ঔপনিবেশিক অরন্য আইন

 ভারতবর্ষে ইংরেজরা যেসব আইন প্রণয়ন করে তাদের ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলো, সেইসব আইন গুলির মধ্যে অন্যতম ছিলো "ঔপনিবেশিক অরন্য আইন" (১৮৬৫) বা Indian Forest Act 1865

 এই আইনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় বনাঞ্চলের ওপর তাদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে। 

ঔপনিবেশিক অরন্য আইন
ঔপনিবেশিক অরন্য আইন 

কারন বা উদ্দেশ্য 

বেশ কিছু কারন বা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ব্রিটিশ সরকার এদেশে ঔপনিবেশিক অরন্য আইন প্রণয়ন করেছিলো। এগুলি হল - 

  1. রেলের স্লিপার তৈরির জন্য কাঠ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে রাখা, 
  2. জাহাজ তৈরির জন্য কাঠ সংরক্ষণ করে রাখা, 
  3. প্রশাসনিক ভবন, অন্যান্য বাড়িঘর ও সদ্য বিকাশ লাভ করা নগর গুলির জন্য কাঠের জোগান সুনিশ্চিত করে রাখা, 
  4. বন সংরক্ষণ করে বানিজ্যিক ভিত্তিতে কাঠ উৎপাদন করা এবং ইংল্যান্ডে মূল্যবান কাঠ পাচার করা, 
  5. বনজ চাষযোগ্য জমিগুলিকে ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে এনে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা, 
  6. বনসংরক্ষন করা ও ঝুমচাষ বন্ধ করা, 
  7. ঔপনিবেশিক শাসনের কর্তৃত্বকে সুদৃঢ় করা।

 অরন্য আইন তৈরির প্রেক্ষাপট 

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিশেষত, ১৮৫৪ খ্রিঃ ভারতে রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই ব্রিটিশ সরকার এদেশের অরন্য সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। কেননা রেললাইন বসানোর জন্য তখন প্রচুর কাঠের স্লিপারের প্রয়োজন পড়তো। সেসময়ে রেললাইন পাততে প্রতি মাইলে ১,৮৮০ টি স্লিপার বসাতে হতো। 
এছাড়া, কোম্পানির নৌবাহিনীতে জাহাজ তৈরির জন্য ওক ও সেগুন কাঠের প্রয়োজন দেখা দেয়। এই সমস্ত কারনে লর্ড ডালহৌসি  ভারতীয় অরন্য সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাথমিক ভাবে একটি "অরন্য সনদ" জারি করেন। 

(১.) অরন্য সনদ ঘোষনা :-

 ১৮৫৫ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার অরন্য সনদ পাশ করে। এর মাধ্যমে - 
  • ভারতীয় অরন্যের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত করা হয়, 
  • সাধারন জনগন কর্তৃক অরন্যের কাঠ সংগ্রহ ও বিক্রির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, 
  • রেলের স্লিপার বসাতে শাল এবং জাহাজ তৈরিতে সেগুন কাঠের ব্যপক প্রয়োগ করা হতো। তাই তা সংরক্ষণ করে রাখার জন্য এই আইনে অরন্যের শাল, সেগুন ইত্যাদি মূল্যবান কাঠ সরকারের মূল্যবান সম্পত্তিতে পরিনত করা হয়। 

(২.) বনপরিদর্শক নিয়োগ :-

অরন্য সনদ ঘোষনার পরের বছরেই ১৮৫৬ খ্রিঃ জার্মান বন বিশারদ ডেইট্রিক ব্রান্ডিসকে সরকার মহাবন পরিদর্শক নিযুক্ত করে। তিনি ভারতের বিভিন্ন বনাঞ্চল গুলি পরিদর্শন করে বনভূমি গুলির শ্রেনী বিন্যাস করেন এবং বিজ্ঞান সম্মত বন ব্যবস্থার সূচনা করেন। 

(৩.) বনবিভাগ গঠন :- 

১৮৬৪ খ্রিঃ ব্রান্ডিসের প্রচেষ্টার ফলে ভারতীয় বনবিভাগ গঠিত হয়। ডেইট্রিক ব্রান্ডিসকে ভারতীয় বনবিভাগের প্রথম "ইন্সপেক্টর জেনারেল" নিযুক্ত করা হয়। এর পরের বছর বন সংরক্ষণের কেন্দ্রীয় অফিস ১৮৬৫ খ্রিঃ কলকাতায় স্থাপিত হয়। 

(৪.) অরন্য আইন প্রণয়ন :- 

১৮৬৫ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার "ভারতীয় অরন্য আইন" বা "Indian Forest Act 1865" পাশ করে। এই আইন অনুযায়ী - 
  • অরন্যকে সরকারি সংরক্ষনের আওতায় নিয়ে আসা হয়, এবং ঘোষনা করা হয় - 
  • অরন্যে ঘেরা যে কোন ভূমিই সরকারের সম্পত্তি। 
  • পরবর্তীকালে অরন্যের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রন আরোও সুস্পষ্ট করে তোলার জন্য এবং অরন্যের সীমা নির্ধারনের জন্য এই আইনের ভিতর দুটি সংশোধনী বা Amendment নিয়ে আসা হয়।
  • এর একটি নিয়ে আসা হয়েছিলো ১৮৭৮ খ্রিঃ, অন্যটি  নিয়ে আসা হয় ১৯২৭ খ্রিঃ। 

অরন্যের শ্রেনী বিভাগ 

১৮৭৮ খ্রিঃ অরন্য আইনের সংশোধনী ধারাতে ভারতীয় অরন্যকে ৩ টি ভাগে ভাগ করা হয়েছিলো। যথা - 

(১.) সংরক্ষিত অরন্য বা Reserved Forest - 

সংরক্ষিত অরন্যের পূর্ন কর্তৃত্ব ছিলো সরকারের হাতে। এইসব অরন্যে ছিলো বহু প্রাচীন মূল্যবান গাছ ও জীবজন্তু। এইসব অরন্যে সাধারন জনগনের প্রবেশ, গাছকাটা অথবা শিকার করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। 

(২.) সুরক্ষিত বা নিরাপদ অরন্য বা Protected Forest - 

সুরক্ষিত অরন্যে সরকারের পূর্ন কর্তৃত্ব আরোপিত না হলেও, তা সরকারের নজরদারির আওতায় ছিলো। তবে বনাঞ্চলে বসবাস করার প্রথাগত অধিকার বলে এই সব অরন্য থেকে আদিবাসীরা জঙ্গলের কাঠ, পাতা ইত্যাদি সংগ্রহ করতে পারতেন। কিন্তু সেগুলি বিক্রি করার কোন অধিকার তাদের দেওয়া হয় নি। 


(৩.) গ্রাম্য বনাঞ্চল বা Village Forest - 

গ্রামের ছোট খাটো অরন্য অধ্যুষিত এলাকা গুলি এই শ্রেণীর অরন্যের অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছিলো। এইসব অরন্যে আদিবাসীরা জঙ্গলের কাঠ, পাতা ও বনজ সম্পদ সংগ্রহ করতে পারতেন। 

ঔপনিবেশিক অরন্য আইনের প্রভাব

ভারতের সমস্ত আদিবাসী গোষ্ঠীই অরন্য বা বনাঞ্চলকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকতো। ঔপনিবেশিক অরন্য আইনের ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবে তারাই সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।এই আইনের একাধিক কুফল আদিবাসীদের ওপর পড়েছিলো। যেমন, এই আইনের ফলে - 
  1. আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকায় বিপর্যয় নেমে আসে, 
  2. আদিবাসী সহ অরন্যচারীদের বাসস্থানের সমস্যা দেখা দেয়। সংরক্ষিত অরন্য সহ অন্যান্য বনাঞ্চল এলাকায় আদিবাসীদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। 
  3. আদিবাসীরা অরন্যের নিষ্কর জমির অধিকার হারায়। অরন্য কৃষিজমির ওপর সরকার কর আরোপ করলে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, 
  4. অরন্য থেকে উদ্ভিজ সম্পদ ও মধু সহ নানা প্রানীজ সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে আদিবাসীরা নানা রূপ বাধার সম্মুখীন হয়, 
  5. আদিবাসীদের অরন্যে শিকার করার ক্ষেত্রে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ফলে আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে পড়ে। সরকারি নিষেধাজ্ঞার ফলে তারা "শিকার পরব" সহ নানা আদিবাসী অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে পালন করতে পারতো না। ফলে তাদের মধ্যে অরন্য আইনকে নিয়ে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়। 
  6. আদিবাসীদের জ্বালানির সমস্যা ও জীবিকার সমস্যা দেখা যায়। তারা অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়। কেননা অরন্য আইনে খোলা বাজারে অরন্যের সম্পদ বিক্রির ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিলো, 
  7. ব্রিটিশ আধিকারিক, অরন্য অফিসার ও কর্মচারীরা অরন্যচারী আদিবাসীদের গতিবিধির ওপর নিয়ন্ত্রন আরোপ করায় আদিবাসীদের স্বাধীন সত্ত্বা বিঘ্নিত হয়
  8. অরন্য আইনের ফলে অরন্য সংক্রান্ত অপরাধ বৃদ্ধি পায়। সহজ সরল আদিবাসীরা অরন্য আইনকে উপেক্ষা করে অরন্যে প্রবেশ করতে গিয়ে অবৈধ প্রবেশের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে কাঠ চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এবং অরন্যে শিকার করতে তারা গিয়ে চোরাশিকারীর অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। 
  9. অরন্য সংক্রান্ত এইসব অপরাধের শাস্তি প্রদানের জন্য সরকার ১৮৭১ খ্রিঃ ,১৯১১ খ্রিঃ এবং ১৯২৪ খ্রিঃ "ক্রিমিনাল ট্রাইবুনাল অ্যাক্ট" পাশ করে। ফলে সরকারের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের ক্ষোভ তীব্রতর হয়ে ওঠে। এর ফলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসী বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। 

আদিবাসীদের অরন্য আইনের বিরোধীতা 

ভারতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বৈদিক আর্যদের সঙ্গে সংঘাতে পরাজিত হয়ে ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী গুলি আত্মরক্ষার জন্য দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় অথবা অরন্য অধ্যুষিত অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলো। প্রাচীন যুগ অথবা মধ্য যুগের কোন শাসক শ্রেণীই তাদের ওপর কর আরোপ করেন নি অথবা তাদের শান্তিপূর্ণ জীবন ধারায় হস্তক্ষেপ করেন নি। ফলে তারা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষদের থেকে যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করতেন। 

কিন্তু ভারতে ব্রিটিশ শাসন সু প্রতিষ্ঠিত হবার পর জল, স্থল, অন্তরীক্ষ, বনাঞ্চল সর্বত্রই ব্রিটিশ সরকার তার চূড়ান্ত কর্তৃত্বনিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত করতে এগিয়ে আসে। এই লক্ষ্যে সরকার যখন অরন্য আইন এনে অরন্য অধ্যুষিত এলাকাকে তার শাসন এলাকার আওতায় নিয়ে আসে, তখন সেটিকে আদিবাসী সমাজ তাদের স্বাধীন সত্ত্বার ওপর আঘাত হিসাবেই দেখেছিলো। ঔপনিবেশিক অরন্য আইনের সূত্র ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খল তাদের ওপরেও নেমে এসেছিলো। 

খুব স্বাভাবিক ভাবেই, ভারতবর্ষের আদিবাসী সমাজ ঔপনিবেশিক অরন্য আইনকে সহজে মেনে নেয় নি। সরকার যেখানেই অরন্য আইনকে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলো, সেখানেই স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায় এর বিরোধিতা করেছিলো। যেমন - 
  • মধ্য ভারতের "বৈগা", হায়দরাবাদের "পাহাড়ী রেড্ডি" ও বাস্তার অঞ্চলের "বিসন মারিয়া" উপজাতি সম্প্রদায় অরন্য আইনের বিরোধীতা করে ও  এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে। 
  • অরন্যের কৃষিজমির ওপর সরকার কর আরোপ করলে "বৈগা" উপজাতি কর দিতে অস্বীকার করে এবং বিদ্রোহ শুরু করে। 
  • গঞ্জাম এলাকার "সাওড়া" উপজাতি সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়।
  • কোম্পানির অরন্য আইনের বিরুদ্ধে অন্ধ্রপ্রদেশের গুডেম ও পাহাড়ি এলাকার "কোয়া" এবং "কোন্ডা ডোরা" উপজাতি গোষ্ঠীও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। 
  • ত্রিবাঙ্কুরের উপজাতীয় কৃষকরা বনদফতরের কর্মীদের সঙ্গে অসহযোগীতা করে এবং মহারাষ্ট্রের থানে জেলার উপজাতীয় কৃষকরা ছোট ছোট হিংসাশ্রয়ী বিদ্রোহ সংগঠিত করে। 
  • এছাড়া, উত্তরাখন্ডের "তেহরি গাড়োয়ালের" কৃষকরা এবং কুমায়ুন অঞ্চলের স্থানীয় কৃষকরাও অরন্য আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। 
  • পাঞ্জাবের অরন্য উপজাতি গুলিও এই আইনের বিরুদ্ধে তাদের বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গুলিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। 
আদিবাসীদের এই ব্যাপক ক্ষোভ বিক্ষোভের কারনে শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৮ খ্রিঃ অরন্য আইনে কিছু সংশোধনী এনে নির্দিষ্ট কয়েকটি অরন্য এলাকায় আদিবাসীদের কিছু সীমিত অধিকার প্রদান করে।

মূল্যায়ন 

পরিশেষে বলা যায়, আদিবাসী সমাজের ওপর অরন্য আইনের একাধিক নেতিবাচক ফলাফল দেখা গেলেও, এই আইনের কয়েকটি সুফলও ছিলো। যথা - 
  1. এই আইনের ফলে অরন্যের অনেক উদ্ভিজ সংরক্ষণের সুবিধা লাভ করে। 
  2. অরন্যের প্রানীজ সম্পদের কিছুটা হলেও সংরক্ষন হয়। 
  3. অরন্য ও পরিবেশ সম্পর্কে একটি সচেতনতা বোধের জাগরন ঘটে। 
তবে মনে রাখতে হবে, বন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে অরন্য আইন প্রণয়ন করা হলেও, সম্পূর্ণ ঔপনিবেশিক উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গিতে এই আইন রচনা ও তার প্রয়োগ করায় তা কোনভাবেই ভারতীয়দের জাতীয় স্বার্থ পূরন করতে পারে নি। এই আইন থেকে ভারতীয়দের চাইতে ব্রিটিশ সরকারই সর্বাধিক লাভবান হয়েছিলো।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post