বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের ধারনা

 ইতিহাস পর্যালোচনায় ৩ টি গুরুত্বপূর্ণ ধারনা হলো যথাক্রমে - বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের ধারনা।

বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের ধারনা
বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের ধারনা 

(১.) বিদ্রোহের ধারনা 

সংজ্ঞা :-

কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের কিছু মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশকেই সাধারনত "বিদ্রোহ" বলা হয়।

উদ্দেশ্য :-  

সাধারণত প্রচলিত ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য অর্থাৎ কোন বিশেষ বিষয়ে ক্ষোভ বা অসন্তোষের কারন গুলিকে দূর করবার জন্যই বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। 

উদাহরন :- 

বিদ্রোহের উদাহরনের মধ্যে অন্যতম হলো - 

  • সাঁওতাল বিদ্রোহ, 
  • কোল বিদ্রোহ, 
  • মুন্ডা বিদ্রোহ, 
  • নীল বিদ্রোহ, 
  • ১৮৫৭ খ্রিঃ সিপাহী বিদ্রোহ, 
  • আবার উনিশ শতকের প্রথমার্ধে হিন্দু ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইয়ংবেঙ্গলদের প্রতিবাদকেও অনেকে বিদ্রোহ বলে অভিহিত করে থাকেন। 

বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য :-

বিদ্রোহের বেশ কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা - 
  1. বিদ্রোহের মধ্যে একটি প্রতিবাদী কন্ঠস্বর থাকে। সাধারনত প্রচলিত সমাজের শোষন, বঞ্চনা ও নানা ক্ষোভ এবং অসন্তোষের প্রতিবাদ জানাতে বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। 
  2. বিদ্রোহের পিছনে সামরিক দিকের উপস্থিতি থাকতেও পারে আবার নাও পারে। অর্থাৎ বিদ্রোহ শান্তিপূর্ণ ভাবেও হতে পারে আবার সহিংস ভাবেও সংগঠিত হতে পারে। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, নীল বিদ্রোহ প্রথম পর্বে ছিলো শান্তিপূর্ণ, কিন্তু পরের দিকে তা সহিংস হয়ে উঠেছিলো। একই ভাবে সাঁওতাল বিদ্রোহ সহিংস ভাবে সংগঠিত হলেও, ইয়ংবেঙ্গলদের বিদ্রোহের চরিত্র ছিলো সর্বদাই অসামরিক ও শান্তিপূর্ণ। 
  3. বিদ্রোহ ব্যক্তিগত ভাবেও সংঘঠিত হতে পারে আবার অনেকে সমবেতভাবে বা সমষ্টিগত ভাবেও শুরু করতে পারেন। 
  4. বিদ্রোহের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো বিদ্রোহ সাধারণত ক্ষনস্থায়ী হয়ে থাকে। এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে না। প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা ক্রোধের প্রশমনের সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়ে। 
  5. এর উদ্দেশ্যও সীমিত থাকে। প্রচলিত ব্যবস্থার অসন্তোষের কারন গুলি দূর করার মধ্যেই বিদ্রোহের উদ্দেশ্য সীমাবদ্ধ থাকে। 
  6. বিদ্রোহ যেকোন সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের স্বৈরাচারী নীতি, অত্যাচার ও শোষনের বিরুদ্ধে সংঘঠিত হয়। অর্থাৎ প্রচলিত যেকোন অন্যায় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংঘঠিত হয়। 
  7. বিদ্রোহের আরেকটি দিক হলো, এর পিছনে পূর্ব পরিকল্পনা থাকতেও পারে আবার নাও পারে। 
  8. বিদ্রোহ সফল হলে পূর্বতন ব্যবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। অর্থাৎ যে ক্ষোভ বা অসন্তোষের কারনের জন্য বিদ্রোহ শুরু হয়, সেই কারন গুলি কিছুটা দূরীভূত হয়। 

মনে রাখতে হবে, দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ বা অসন্তোষই হলো বিদ্রোহের মূল কারন।

(২.) অভ্যুত্থানের ধারনা

সংজ্ঞা :-

কোন শাসক বা সরকারের বিরুদ্ধে সাময়িক ক্ষোভ বিক্ষোভ ব্যবহার করে ব্যক্তি বা সমষ্টিগত ভাবে সশস্ত্র সংগ্রামকে সাধারনত "অভ্যুত্থান" বলা হয়।

উদ্দেশ্য :-

যে কোন অভ্যুত্থানের পিছনে মূল উদ্দেশ্য থাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা।

উদাহরন :-

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানিতে হিটলার ও নাৎসিদলের উত্থান, ইতালিতে মুসলিনী বা ফ্যাসিবাদের উত্থান, স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানে বিভিন্ন সেনাপ্রধানের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল ইত্যাদি হলো অভ্যুত্থানের উদাহরন।

অভ্যুত্থানের বৈশিষ্ট্য :-

অভ্যুত্থানের মধ্যেও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন -

  1. যে কোন অভ্যুত্থানের পিছনেই থাকে সামরিক দিকের উপস্থিতি। অর্থাৎ সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্য নিয়ে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। 
  2. অভ্যুত্থান মূলত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। আমরা আগেই বলেছি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যেই অভ্যুত্থান হয়ে থাকে। 
  3. অভ্যুত্থান হঠাৎ করেই সংঘঠিত হয়। 
  4. অভ্যুত্থানের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর পিছনে জনগনের পরোক্ষ সমর্থন থাকতেও পারে আবার নাও পারে। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, ২০২১ সালে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তালিবান গোষ্ঠী আফগানিস্তানের যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে, তার পিছনে কোন জনসমর্থন ছিলো না। 
  5. অভ্যুত্থান সফল হলে সাধারনত রাষ্ট্রে স্বৈরাচারী শাসকের উদ্ভব ঘটে থাকে। 
মাথায় রাখতে হবে, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যেই অভ্যুত্থান সংঘঠিত হয় এবং এটি সব সময়েই সশস্ত্র চরিত্রের হয়ে থাকে। 

(৩.) বিপ্লবের ধারনা

সংজ্ঞা :-

বিপ্লব বলতে সাধারণত প্রচলিত ব্যবস্থার দ্রুত, ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তনকে বোঝায়। 

উদ্দেশ্য :-

প্রচলিত ব্যবস্থা বা সিস্টেমের কাঠামোগত আমূল ও সার্বিক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যেই বিপ্লব সংঘঠিত হয়।

উদাহরন :-

১৭৮৯ খ্রিঃ ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লব, ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব, রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব ইত্যাদি কয়েকটি বিপ্লবের উদাহরন।

 আবার স্বাধীনতা লাভের পর ভারতে খাদ্যসংকট দূর করতে উচ্চফলনশীল বীজ ও সারের প্রয়োগে কৃষিক্ষেত্রে অল্প সময়ে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটে, তাকেও অনেকে বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করে "সবুজ বিপ্লব" বলে অভিহিত করে থাকেন। এটিও একটি বিপ্লবের উদাহরন। 


বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য :-

  1. বিপ্লব হঠাৎ করে বা আকস্মিক ভাবে হয় না। এর পিছনে দীর্ঘ প্রস্তুতি থাকে
  2. বিপ্লবের ফলে আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে একটি আমূল পরিবর্তন ঘটে। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, ফরাসি বিপ্লব, বলশেভিক বিপ্লব বা ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের পর সেখানকার আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে। 
  3. বিপ্লবের আরেকটি দিক হলো বিপ্লবের ফলে আর্থ সামাজিক বা রাজনৈতিক কাঠামো বা স্ট্রাকচারের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আসে। যেমন ফরাসি বিপ্লবের পরে ফ্রান্সে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ হয়ে পার্লামেন্টীয় গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। 
  4. বিপ্লবের পিছনে একটি নীতিগত বা আদর্শগত দিকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। 
  5. বিপ্লবে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করে অথবা একে সমর্থন করে থাকে। 
মনে রাখতে হবে, প্রচলিত আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কারের উদ্দেশ্যে বিপ্লব হয় না। এর মূল লক্ষ্য থাকে আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন কাঠামো বা  অথবা সম্পূর্ণ নতুন ব্যবস্থা বা স্ট্রাকচারের পত্তন করা। 

বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের তুলনামূলক পার্থক্য :-

বিদ্রোহ অভ্যুত্থান বিপ্লব
প্রচলিত ব্যবস্থা বা অসন্তোষের কারন গুলি দূর করার জন্য হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার উদ্দেশ্যে হয়। এর উদ্দেশ্য হল পুরাতন ব্যবস্থা বা সিস্টেমের পরিবর্তন করা।
এখানে সামরিক দিকের উপস্থিতি থাকতেও পারে আবার নাও পারে। সামরিক দিকের উপস্থিতি থাকেই সামরিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো আদর্শগত দিক।
বিদ্রোহের পিছনে পরিকল্পনা থাকতেও পারে আবার নাও পারে। অভ্যুত্থান হঠাৎ করেই সংগঠিত হয়। বিপ্লব হঠাৎ করে হয় না। এর পিছনে দীর্ঘ প্রস্তুতি থাকে।
বিদ্রোহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় ও আংশিক ক্ষেত্রে সফল হয়। অভ্যুত্থান ব্যর্থও হতে পারে আবার সফলও হতে পারে। বিপ্লবের ফলে আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোগত ক্ষেত্রে একটি মৌলিক পরিবর্তন ঘটে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post