদেরই একটি শাখা ছিলো ছিলো বলে,কোথাও কোথাও মুন্ডারা "কোল" নামেও পরিচিত ছিলেন। 

আমরা যখন এর আগে কোল বিদ্রোহ আলোচনা করেছিলাম, তখনই বলেছিলাম ছোটনাগপুর অঞ্চলে কোলরা হো, মুন্ডা, ওরাও প্রভৃতি নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিলো। অর্থাৎ সহজ করে বলতে গেলে কোলদেরই একটি আদিবাসী শাখা সম্প্রদায় ছিলো "মুন্ডা"। মুন্ডা কথার আক্ষরিক অর্থ ছিলো - গ্রাম প্রধান। 

মুন্ডাদের আদি বাসভূমি ছিলো ছোটনাগপুর ও তার সন্নিহিত হাজারিবাগ, রাঁচি প্রভৃতি অঞ্চলে। 

মুন্ডাদের জীবন ধারন পদ্ধতি 

কোলদের মতোই মুন্ডাদের সমাজ ব্যবস্থার চরিত্র ছিলো প্রায় একই রকম। মুন্ডা সমাজে কোলদের মতোই ব্যক্তি মালিকানার কোন ধারনা ছিলো না। তারা সম্প্রদায়গত ভাবে একসঙ্গে "খুৎকাঠি প্রথায়"( জমির যৌথ মালিকানা) কৃষিকাজ করতো। কৃষিকাজের পাশাপাশি তারা শিকার করতো। এছাড়া, বনজ সম্পদ সংগ্রহ ও বিক্রি করে জীবন ধারন করতো। 

১৮২০ খ্রিঃ ছোটনাগপুর এলাকায় কোম্পানির নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই অঞ্চলের সকল আদিবাসী গোষ্ঠীই ঔপনিবেশিক শোষনের শিকার হয়েছিলেন। মুন্ডারাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। বিভিন্ন সময় মুন্ডা জনজাতি কোলদের সঙ্গে বিদ্রোহে সামিল হলেও, ১৮৯৯ খ্রিঃ মুন্ডারা স্বতন্ত্র ভাবে এক বিরাট বিদ্রোহের ডাক দেয়, যা "উলগুলান" বা প্রবল বিক্ষোভ/ ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা নামে পরিচিত ছিলো। 

যার নেতৃত্বে মুন্ডারা উলগুলান এ সামিল হয়েছিলেন, তিনি হলেন বীরসা মুন্ডা। মুন্ডা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়ে বীরসা মুন্ডা অমর হয়ে যান এবং আদিবাসী সমাজের কিংবদন্তি চরিত্রে রূপলাভ করেন। 

মুন্ডা বিদ্রোহের কারন 

উনিশ শতকের একেবারে শেষলগ্নে এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনায় মুন্ডাদের বিদ্রোহী হয়ে উঠবার পিছনে একাধিক কারন দায়ী ছিলো। এই কারন গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি - 

(১.) ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা জনিত ক্ষোভ 

ছোটনাগপুর এলাকায় মুন্ডারা বন জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিজমি তৈরি করেছিলো। কিন্তু ১৮২০ দশকের পর থেকেই ছোটনাগপুর এলাকায় কোম্পানি তাদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে এবং সমস্ত এলাকাটি কে নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে।

 এই নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় মুন্ডাদের জমির মালিকানার বিষয়টিকে অস্বীকার করে যেভাবে ইজারার ভিত্তিতে জমিদার ও ইজারাদারদের এই এলাকার জমি গুলি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়, তার ফলে মুন্ডাদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়। 

(২.) খুৎকাঠি প্রথাকে বাতিল করে দেওয়া 

মুন্ডারা খুৎকাঠি প্রথায় অর্থাৎ জমির যৌথ মালিকানা ব্যবস্থায় কৃষিকাজ করতো। তাদের সমাজে সম্পদের ব্যক্তি মালিকানার কোন ধারনা ছিলো না। কিন্তু ছোটনাগপুর এলাকায় নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য কোম্পানি মুন্ডাদের খুৎকাঠি প্রথাকে বাতিল করে দিয়ে জমিতে ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করে। 

এর ফলে মুন্ডাদের ঐক্যবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থায় ভাঙ্গন দেখা যায়। পারিবারিক অশান্তি দেখা যায়। এছাড়া, ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করাতে সহজেই মুন্ডাদের জমি থেকে উৎখাত করা যায়। এজন্য দীর্ঘদিন ধরেই মুন্ডা সমাজে ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে। 

(৩.) জমিদার ও মহাজনদের শোষন 

নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পর এই এলাকায় বহিরাগত জমিদাররা প্রবেশ করে মুন্ডাদের শোষন চালাতে থাকে। তারা মুন্ডাদের ওপর উচ্চহারে ভূমিরাজস্ব ধার্য করে। যারা এই ভূমিরাজস্ব দিতে পারতো না, তাদের জমি গুলি জমিদাররা কেড়ে নিতে থাকে। 

তাছাড়া, কোম্পানির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় নগদে খাজনা আদায়ের প্রথা প্রচলিত হওয়ায় মুন্ডারা মহাজনদের শোষনের সম্মুখীন হয়। অনেক সময় টাকা ধার করার জন্য তারা অথবা নগদ অর্থের জন্য মহাজনদের দ্বারস্থ হতো, এবং তাদের দ্বারা প্রতারিত হতো। মহাজনরা মুন্ডাদের চড়া সুদে টাকা ধার দিয়ে তাদের জমিগুলি আত্মসাৎ করে নিতে শুরু করে। 

(৪.) বেটবেগারি প্রথার বিরুদ্ধে ক্ষোভ 

জমিদার ও মহাজনরা মুন্ডাদের শোষন করার জন্য তাদের ওপর নানা ধরনের অবৈধ কর বসাতো। বেটবেগারি প্রথা ছিলো এমনই এক ব্যবস্থা, যেখানে বিনা মজুরিতে জমিদার, মহাজনদের বিভিন্ন ধরনের কাজ মুন্ডাদের করে দিতে হতো। এর ফলে মুন্ডা সমাজের একাংশের মধ্যে প্রচন্ড অসন্তোষের জন্ম হয়। 

(৫.) কুলির কাজে নিয়োগ 

মুন্ডারা অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন বলে, ছোটনাগপুর এলাকায় বিভিন্ন ঠিকাদার গোষ্ঠী প্রবেশ করে, এবং মুন্ডাদের নামমাত্র মজুরিতে আসামের চা বাগিচায় কুলির কাজে নিয়োগ করে। সেখানে প্রচন্ড অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়ে মুন্ডাদের দিয়ে কাজ করানো হতো। 

(৬.) ব্রিটিশ আইন ও প্রশাসন চাপিয়ে দেওয়া 

ছোটনাগপুর এলাকায় কোম্পানি মুন্ডাদের প্রাচীন প্রথা, আইন ও বিচার পদ্ধতিকে বাতিল করে দিয়ে ব্রিটিশ আইন, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়। এর ফলে মুন্ডাদের মধ্যে ভয়ঙ্কর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কেননা এখানে তারা কোন ন্যায় বিচার তো পেত না, উল্টে  তারা স্বৈরাচারী ঔপনিবেশিক শোষনের শিকার হয়ে পড়ে। 

(৭.) বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা 

মুন্ডাদের ক্ষোভের আরেকটি কারন ছিলো, তাদের বলপূর্বক খ্রিষ্টান ধর্মে ধরান্তরিত করা। লুথারান ও অ্যাঙ্গলিকান মিশনারিরা মুন্ডাদের ছলে বলে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করে মুন্ডাদের নিজস্ব ধর্ম ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার করতে থাকে। ফলে মুন্ডা সমাজে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

(৮.) অরন্য আইন প্রয়োগ

ভারতীয় অরন্যের ওপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৫ খ্রিঃ ঔপনিবেশিক অরন্য আইন পাশ করেছিলো। ১৮৯৪ খ্রিঃ এই অরন্য আইনকে ছোটনাগপুরে লাগু করা হয়। অরন্য আইন অনুযায়ী, জঙ্গল এলাকার সমস্ত জমিই সরকারি সম্পত্তি হিসাবে ঘোষিত হয়। অরন্য আইন প্রয়োগ করার পর মুন্ডারা অরন্যের চিরাচরিত অধিকার গুলি থেকে যেমন বঞ্চিত হতে থাকলেন, তেমনি তাদের অরন্য অঞ্চলের কৃষি জমির ওপর সরকার খাজনা আদায় শুরু করলে, মুন্ডাদের ক্ষোভ চরমে ওঠে। 

বীরসার নেতৃত্বে মুন্ডাদের বিদ্রোহ ঘোষনা

দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ যেকোন বিদ্রোহেই সংঘবদ্ধ চেতনার জন্ম দেয়। এই সংঘবদ্ধ চেতনাকে উপযুক্ত "ভাষা" দিয়ে একে বিদ্রোহের "রূপদান" করেন কোন একজন নেতা। মুন্ডাদের বিদ্রোহের ক্ষেত্রে তেমনটাই হয়েছিলো।

বীরসার আবির্ভাব 

 দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শোষনে নুহ্যমান মুন্ডাদের জাগ্রত করতে আর্বিভূত হন বীরসা মুন্ডা। একজন সাধারণ মুন্ডা ভাগচাষী সুগান মুন্ডার পুত্র ছিলেন বীরসা মুন্ডা। তার মায়ের নাম ছিলো করমি বাহাতুরাচীর উলিহাতু গ্রামে বীরসার জন্ম হয়েছিলো। কিছুদিন খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলে তিনি পড়াশোনাও করেছিলেন। 

নতুন ধর্ম প্রবর্তন 

ঔপনিবেশিক শাসনে ভেঙ্গে পড়া ও নুহ্যমান মুন্ডা জনসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ১৮৯৫ খ্রিঃ মাত্র ২১ বছর বয়সে বীরসা মুন্ডা এক নতুন ধর্মের প্রবর্তন করেন, যার নাম ছিলো "একেশ্বরবাদী মুন্ডা"। বহু দেবতার পুজা বাতিল করে দিয়ে তিনি "সিংবোঙা" বা সূর্য দেবতাকেই একমাত্র উপাস্য দেবতা বলে ঘোষনা করেন এবং নিজেকে "ধর্তিআবা" বা ধরনীর পিতা বলে প্রচার করেন। 

বীরসার নতুন ধর্মে একের পর এক দলে দলে মুন্ডারা দীক্ষিত ও ঐক্যবদ্ধ হতে থাকলেন। আর এতেই ভয় পেয়ে গেলো ব্রিটিশ সরকার। কেননা ঐক্যবদ্ধ প্রজা শক্তি যেকোন স্বৈরাচারী শাসকের কাছেই ভয়ের কারন। যেভাবে বীরসার নেতৃত্বে মুন্ডারা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিলো, সেটিকে সরকারের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলো না। কারন এর ফলে যে কোন সময়ে প্রতিরোধ নেমে আসতে পারে। 

অরন্য আইনের বিরোধীতা ও গ্রেপ্তার 

শেষপর্যন্ত, সরকারের আশঙ্কা সত্যি প্রমানিত হয়েছিলো। ১৮৯৪ খ্রিঃ ছোটনাগপুর এলাকায় ইংরেজ সরকার ঔপনিবেশিক অরন্য আইন লাগু করে মুন্ডাদের অরন্যের অধিকার কেড়ে নিতে শুরু করলে, বীরসা মুন্ডা এর প্রতিবাদ জানান। 

এর ফলে সরকার বীরসা মুন্ডাকে গ্রেপ্তার করে এবং বিচারে তার দুবছর জেল হয়। এর ফলে ঔপনিবেশিক শোষনের প্রকৃত চরিত্র সম্পর্কে বীরসা মুন্ডা অবহিত হন এবং পরবর্তীকালে মুক্তি লাভের পর বীরসা তার আন্দোলনকে আরোও তীব্র করে তোলেন। 

বিদ্রোহের পরিকল্পনা 

১৮৯৭ খ্রিঃ ৩০ নভেম্বর, জেল থেকে মুক্তি লাভের পর বীরসা নতুন করে বিদ্রোহ সংগঠিত করেন। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে তার ধর্ম প্রচার করেন এবং মুন্ডাদের ঐক্যবদ্ধ করেন। বিদ্রোহ সংগঠিত করতে তিনি বেশ কিছু পরিকল্পনা ও ঘোষনা করেন। 

  1. তিনি ছোটনাগপুর থেকে বিদেশী দিকুদের বিতাড়িত করে স্বাধীন মুন্ডা রাজ্য প্রতিষ্ঠার ডাক দেন। 
  2. ৬০০০ মুন্ডাকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সেনাবাহিনী গঠন করেন। 
  3. বিশ্বস্ত অনুচর গয়া মুন্ডাকে তিনি এই সেনাদলের সেনাপতি নিযুক্ত করেন। 
  4. খুঁটি ছিলো তাঁর যাবতীয় কর্মকান্ডের প্রধান কেন্দ্র। 
  5. এছাড়া, রাঁচি, চক্রধরপুর, বুন্দু, তোমার, কারা, বাসিয়া প্রভৃতি স্থানে তিনি গোপন ঘাঁটি তৈরি করেন। 
  6. ১৯৯৯ খ্রিঃ ২৪ ডিসেম্বর, বড়োদিনের আগের রাতে বীরসা বিদ্রোহ শুরু করেন। ২৫ ডিসেম্বর, খ্রিষ্টানদের কাছে উৎসব, আনন্দ ও ছুটির দিন হওয়ায় বিদ্রোহ সংঘঠিত করবার জন্য বীরসা এই বিশেষ দিনটিকেই বেছে নেন। 

বিদ্রোহের বিস্তার ও ব্যপকতা 

১৮৯৯ খ্রিঃ থেকে ১৯০০ খ্রিঃ পর্যন্ত রাঁচির দক্ষিণাঞ্চলে বীরসা মুন্ডার নেতৃত্বে বিদ্রোহ মুন্ডা বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারন করে। বিদ্রোহীরা রাঁচি ও সিংভূম জেলার গির্জা, থানা, সরকারি অফিস, জমিদার ও মহাজনদের বাড়ি ঘর সব ধ্বংস করে দেয়। কিছুদিনের জন্য ছোটনাগপুর এলাকা মুন্ডাদের মুক্তাঞ্চলে পরিনত হয়। 

মুন্ডারা ছোটনাগপুরের পুরাতন রাজধানী দইসাতে নতুন মুন্ডা রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষনা করেন। 

বিদ্রোহ দমন 

শেষপর্যন্ত, ১৯০০ খ্রিঃ ৯ ই জানুয়ারি, "সইল রাকার পাহাড়ের যুদ্ধে" মুন্ডা বাহিনী সম্পূর্ণ ভাবে পরাজিত হয়। বহু মুন্ডা যুদ্ধে মারা যান। বীরসা গ্রেপ্তার হন এবং বিচারে তার জেল হয়। মাত্র ২৫ বছর বয়সে রাঁচির জেলে কলেরা রোগে এই মহান আদিবাসী নেতা শহীদ হয়ে যান। তার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে মুন্ডা বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়ে।

গুরুত্ব ও ফলাফল

মুন্ডা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও, এই বিদ্রোহ সম্পূর্ণ নিষ্ফল ছিলো না।

  1. এই বিদ্রোহের পর সরকার মুন্ডাদের অভাব অভিযোগের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছিলো। 
  2. এর ফল স্বরূপ ১৯০৮ খ্রিঃ ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ত্ব আইন বা "টেন্যান্সি অ্যাক্ট - ১৯০৮" পাশ করে মুন্ডাদের খুৎকাঠি প্রথাকে স্বীকার করে নেয়।
  3. নতুন আইন অনুসারে বেত বেগারি প্রথা (বেগার খাটা) ও মুন্ডাদের জমি থেকে উচ্ছেদ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। 
  4. স্বাধীন মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠিত না হলেও, এই বিদ্রোহ মুন্ডাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বোধের জাগরন ঘটায়।
  5. এই বিদ্রোহ পরবর্তীকালে অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়কে অধিকার আদায় ও বিদ্রোহ সংগঠনে অনুপ্রাণিত করেছিলো।
  6. মুন্ডাদের আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে ওরাওঁ সম্প্রদায়ের ভাঁইয়ারা জমির মালিকানা পেতে ১৯১৪ খ্রিঃ "তানা ভগত আন্দোলন" শুরু করে। 
  7. এই বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে মুন্ডাদের মধ্যে বীরসা সম্প্রদায় নামে একটি উপজাতি শাখা আত্মপ্রকাশ করে এবং এর নেতৃত্বে মুন্ডা সমাজে সংস্কার আন্দোলন চলতে থাকে। 

মুন্ডা বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য

মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি - 
  1. মুন্ডা বিদ্রোহ ছিলো একটি স্থানীয় বা আঞ্চলিক আদিবাসী বিদ্রোহ।
  2. বহিরাগত দিকুদের বিরোধীতা অর্থাৎ জমিদার, মহাজন, ঠিকাদার ও ইংরেজ বিরোধী ছিলো এই বিদ্রোহের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। 
  3. এই বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিলো মুন্ডাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও অধিকার রক্ষা করা অর্থাৎ স্বাধীন মুন্ডা রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করা। 
  4. এই বিদ্রোহে বীরসা মুন্ডার ধর্মীয় চিন্তা তাঁর অনুগামীদের প্রভাবিত করে, যেখান থেকে মুন্ডাদের মধ্যে শুরু হয় ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন। 
  5. সশস্ত্র প্রতিরোধ এই বিদ্রোহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো।
  6. সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা ছিলো এই বিদ্রোহের অপর উল্লেখযোগ্য দিক। 

সাহিত্যে প্রভাব 

মুন্ডা বিদ্রোহ পরবর্তীকালে সাহিত্য জগতকেও প্রভাবিত করেছিলো। প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী বীরসা মুন্ডার জীবনী ও ইতিহাস নিয়ে রচনা করেন "অরন্যের অধিকার" নামক উপন্যাস। 

কিছু শব্দগত অর্থ ও তথ্য 

  • মুন্ডা - গ্রাম প্রধান। 
  • উলগুলান/উলঘুনান - ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলা। 
  • বেতবেগারি - বিনা মজুরিতে কাজ করা বা বেগার খাটা।
  • ধরতি আবা - ধরনী বা পৃথিবীর পিতা। বীরসা মুন্ডা নিজেকে ধরতি আবা বলে ঘোষনা করেছিলেন। 
  • সিং বোঙা - সূর্য দেবতা। বীরসা মুন্ডার উপাস্য দেবতা ছিলেন সিং বোঙা। 
  • খুৎকাঠি প্রথা - যৌথ মালিকানা ব্যবস্থা বা যৌথ মালিকানা ভিত্তিক জমি ব্যবস্থা। 
  • মুন্ডা বিদ্রোহের শ্লোগান - হয় সরকারকে খাজনা, নয় তো নয়। 
  • মুন্ডা বিদ্রোহের দুজন নেতা - বীরসা মুন্ডা ও গয়া মুন্ডা। 
  • বীরসা ভগবান বলে খ্যাত ছিলেন - বীরসা মুন্ডা। 
  • বীরসা মুন্ডার পিতার নাম - সুগান মুন্ডা। 
  • ছোটনাগপুর প্রজাসত্ত্ব আইন পাশ হয় - ১৯০৮ খ্রিঃ।
  • তানা ভগত আন্দোলন শুরু হয় - ১৯১৪ খ্রিঃ। ছোটনাগপুরের ওরাওঁ সম্প্রদায়ের লোকেরা জমির মালিকানা পেতে এই আন্দোলন শুরু করেছিলো। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post