স্বাধীন ভারত ও উপেক্ষিত গান্ধী

 ভারতবর্ষ তখন স্বাধীন হয়ে গেছে...। কংগ্রেসের যুব নেতারা দাবি তুললেন, স্বাধীন ভারতের জন্য একটি উপযুক্ত জাতীয় পতাকা চাই। ঠিক হলো, জাতীয় পতাকার মাঝে গান্ধীর "শখের খেলনাটিকে" (চরকা) সরিয়ে ফেলতে হবে এবং তার মাঝখানে অশোক চক্র বসিয়ে দিতে হবে।

চরকার ধারনাটাই অনেকটা মান্ধান্তার আমলের। পুরোনো প্রযুক্তিকে আঁকড়ে ধরে টেনেটুনে শামুকের মতো তো আর দেশ চলতে পারে না। অগত্যা জাতীয় পতাকা থেকে চরকার বিদায় ঘটানো হলো।

স্বাধীন ভারত ও উপেক্ষিত গান্ধী
স্বাধীন ভারত ও উপেক্ষিত গান্ধী 

স্বাধীনতা লাভের সময় গান্ধী যথেষ্টই বুড়ো হয়েছিলেন। কথায় বলে, বুড়ো বয়সে উপেক্ষা, অনাদর আর অভিমানের পাহাড় জমে। গান্ধীর ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছিলো। স্বাধীন ভারতে তাঁর চিন্তা ভাবনা গুলো যে এমন ভাবে উপেক্ষিত হয়ে পড়বে, সেটা তিনি মোটেও কল্পনা করতে পারেন নি।

গেরুয়া, সাদা আর সবুজ পতাকায় তাঁর সাধের চরকা বিদায়ের সিদ্ধান্তে গান্ধী খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে গান্ধীজি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ভারতের জাতীয় পতাকার শুধু বিরোধীতাই করেন নি, যতদিন বেঁচে ছিলেন, কোনদিনই স্বাধীন ভারতের পতাকাকে তিনি জাতীয় পতাকার মর্যাদা দেন নি।

গান্ধীজি অহিংস মতের অধিকারী হলেও, ব্যক্তিগত ইচ্ছা পূরন না হলে প্রায়ই তিনি সিংহের মতো প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে উঠতেন। ইতিহাসে এর অনেক প্রমান আছে। 

১৯৩৯ খ্রিঃ ২৯ জানুয়ারি, জাতীয় কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশনে গান্ধী মনোনীত পট্টভি সীতারামাইয়াকে ২০৩ টি ভোটে পরাজিত করে সুভাষ চন্দ্র বসু জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন। কিন্তু সুভাষের এই জয়কে গান্ধী কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। এই জয় পরাজয়ে তিনি এতটাই প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে ওঠেন, যে একে ব্যক্তিগত আক্রমনের পর্যায়ে টেনে আনেন। পট্টভির পরাজয়কে তিনি নিজের পরাজয় বলে প্রচার করে বলে বেড়ান "পট্টভি সীতারামাইয়ার পরাজয় আমারই পরাজয়"

এই সময় গান্ধীর অনুগামীরা এমন প্রচারও করে বেড়ায় যে, সুভাষ ভুয়া ভোটার ও নির্বাচনে কারচুপি করে জয়ী হয়েছেন। শেষটায় গান্ধী ও তার অনুগামীরা মিলে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে এমন এক পরিবেশের জন্ম দিলেন, যাতে সুভাষ কোন কাজ করতে না পারেন। তাদের এই অসহযোগীতার ফলে বাধ্য হয়েই সুভাষ কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। যদি থেকে যেতেন, তাহলে কংগ্রেস দলটাই হয় দু টুকরো হয়ে যেতো। নয়তো তার পুরো খোলোসটাই চেঞ্জ হয়ে যেতো।

গান্ধীজি নিজের ইচ্ছা পূরনের জন্য এমন সব কাজ করেছিলেন, যা প্রকারান্তরে ভারতের অনেকখানি ক্ষতি করেছিলো। ভারতবর্ষ যখন স্বাধীন হলো, তখন তাঁর যোগ্য প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তা নিয়ে কংগ্রেসের প্রাদেশিক কমিটি গুলোর কাছে মতামত চাওয়া হলো। প্রায় সমস্ত প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি গুলোই ভারতের যোগ্য প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নামটি প্রস্তাব করে।

কিন্তু এই প্রস্তাব গান্ধীজির মোটেই পছন্দ হলো না। তাঁর মানস পুত্র পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে যোগ্য, এটা তিনি খোলাখুলি ভাবেই বলেছিলেন। শেষপর্যন্ত, গনতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে পদপিষ্ট করে গান্ধী জওহরলাল নেহেরুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দেন। গান্ধীর সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করার মতো সাহস তখনও পর্যন্ত কংগ্রেসে কারো ছিলো না।

নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হয়ে এমন কিছু অদূরদর্শী কাজ করেন, যার ফল আজোও ভারতবর্ষকে ভুগতে হচ্ছে। 

  • সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য লাভের সুযোগ পেয়েও নেহেরু তা হাতছাড়া করেন।
  • তার অদূরদর্শী নীতির কারনে কাশ্মীর সমস্যার সৃষ্টি হয়।
  • তিব্বত ভারতের হাতছাড়া হয়।
  • তাঁর আবেগপ্রবন, অদূরদর্শী নীতির কারনে ১৯৬২ খ্রিঃ ভারত - চিন যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। 
শোনা যায়, স্বাধীন ভারতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবার পর মাউন্টব্যাটেন নেহেরুকে প্রস্তাব দেন, মুসলিমদের জন্য ভারত ভেঙে পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে। সুতরাং ভারতের অবশিষ্ট অংশের নাম "হিন্দুস্থান" রেখে দেওয়া হোক।

নেহেরু এর বিরোধিতা করে বলেন, জাতীয় কংগ্রেস কোনদিনই দ্বিজাতি তত্ত্বকে সমর্থন করে নি। এই নাম মেনে নিলে পাকিস্তানের দ্বিজাতি তত্ত্বকেই মান্যতা দেওয়া হয়। যা কংগ্রেস কোনদিনই করবে না। 

কংগ্রেস দ্বিজাতি তত্ত্বকে না মানলেও, সেই দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানকে খুব সহজ ভাবেই মেনে নেন। এটা নিঃসন্দেহে ছিলো এক বিরাট ঐতিহাসিক দ্বিচারিতা। আসলে গান্ধীর ভাসা ভাসা ধুয়াশাপূর্ন নীতি ও আদর্শ যেভাবে কংগ্রেসকে আচ্ছন্ন করেছিলো, ঠিক তেমনই ভাবে তাঁর ভবিষ্যতের বংশবদদেরও আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। নেহেরু তারই উত্তরসূরী ছিলেন।

যাইহোক, আমাদের এই লেখার মুখ্য চরিত্র নেহেরু নন। তার মানস পিতা গান্ধী। সুতরাং আমরা আবার গান্ধীতেই ফিরে যাবো। কথায় বলে, ছেলে যখন বড়ো হয়ে স্বাবলম্বী হয়ে যায়, তখন বাপ ছেলে হয়ে যায়। আর ছেলে বাপ হয়ে যায়। গান্ধী আর নেহেরুর ক্ষেত্রে কথাটা একদম অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিলো। 

যে পিতার ইচ্ছাতে নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই পিতার ইচ্ছা গুলিকেই নেহেরু এবং তার কংগ্রেস বালখিল্য বলে উড়িয়ে দিয়েছিলো। বুড়ো লোক বাড়িতে বসে অনেক কথাই তো বিড় বিড় করে বলে, কে আর তাকে গুরুত্ব দেয়! গান্ধীর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই হয়েছিলো। তিনি বুঝতেও পারেন নি, তিনি এখন  ৭৭ বছরের একজন বুড়ো হয়ে গেছেন। কংগ্রেসে তার কথার আর কোন মুল্যই নেই।

তবু বেশ কয়েকবার তিনি ভয়ঙ্কর রকম জেদ ধরে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তিনি মোটেই বুড়ো হন নি। ঘটনাটি একটু বলা প্রয়োজন। ১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো, ভারতের কোষাগারে থাকা ৩৭৫ কোটি টাকা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আনুপাতিক হারে ভাগ করে দেওয়া হবে। সেই মতো পাকিস্তানের ৫৫ কোটি টাকা প্রাপ্য ছিলো। 

কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের অল্প কিছু কালের মধ্যেই যেভাবে পাকিস্তান কাশ্মীর দখল করে নিয়েছিলো, তাতে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ও নেহেরু ঠিক করলেন, পাকিস্তানকে তারা এক নয়াকড়িও দেবেন না। এর বদলে এই টাকাটা পাকিস্তান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া সংখ্যালঘু হিন্দু ও শিখ শরনার্থীদের কল্যানে কাজে লাগাবেন। 

এই ঘটনায় গান্ধী খুব দুঃখ পেলেন এবং অনশন শুরু করে দিলেন। শেষটায় বাধ্য হয়েই নেহেরু গান্ধীর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে পাকিস্তানকে ৫৫ কোটি টাকা দিতে বাধ্য হন। এমন বহু অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়ে গান্ধী শুধু ভারতের বিপদ ডেকে আনেন নি। নিজেরও বিপদ ডেকে এনেছিলেন। নিজের প্রান দিয়ে যার মূল্য তাকে মেটাতে হয়েছিলো। 

মানুষের একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত মানুষ। ধর্ম মানুষের নিতান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। আমি কাকে আরাধনা করবো, কিভাবে ঈশ্বরের কাছে নিজের প্রার্থনা জানাবো, এসবই যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু গান্ধী এসব অস্বীকার করে ভারতের ইতিহাসে প্রথম রাজনীতির সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত ধর্মকে মিশিয়ে দেন। হিন্দু আর মুসলমান দুটো বলকে নিয়ে বিসমার্কের কূটনীতির মতো তিনি খেলতে চেষ্টা করেছিলেন। তার লক্ষ্য ছিলো সবসময় একটা বলকে উপরে তুলে রাখতে হবে। আর একটাকে হাতে। 

তাঁর এই দুর্বুদ্ধিপূর্ন কূটনীতি অবশ্য আজও স্বাধীন ভারতের রাজনীতিতে প্রয়োগ করা হয়। ডান, বাম, সব ধরনের রাজনৈতিক দল গুলোই এইদিক থেকে গান্ধীকে খুব করে ফলো করেন। কিন্তু এই পঁচা দুর্গন্ধময় জিনিসটা ছাড়া গান্ধী আর যা কিছু বলে গিয়েছিলেন, তার প্রায় কোন কিছুই তারা ফলো করেন না। স্বাধীনতার সময়েও কেউ সে সব মানেন নি। 

গান্ধী চেয়েছিলেন, স্বাধীন ভারতের মন্ত্রীরা নিজেদের পায়খানার ঘরটি পর্যন্ত নিজের হাতে পরিষ্কার করবেন। তাদের ঘরে কোন ভৃত্য বা চাকর বাকর থাকবে না। কোন দেহরক্ষী থাকবে না। নিজস্ব গাড়ি থাকবে না। সোফা, চেয়ার টেবিল, কোন কিছুই থাকবে না। ভারতের নেতারা জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ সব নিজেরাই করবেন। 

আস্ত গোটা মুরগি ভক্ষনকরী এবং বিদেশী সিগারেটের সুখটানে অভ্যস্ত নেহেরুদের কাছে গান্ধীজির এই সব চিন্তা ভাবনা বড়োই বেমানান ছিলো। গান্ধী যে ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেখানে বড়ো জোর প্রধানমন্ত্রী নিজে সাইকেল চালিয়ে তার দপ্তরে যেতে পারেন। কিন্তু আমাদের দুঃখ এই ছবি আমরা নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর (মার্ক রুট) দেখে থাকলেও... ভারতের মাটিতে কোনদিনই দেখতে পাবো না। 

আমাদের দেশে যে কোন উন্নয়নের আগে হিন্দু কে যতটা না হিন্দু বুঝিয়ে দেওয়া হয়, মুসলমানকে তার চেয়ে অধিক বেশি "মুসলমান" বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ব্রিটিশের এই "ক্ষমতা ও বিভাজন" কৌশলকে জাতীয় কংগ্রেসের অনেকেই পরাধীন ভারতে ভালো ভাবে রপ্ত করে নিয়েছিলেন। কংগ্রেস চিরকাল ক্ষমতা পাওয়ার জন্য লড়াই করে গিয়েছিলো আর ব্রিটিশ সরকার ক্ষুধার্তকে রুটি ছুড়ে দেওয়ার মতো তাকে অল্প অল্প ছেঁড়া রুটির মতো ক্ষমতা ছুড়ে দিয়ে তার খিদে বাড়িয়ে দিয়েছিলো। 

এসব করতে গিয়ে শেষের দিকটায় কংগ্রেসের লোকগুলো এতটাই ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছিলো যে, তারা দেশের অঙ্গহানী করেও দেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে সম্মত হন। গান্ধী প্রথমটায় অবশ্য বেঁকে বসেছিলেন। বলেছিলেন, দেশভাগ করতে হলে আমার লাশের ওপরেই তা করতে হবে। মহাভারতে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র অনেক নাটক দেখার পর শেষ পর্যন্ত কৌরবদেরই পক্ষ অবলম্বন করতেন। গান্ধীও শেষপর্যন্ত তাই করেছিলেন। দেশভাগ মেনে নেন তিনি। 

কিন্তু চিরকাল যেটা তিনি করে এসেছিলেন, স্বাধীন ভারতেও তিনি তার বীজ পুঁতে দিয়ে যান। ভারত স্বাধীন হবার পর নেহেরু ঠিক করেছিলেন, সরকারি অর্থে সোমনাথ মন্দির নতুন করে গড়ে তুলবেন। একথা শোনার পর গান্ধী ভয়ঙ্কর ভাবে বেঁকে বসে বললেন, সোমনাথ মন্দিরের আগে সরকারি অর্থে দিল্লির মসজিদ গড়ে দিতে হবে। গান্ধীর জেদের কাছে অবশেষে নেহেরু ঝুঁকতে বাধ্য হন। 

এখানে মন্দির মসজিদ তৈরি করাটা বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হলো সরকারি অর্থে ধর্মীয় তোষন করা। উন্নয়নের ছদ্মবেশে মুসলমানকে বুঝিয়ে দেওয়া, মুসলমানদের জন্য এইটা করা হলো! আজ নিজেদের ভোট ব্যাংককে অক্ষত রাখতে রাজনৈতিক দল গুলো উন্নয়নের অন্তরালে যে হিন্দু উন্নয়ন এবং মুসলিম উন্নয়নের কাতুকুতু দেন, সেই কৌশল মহাত্মাজী এবং তাঁর মানস পুত্র নেহেরুজী খুব ভালো ভাবেই তার উত্তরসূরীদের জন্য ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। 

গান্ধীজি চাইতেন, স্বাধীন ভারত যাতে কোন ভাবেই আধুনিক প্রযুক্তির শিকার না হয়ে পড়ে। মাধ্যমিকে টেনেটুনে পাশ করা গান্ধী নিজেই জানতেন না, চরকাটাও আসলে একধরনের প্রযুক্তি। প্রযুক্তিকে অস্বীকার করে কোন সমাজ ও সভ্যতাই টিকতে পারে না। সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতি প্রযুক্তির অগ্রগতির উপরেই নির্ভর করে। স্বাধীনতার রক্ষাকবচও আধুনিক প্রযুক্তি।

 এর সবথেকে বড়ো প্রমান হলো, বর্তমানে প্রথম বিশ্বের দেশ গুলি উন্নত প্রযুক্তি দ্বারাই আমাদের পরাধীন করে রাখতে চাইছে। বার বার বলা সত্ত্বেও তারা উন্নত প্রযুক্তি গুলি আমাদের দিচ্ছে না। একমাত্র পুরাতন ও বাতিল প্রযুক্তি গুলি আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে চালান করে আমাদের পরাধীন করে রাখতে চাইছে। 

স্বাধীন ভারতে গান্ধীর ভাবনা গুলি তাই জাতীয় কংগ্রেসের বুদ্ধিমান নেতাদের কাছে অত্যন্ত অসাড় ও অনুপযুক্ত বলে মনে হয়েছিলো। অবশ্য এসবের মধ্যে একটা বিষয়ে গান্ধীর চিন্তা ভাবনাকে সেল্যুট জানাতেই হয় - তাঁর গ্রাম ভাবনা। 

গান্ধীজি চেয়েছিলেন স্বাধীন ভারত গ্রামীন অর্থনীতির মধ্যে বিকশিত হোক। কারন ভারতের আসল প্রান ও আত্মা গ্রামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। গ্রামের মানুষকে কুটির শিল্পের মাধ্যমে আত্মনির্ভর করে তুলতে হবে। 

কিন্তু গান্ধী যখন এইসব কথা গুলো বলেছিলেন তখন বাকি পৃথিবীতে রাজ করছিলো বড়ো বড়ো শিল্প - কারখানা। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিলো ভারি শিল্পের। এর ফলে আধুনিক পরিকাঠামো যুক্ত এলাকায় বা বড়ো বড়ো শহর লাগোয়া অঞ্চলে গড়ে উঠতে থাকলো একের পর এক কারখানা। দেশের মানুষের নজর গ্রাম থেকে শহরে ঘুরে গেলো। সরকারও চাহিদার কথা ভেবে কৃত্রিম নগর নির্মানে জোর দিতে থাকলেন। একের পর এক পরিকল্পিত নগরী গড়ে উঠতে আরম্ভ করলো। 

এসবের ফলে গ্রামে থাকা তিন ভাগ ভারত থেকে গেলো অন্ধকারে। ভারতের একভাগ শহুরে এলাকা আধুনিক সুযোগ সুবিধা ও জীবন যাত্রার চাকচিক্যে "ইন্ডিয়া" নামে ভাষ্কর হয়ে উঠলো, অন্যদিকে ৩ ভাগ গ্রামীন ভারত "ভারত" হয়েই লন্ঠনের আলোতে টিম টিম করে টিকে থাকতে লাগলো। 

পরিকল্পিত কৃত্রিম নগর নির্মান সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হলেও, আদর্শ গ্রাম নির্মানের কোন পরিকল্পনা আজও আমাদের দেশের সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় নি। আমাদের অর্থনৈতিক চিন্তা ভাবনায় স্থান নিয়েছে, গ্রাম সত্য নয়। গ্রাম থেকে শহর গড়ে ওঠাই হলো আসল সত্য ও উন্নয়ন। সুতরাং উন্নয়নের মডেল হবে শহর বা নগর এবং তার পরিসেবার সম্প্রসারণ। গ্রাম কখনোও উন্নয়নের মডেল হতে পারে না। 

এইভাবেই... এবং এইভাবেই স্বাধীন ভারতে গান্ধী উপেক্ষিত থেকে যান। তার চিন্তা ভাবনা গুলিকে তার সময়ের অনেকেই পছন্দ করেন নি। এযুগেও ভারতের একটা বড়ো অংশের লোক মনে করে গান্ধী আমাদের দেশে না জন্মালেই হয়তো ভালো হতো।

 আমাদের দেশে ইংরেজ শাসনের দুটো পার্ট ছিলো। একটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। আরেকটা ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে শাসন। দুটোরই অবসান ঘটে দুটো সেনা বিদ্রোহের পর। ভারতের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত দুটি সেনা বিদ্রোহ ঘটেছিলো। একটা ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে ভারতীয় সেপাইরা যেভাবে ক্ষেপে গিয়েছিলো, তাতে ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিলো, ভারতের মতো এতবড়ো সাম্রাজ্যকে আর কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়া বিবেচনার কাজ হবে না। সুতরাং তড়িঘড়ি করে ১৮৫৮ খ্রিঃ ভারত শাসন আইনে কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতের শাসন দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলো। 

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ ফৌজের অনুপ্রেরনায় ১৯৪৬ খ্রিঃ ভারতে আবার শুরু হয়েছিলো সেনা বিদ্রোহ - নৌ সেনা বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ দেখার পর ইংরেজ সরকার বুঝতে পেরেছিলো, যে সেনা, পুলিশ দিয়ে ভারতীয়দের শায়েস্তা করে তারা এতকাল সাম্রাজ্যবাদকে চালিয়ে নিয়ে গেছে। এখন তা আর পারা যাবে না। কারন সেনাদের মনেও এখন স্বাধীনতার ভুত জেগেছে। অগত্যা পরের বছর ১৯৪৭ খ্রিঃ ভারতীয়দের হাতে ইংরেজরা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। 

ভারতের ইতিহাসের এই সরল সত্য জানার পরেও বারংবার মনে প্রশ্ন জাগে, গান্ধীজির অহিংসা নীতি তাহলে দেশের স্বাধীনতার জন্য কি করেছিলো? তার অবদানই বা কতটুকু? 

আমি গান্ধীজির একজন প্রবল ও নির্মম সমালোচক। আমি ইতিহাসের একজন শিক্ষক। ঐতিহাসিক চরিত্রকে তথ্যের আলোকে একজন ডাক্তারের মতো কাটাছেঁড়া করাই আমার প্রধান কাজ। সুতরাং গান্ধীর ভাবমূর্তি রক্ষার দায় ও দায়িত্ব কোনটাই আমার নেই। আমি নির্মম সত্যি কথা গুলো বলে যাবোই... এবং তারপরেও বলবো এত সব ভুলের পরেও এই লোকটাকে আমি এখনো শ্রদ্ধা করি। 

কারন ৩৩ কোটি ঘরকুনো দেশবাসীকে ঘরের বাইরে টেনে বের করে এনে নিরস্ত্র ভাবে ব্রিটিশ পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে দাড় করিয়ে তিনি যে ভাবে ভারতের ভিতু লোকগুলিকে সাহসী হতে শিখিয়ে ছিলেন, তা আর কেউ পারেন নি। একটা জাতি যখন রাজপথে নেমে যায়, তখন সেই গন বিক্ষোভকে পৃথিবীর কোন সাম্রাজ্যবাদী, স্বৈরাচারী শক্তির বন্দুকের নলই দমন করতে পারে না। যুগে যুগে তাই হয়ে এসেছে।

 আসলে স্বাধীন ভারতেই হোক, আর পরাধীন ভারতেই হোক, গান্ধীকে আপনি উপেক্ষা করতে পারেন, কিন্তু কখনই তাকে অস্বীকার করতে পারবেন না। এটাই গান্ধী সত্য। 


(কৃতজ্ঞতা স্বীকার - এই লেখায় ব্যবহৃত কিছু তথ্যের জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক লাপিয়ের এর লেখা "ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট" গ্রন্থটির কাছে ঋনী।) 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post