জমিদার সভাকে কেন ভারতের জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত বলা হয়?

 বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা অবলুপ্তির পর বাংলার জমিদারদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো - "জমিদার সভা" বা "ল্যান্ড হোল্ডার্স সোসাইটি"। ল্যান্ড হোল্ডার্স সোসাইটি নামটি দিয়েছিলেন, এই সভার প্রধান উদ্যোক্তা ও প্রানপুরুষ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর

জমিদার সভাকে কেন ভারতের জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত বলা হয়?
জমিদার সভাকে কেন ভারতের জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত বলা হয়? 

প্রতিষ্ঠা

১৮৩৮ খ্রিঃ ২১ মার্চ কলকাতার টাউন হলে রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে এক বৈঠকে প্রতিষ্ঠিত হয় "জমিদার সভা" বা "ল্যান্ড হোল্ডার্স সোসাইটি"।

এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে ছিলেন -

  • দ্বারকানাথ ঠাকুর,
  • রাজা রাধাকান্ত দেব, 
  • প্রসন্ন কুমার ঠাকুর,
  • রামকমল সেন, 
  • ভবানীচরন মিত্র।

সভাপতি ও সম্পাদক

ল্যান্ড হোল্ডার্স সোসাইটির প্রথম সভাপতিসম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে -
  • রাজা রাধাকান্ত দেব, এবং
  • প্রসন্ন কুমার ঠাকুর।

বিদেশী সদস্য

১৮৩৩ খ্রিঃ চার্টার আইনে কোম্পানির কর্মচারীদের ভারতে জমি ক্রয় বিক্রয়ের অধিকার দেওয়া হয়। এর ফলে অনেক ইওরোপীয় ভারতে জমিদারি সত্ত্ব কেনার অধিকার লাভ করে।ফলে অনেক ইওরোপীয় জমিদারও ল্যান্ড হোল্ডার্স সোসাইটির সদস্য হন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - 
  • থিওডোর ডিকেন্স এবং 
  • জর্জ প্রিন্সেপ। 

জমিদার সভার উদ্দেশ্য 

জমিদার সভা বা ল্যান্ড হোল্ডার্স সোসাইটির প্রধান উদ্দেশ্য গুলি ছিলো - 
  1. বাংলা, বিহার ও ঊড়িষ্যার জমিদারদের স্বার্থ রক্ষা করা, 
  2. ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রকে জমিদারদের স্বপক্ষে নিয়ে আসা, 
  3. ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার ঘটানো, 
  4. কৃষি ও জমির সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত নানা বিষয় ও সমস্যা গুলো নিয়ে আলোচনা করা। 

বৈশিষ্ট্য 

  1. মূলত বাংলা, বিহার ও ঊড়িষ্যার জমিদারদের নিয়ে এই সভা গঠিত হয়েছিলো। 
  2. ভারতে বসবাসকারী অনেক ইংরেজ জমিদারও এই সভার সদস্য হয়েছিলেন। 
  3. এই সভার সঙ্গে সাধারন মানুষের কোন সম্পর্ক ছিলো না। 
  4. মূলত জমিদারদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছিলো। 
  5. এই সভার সদস্য হতে গেলে প্রথমে ৫ টাকা, পরে বার্ষিক ২০ টাকা চাঁদা দিতে হতো। ফলে বিত্তবান ও জমিদার ছাড়া সাধারন মানুষরা এর সদস্য পদ লাভ করতে পারতেন না। 
  6. সরকারের কাছে জমিদারদের অভাব অভিযোগ ও বিভিন্ন দাবি দাওয়া আবেদনের মাধ্যমে তুলে ধরার জন্যই এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছিলো। 

কর্মসূচি 

জমিদার সভা বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলো। যেমন - 
  1. ১৮২৮ খ্রিঃ আইন অনুযায়ী সরকার নিষ্কর ভূমির ওপর কর আদায় শুরু করলে জমিদার সভা তার প্রতিবাদ করে। 
  2. ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার ঘটানোর জন্য এই সভা সরকারের কাছে অনুরোধ করেছিলো। 
  3. এছাড়া, রাজস্ব বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং পুলিশ বিভাগের সংস্কার করবার জন্যও এই সভা সুপারিশ করে। 
ল্যান্ড হোল্ডার্স সোসাইটি তার আদর্শ ও উদ্দেশ্য গুলি প্রচার করবার জন্য ভারতের অন্যত্র শাখা সংগঠন গড়ে তোলায় গুরুত্ব আরোপ করে। এর ফলে মাদ্রাজ ও পুনাতেও এই সভার একটি করে শাখা সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। 

জমিদার সভার ঐতিহাসিক গুরুত্ব 

ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে জমিদার সভার গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম - 
  1. জমিদার সভার মধ্য দিয়েই প্রথম ভারতীয়রা ভারতীয়দের আশা আকাঙ্খার প্রতি সহানুভূতিশীল ইংরেজদের সমর্থন ও সহযোগীতা লাভে সক্ষম হন। 
  2. জমিদার সভার রাজনৈতিক চিন্তাধারা ছিলো যথেষ্ট উদারনৈতিক। এই সভার উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি গুলির মধ্যে কোন সংকীর্ণ জাতিভেদ বা আঞ্চলিকতা বোধের প্রশয় ছিলো না। এই কারনে জমিদার সভাকেই যথার্থ অর্থে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা যায়।
  3. এই প্রতিষ্ঠান থেকেই ভারতীয় জনসাধারণ সর্বপ্রথম নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবি আদায়ের শিক্ষা লাভ করে। 
  4. এই সভার দাবি মেনে নিয়ে সরকার প্রতিটি গ্রামের জন্য কিছু নিষ্কর জমি মঞ্জুর করে। 
  5. ভারতবাসীর কল্যানের জন্য উইলিয়াম অ্যাডাম ইংল্যান্ডে ১৮৩৯ খ্রিঃ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জমিদার সভার গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে "ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি" ও "ল্যান্ড হোল্ডার্স সোসাইটি" একত্রিত হয়ে বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন - "ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৫১ খ্রিঃ সভাপতি ছিলেন - রাধাকান্ত দেব, প্রথম সম্পাদক ছিলেন - দ্বারকানাথ ঠাকুর) এর জন্ম হয়। 
এই সমস্ত রাজনৈতিক অবদান গুলির জন্য সঙ্গত কারণেই জমিদার সভাকে "ভারতের জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত" বলে অভিহিত করা হয়। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post