বর্তমান ভারত : সংক্ষিপ্ত পরিচয়

 যেকোন দেশের পরাধীনতার গ্লানি মোচনে এবং জাতিকে আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে "সাহিত্য" একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। ভারতবর্ষও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলো না। স্বামী বিবেকানন্দের লেখা "বর্তমান ভারত" ছিলো এমনই একটি গ্রন্থ, যা "জাতি" হিসাবে ভারতীয়দের হীনমন্যতা কাটিয়ে তাদের প্রবলভাবে আত্মশক্তিতে উজ্জিবিত করে তোলে।

বর্তমান ভারত - সংক্ষিপ্ত পরিচয়
বর্তমান ভারত - সংক্ষিপ্ত পরিচয় 

প্রথম প্রকাশ ও গ্রন্থাকারে প্রকাশ

"বর্তমান ভারত" স্বামী বিবেকানন্দের লেখা একটি প্রবন্ধ।

  • এটি ১৮৯৯ খ্রিঃ মার্চ মাসে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের একমাত্র বাংলা মুখপত্র "উদ্বোধন" পত্রিকায় প্রথম ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়।
  • পরে ১৯০৫ খ্রিঃ স্বামী শুদ্ধানন্দ প্রবন্ধটিকে একটি "পুস্তিকা" আকারে প্রকাশ করেন। বড়ো আকারের বইকে সাধারনত "পুস্তক" এবং ছোট আকারের বইকে "পুস্তিকা" বলা হয়।
প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন, স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য দেশ গুলি থেকে পরিভ্রমন সরে ১৮৯৭ খ্রিঃ দেশে ফিরে আসেন এবং কয়েক বছর ভারতের বিভিন্ন রাজ্য পরিভ্রমনের পর ১৮৯৯ খ্রিঃ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বাংলা মুখপত্র হিসাবে" "উদ্বোধন" পত্রিকা প্রকাশ করেন।

এই পত্রিকায় স্বামীজি ধারাবাহিক ভাবে তার লেখা বেশ কিছু বিখ্যাত প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিলো -
  • ভারতকথা,
  • পরিব্রাজক, 
  • প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এবং
  • বর্তমান ভারত। 

মূল বিষয়বস্তু ও বৈশিষ্ট্য 

  1. বর্তমান ভারত প্রবন্ধে স্বামীজি ঊনবিংশ শতাব্দীর পরাধীন ভারতবর্ষের শিকড়ের সন্ধান করতে গিয়ে ভারতের দশ হাজার বছরের অতীত ইতিহাসকে নিয়ে বিশ্লেষন ও সমীক্ষা করেছেন। 
  2. অর্থাৎ "বর্তমান ভারতের" আলোচ্য বিষয় ভারতের অতীত ইতিহাসের পর্যালোচনা হলেও এর মূল প্রেক্ষিত ছিলো উনিশ শতকের তৎকালীন বর্তমান ভারত। এই কারনে স্বামীজি এই গ্রন্থটির নামকরন করেছিলেন - "বর্তমান ভারত"।
  3. অতীতের প্রেক্ষাপটে বর্তমান ভারতকে তিনি জানবার ও বোঝবার চেষ্টা করেছেন। সবশেষে পরাধীনতার গ্লানি থেকে ভারতবাসীকে মুক্তির পথ ও জাগরনের বীজ মন্ত্র তিনি দিয়েছিলেন।
  4. এই গ্রন্থে চিরাচরিত তথ্যের আলোকে স্বামীজি ইতিহাসকে বিশ্লেষন করেন নি। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এখানে তিনি ইতিহাসের সরল গতিপথ এবং পরিবর্তন গুলিকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষন করেছেন। 
  5. বিশ্ব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ভারতের ইতিহাস সমীক্ষা করে তিনি দেখিয়েছেন, ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই ৪ টি বর্ন পর্যায় ক্রমে পৃথিবী শাসন করবে। তাঁর মতে, প্রাচীন ভারতের প্রথম পর্বে ছিলো পুরোহিতদের শাসন। বৌদ্ধ যুগ থেকে মুঘল যুগ পর্যন্ত চলেছিলো ক্ষত্রিয়দের শাসন। মুঘল যুগের শেষদিকে ইংরেজদের হাত ধরে যে বৈশ্যদের শাসন শুরু হয়েছিলো, তা শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে। এবং তারপর আসবে শূদ্রদের শাসন। 
  6. বর্তমান ভারত প্রবন্ধে স্বামীজি ভারতের অতীত ইতিহাসের বিশ্লেষন করে বর্তমান ভারতের নানা দূর্বলতার দিক গুলিকে তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো - সামাজিক সংহতি ও ঐক্যের অভাব, জাতিবৈরিতা, অস্পৃশ্যতা, গনতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার অভাব, অনুকরন প্রিয়তা, পরনির্ভরশীলতা ইত্যাদি।
  7. বর্তমান ভারত গ্রন্থটির আরেকটি বিশেষ দিক হলো, এই গ্রন্থটিতে স্বামীজি ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে আধ্যাত্মিক এবং এক উচ্চনৈতিক আদর্শে পরিনত করেন। তার মতে স্বদেশপ্রেম এবং মানব প্রেমের সমন্বিত রূপই হলো জাতীয়তাবাদ। 
  8. বর্তমান ভারত গ্রন্থে স্বামীজি রাজতন্ত্র অপেক্ষা গনতন্ত্রকে মুক্তিলাভ ও শাসনতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ পন্থা হিসাবে মনে করেছেন। পাশ্চাত্যের শক্তিশালী দেশগুলির উদাহরন দিয়ে তিনি বলেছেন, পৃথিবীতে সভ্য ও শক্তিশালী বলে যে কয়টি দেশকে আমরা জেনে থাকি, সেইসব দেশ গুলিতে শাসিতরাই নিজেদের শাসন করছে। 
  9. বর্তমান ভারত গ্রন্থে স্বামীজি ভবিষ্যত বানী করেছিলেন, নানা মত ও পথে খন্ড বিখন্ড ভারতের প্রজাপুঞ্জ যখন একত্রিত হয়ে এক বিরাট শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে, তখনই ইংরেজ সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতোই ভেঙ্গে পড়বে। তার ভবিষ্যত বানী মিথ্যা হয়ে যায় নি। শেষপর্যন্ত জনজাগরনের ফলেই ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে। 
  10. সবশেষে "বর্তমান ভারতে" হীনমন্যতা ও পরাধীনতার গ্লানি তে নুন্যমান দেশবাসীর কানে গনজাগরনের মন্ত্র দিয়ে স্বামীজি বলেছেন - "ওঠো, জাগো"। "তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত"।" ভুলিও না, নীচ জাতি, মুর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই।" 

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post