ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই ভারতবর্ষের অগ্রগতির দুটি ধারা চলে আসছিলো। এর একটি ছিলো শাসক শ্রেণীর অর্থাৎ ব্রিটিশ জাতির সহায়তায় ও তার অনুকরনে স্বদেশের উন্নতি সাধন করা। অপর ধারাটি ছিলো অন্যকারো সাহায্য না নিয়ে অথবা অপরের অনুকরন না করে নিজ চেষ্টায় স্বদেশের কল্যান করা। এই দ্বিতীয় ধারার প্রচেষ্টারই অন্যতম অঙ্গ ছিলো হিন্দুমেলা। নবগোপাল মিত্র ১৮৬৭ খ্রিঃ কলকাতায় এই হিন্দু মেলার প্রতিষ্ঠা করেন বা আয়োজন করেন।
হিন্দুমেলা ও তার অবদান |
প্রেক্ষাপট
হিন্দুমেলা সম্পর্কে বিস্তৃত ভাবে আলোচনায় প্রবেশের আগে এর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আলোচনা করা খুবই প্রয়োজন। নবগোপাল মিত্র কেন হিন্দুমেলার মতো একটি মেলা সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন? এর মূল প্রয়োজনীয়তাই বা কি ছিলো? এখানে আরোও একটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে, কোন ঐতিহাসিক ঘটনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নবগোপাল মিত্র হিন্দুমেলার আয়োজন করেন?
প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন, উনিশ শতকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের সঙ্গে ভারতে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিরও প্রসার ঘটেছিলো। এর বশবর্তী হয়ে একদল ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেনীর জন্ম হয়েছিলো, যারা পোশাকে আশাকে, খাদ্য ও সংস্কৃতিতে ইংরেজদের অনুকরন করতে থাকেন। এরা ব্রিটেন বা পাশ্চাত্যের সমস্ত কিছুকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতে থাকেন এবং স্বদেশের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, কর্ম এবং ঐতিহ্যকে নিকৃষ্ট বলে ভাবতে থাকেন।
কালক্রমে এই শিক্ষিত শ্রেনী ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সবথেকে বড়ো সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। এরা মনে করতেন, একমাত্র ব্রিটেনের বশবর্তী হলে এবং তার দেখানো পথ গুলি অনুকরন করলেই ভারতের উন্নতি ঘটানো সম্ভব।
বলা বাহুল্য, ভারতে ইংরেজি শিক্ষার কুফল গুলি যিনি সবার প্রথমে উপলব্ধি করেছিলেন, তিনি হলেন রাজনারায়ন বসু। প্রথম জীবনে রাজনারায়ন নব্যবঙ্গীয় দলের একজন প্রধান সদস্য ছিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিজে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে এর কুফল গুলি তিনি যতটা কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তা অন্য কেউ পারেন নি।
কর্মজীবনে রাজনারায়ন মেদিনীপুরের একটি সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। এই সময়ে তিনি অনেক গুলি জনহিতকর সভা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সব সভা সমিতির মধ্য দিয়ে তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার কুফল গুলিকে দূর করতে চেয়েছিলেন।
১৮৬১ খ্রিঃ এরকমই "সুরাপান নিবারনী সভা" প্রতিষ্ঠা করে তিনি মাতালদের ভয়ানক রোষের মুখে পড়ে যান। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি বুঝেছিলেন, বিদেশী শিক্ষার একটি মাত্র কুফল দূর করলেই মূল সমস্যার সমাধান হবে না।
এই উপলব্ধি থেকে রাজনারায়ন "জাতীয় গৌরব সম্পাদন" বা "গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিনী সভা" প্রতিষ্ঠা করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো - দেশীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, রীতি নীতি, আচার ব্যবহার, পোশাক পরিচ্ছদ, এককথায় স্বদেশের যা কিছু সব রক্ষা করা এবং প্রতিপালন করা।
কালক্রমে গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিনী সভার কার্যাবলী কে প্রসারিত করবার জন্য রাজনারায়ন ১৮৬৬ খ্রিঃ ইংরেজি ভাষায় একটি অনুষ্ঠান পত্র রচনা করেন। এই পত্রটিতে তিনি দেশীয় ঐতিহ্যকে জাগরিত করবার জন্য - হিন্দু ব্যায়াম, হিন্দু সঙ্গীত, হিন্দু চিকিৎসা বিদ্যা, বাংলা ভাষায় বক্তৃতা, হিন্দু পোশাক, পানাহার ইত্যাদি কথা তুলে ধরেন।
রাজনারায়নের অনুষ্ঠান পত্রটি ন্যাশনাল পেপারে ছাপা হয়। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, দেশীয় ভাবধারার প্রচারের জন্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৫ খ্রিঃ ৭ ই আগস্ট "ন্যাশনাল পেপার" প্রকাশ করেন এবং এর সম্পাদকের ভার অর্পন করেন নব্য ব্রাহ্ম যুবক নবগোপাল মিত্রের ওপর।
যাইহোক, রাজনারায়নের অনুষ্ঠান পত্রটি ন্যাশনাল পেপারে ছাপতে গিয়ে সম্পাদক নবগোপাল মিত্র গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিনী সভার কার্যাবলীর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন এবং এর আদর্শে হিন্দুমেলার মতো একটি জাতীয়তাবাদী মেলার ভাবনা তার মাথায় আসে।
এই প্রেক্ষাপটেই প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দুমেলা।রাজনারায়ন বসু তার আত্মচরিতের ২০৮ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন - হিন্দুমেলা আমার প্রস্তাবিত জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিনী সভার আদর্শেই গঠিত হয়েছিলো।
আসলে মেদিনীপুরে স্বদেশী ভাবধারা প্রসারের যে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার সূত্রপাত রাজনারায়ন বসু করেছিলেন, হিন্দুমেলা তারই উত্তরসূরী ছিলো। সুতরাং একথা বলা যায়, হিন্দুমেলার প্রতিষ্ঠা আকস্মিক কোন ঘটনা ছিলো না। ঐতিহাসিক উপলব্ধি ও ধারারই অনিবার্য ফলশ্রুতি ছিলো।
হিন্দুমেলার প্রতিষ্ঠা
মেলা শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো মিলন বা মিলিত হওয়া। নানা ধর্ম, বর্ন ও জাতিতে বিভক্ত হিন্দু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য নবগোপাল মিত্র ১৮৬৭ খ্রিঃ "হিন্দুমেলা" প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই হিন্দুমেলার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলো জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ীর সদস্যরা। আর্থিক এবং বৌদ্ধিক দুটি দিক থেকেই নানা ভাবে সাহায্য করে তারা মেলাটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।
মেলার সম্পাদক ও সদস্য
প্রথমদিকে হিন্দুমেলার সম্পাদক ছিলেন - গনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। নবগোপাল মিত্র ছিলেন সহকারী সম্পাদক। ১৮৬৯ খ্রিঃ মাত্র ২৮ বছর বয়সে গনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু হলে হিন্দুমেলার সম্পাদক হয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এছাড়া, শিবনাথ শাস্ত্রী, জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিপিনচন্দ্র পাল, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই ক্যাপ্টেন জিতেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে মেলায় যোগ দিয়েছিলেন এবং এর আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
মেলার নামকরন
এখানে মনে রাখতে হবে, প্রথমদিকে হিন্দুমেলার নাম "হিন্দুমেলা" ছিলো না। প্রথম ৩ বছর এই মেলার নাম ছিলো "চৈত্রমেলা"। পরবর্তীকালে এর নাম পরিবর্তিত করে রাখা হয়েছিলো হিন্দুমেলা ও জাতীয় মেলা।
নাম বিতর্ক বনাম সাম্প্রদায়িকতা
হিন্দুমেলা নিয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে দুটি মৌলিক প্রশ্ন অনেকের মনেই উঠে আসে -
- (১.) হিন্দুমেলার নাম হিন্দুমেলা হয়েছিলো কেন? এবং
- (২.) হিন্দুমেলা কি একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান ছিলো?
হিন্দুমেলার নাম হিন্দুমেলা হয়েছিলো কেন, অথবা হিন্দুমেলা একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান ছিলো কিনা, তার ব্যাখ্যা আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
- হিন্দুমেলার নামটির সঙ্গে "হিন্দু" শব্দের উল্লেখ দেখে অনেকেই একে সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান বলে ইতিহাসে ব্যাখ্যা করে থাকেন। যদিও এটি সর্বতো ভাবে ভুল এবং অনৈতিকহাসিক।
- মনে রাখতে হবে, উনিশ শতকে ভারতীয়দের কাছে জাতীয়তাবাদের স্পষ্ট কোন সংজ্ঞা, আদর্শ বা মডেল ছিলো না।
- প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতি এবং হিন্দু ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে অভিন্ন বা সমার্থক ভাবা হতো। এইজন্য ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় ভাবের বা জাতীয় চেতনার জাগরনের জন্য "হিন্দু" নামটি সবক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হতো। যেমন - হিন্দু কলেজ, হিন্দু স্কুল, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের লেখা হিন্দু কেমিস্ট্রি বই ইত্যাদি।
- সুতরাং জাতীয়তাবোধ ও দেশাত্মবোধ জাগরনের মূল লক্ষ্যেই হিন্দুমেলার নাম "হিন্দুমেলা" রাখা হয়েছিলো।
- তাই এটি কোন সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান ছিলো না। এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে সব ভারতবাসীকে জাতীয় চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করে তোলা।
হিন্দুমেলার উদ্দেশ্য
হিন্দুমেলার প্রধান উদ্দেশ্যের কথা এর দ্বিতীয় অধিবেশনে মেলার প্রধান সম্পাদক গনেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছিলেন। খুব সংক্ষেপে হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
- দেশের মানুষের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন এবং জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটানো,
- দেশাত্মবোধ সৃষ্টি করা,
- পাশ্চাত্যের প্রভাব মুক্ত হয়ে হিন্দু সভ্যতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও হিন্দু জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত করা,
- স্বদেশী ভাষা ও হিন্দু ধর্মের অতীত গৌরবময় মহিমাকে তুলে ধরা,
- হিন্দুদের মধ্যে আর্থিক স্বনির্ভরতা, আত্মনির্ভরতা, শরীরচর্চা এবং স্বদেশী কৃষি, শিল্প ও শিক্ষার প্রসার ঘটানো,
- দেশের নানা প্রান্তের স্বদেশী শিল্প সামগ্রী সংগ্রহ করে তার প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা করা।
মেলার বিবরন ও বৈশিষ্ট্য
- ১৮৬৭ খ্রিঃ থেকে ১৮৮০ খ্রিঃ পর্যন্ত প্রত্যেক বছর নিয়ম করে হিন্দুমেলার অধিবেশন বসতো।
- হিন্দু মেলার প্রথম অধিবেশনটি ছিলো স্বপ্ন। এটি বসেছিলো চৈত্রসংক্রান্তির দিন চিৎপুরের রাজা নরসিংহ রায়ের বাগানবাড়ীতে।
- মেলার কাজ প্রকৃতপক্ষে আরম্ভ হয় এর দ্বিতীয় অধিবেশন থেকে। এই সময় মেলার প্রধান সম্পাদক গনেন্দ্রনাথ ঠাকুর মেলার প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা তুলে ধরেন। মেলার উদ্বোধন ঘটে ভারতের প্রথম সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা - "মিলে সবে ভারত সন্তান, একতান মনপ্রান, গাও ভারতের যশোগান" সঙ্গীতটির মধ্য দিয়ে।
- প্রথম ৩ বছর মেলা বসেছিলো চৈত্রসংক্রান্তির দিন। পরে মাঘ সংক্রান্ত তে মেলা বসেছিলো। তবে ১৮৭৮ খ্রিঃ থেকে সরস্বতী পুজোর সময় মেলা বসেছিলো। ১৮৮০ খ্রিঃ হিন্দুমেলা শেষবারের মতো বসেছিলো।
- হিন্দুমেলায় জাতীয়তাবাদী সঙ্গীত ও প্রবন্ধ পাঠ করা হতো। সংস্কৃত এবং বাংলা ভাষায় উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ লেখকদের পুরস্কৃত করা হতো।
- প্রদর্শনী ছিলো এই মেলার একটি বিরাট আকর্ষণ। চারু ও কারু শিল্প বিশেষত, মেয়েদের তৈরি সেলাইয়ের কাজ, কৃষিজ দ্রব্য, চরখা, তাঁত এবং দেশীয় বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত নানা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি মেলায় প্রদর্শিত হতো।
- এছাড়াও, মেলাতে মল্লযুদ্ধ, শারীরিক কসরতের নানা কারসাজি, ব্যায়াম, লাঠিখেলা ইত্যাদি প্রদর্শিত হতো।প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই যারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন, তাদের পুরস্কৃত করা হতো।
মেলার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ
(১.) ন্যাশনাল সোসাইটি গঠন
- হিন্দুমেলার চতুর্থ অধিবেশনের পর বাৎসরিক মেলা পরিচালনার জন্য নবগোপাল মিত্র "ন্যাশনাল সোসাইটি" বা "জাতীয় সভা"প্রতিষ্ঠা করেন।
- প্রত্যেক মাসে একবার করে এর অধিবেশন বসতো এবং মেলায় প্রদর্শিত বিষয় গুলির অনুশীলন চলতো। সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি নানা বিষয়ে এখানে বক্তিতা ও আলোচনা চলতো।
- ন্যাশনাল সোসাইটি গঠিত হবার পর থেকে এই সোসাইটির নেতৃত্বেই হিন্দুমেলা সংগঠিত হতে আরম্ভ করে।
(২.) ন্যাশনাল স্কুল প্রতিষ্ঠা
- এখানে আরো একটি কথা বলা প্রয়োজন, হিন্দুমেলায় শরীরচর্চা সহ চারু ও কারু শিল্পের প্রদর্শনীর জন্য এতদিন পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন ভাবে বিষয় গুলির চর্চা ও অনুশীলন চলতো।
- দেশীয় অগ্রগতির দিশারী এই বিষয় গুলিকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য নবগোপাল মিত্র ১৮৭২ খ্রিঃ ১৩ নং কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে একটি "ন্যাশনাল স্কুল" বা জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
- ছবি আঁকা, গান, ইঞ্জিনিয়ারিং, উদ্ভিদবিদ্যার চর্চা, শরীরচর্চা, বন্দুকচালনা ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ের শিক্ষা ন্যাশনাল স্কুলে প্রদান করা হতো।
- সমকালীন সময়ের বহু বিখ্যাত ব্যক্তি ন্যাশনাল স্কুলে পড়তে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই জিতেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, বিখ্যাত বাগ্মী বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ।
(৩.) ন্যাশনাল পেপার
হিন্দুমেলার পতন
- হিন্দুমেলা শরীরচর্চা ও সংস্কৃতি চর্চার গন্ডির মধ্যেই আবদ্ধ ছিলো। রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে এই মেলা দূরেই ছিলো। ফলতঃ উনিশ শতকের শেষদিকে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটলে, তার চাহিদা হিন্দুমেলা পূরন করতে পারে নি। এছাড়া,
- উনিশ শতকের শেষদিকে একাধিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিলো। ১৮৭৫ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয় "ইন্ডিয়া লিগ"। ১৮৭৬ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয় "ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন" বা ভারত সভা। এইসব প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক উদ্দীপনার যে নতুন স্বাদ শিক্ষিত সম্প্রদায় পেতে শুরু করেছিলো, হিন্দুমেলায় তার অভাব ছিলো।
হিন্দুমেলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
- হিন্দুমেলা সমস্ত বিভেদ ও বৈষম্যকে দূরে সরিয়ে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শিক্ষা দেয়।
- এই মেলা দেশবাসীকে পরনির্ভরশীলতা ও হীনমন্যতা দূর করে স্বদেশী চেতনার জাগরন ঘটায়।
- আত্মনির্ভর জাতি নির্মানের জন্য হিন্দুমেলা জাতিকে স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভর হওয়ার শিক্ষা দেয়। হিন্দুমেলার এই শিক্ষা পরবর্তীকালের জাতীয় আন্দোলন গুলিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
- হিন্দুমেলার গ্রামীন অর্থনীতির বিকাশ, স্বদেশী ভাবধারার সঙ্গীত ও সংস্কৃতি চর্চা - দেশীয় ঐতিহ্যের পুনঃজাগরন ঘটিয়ে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটাতে প্রভূত সাহায্য করে।
- সর্বোপরি, ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজদের ভীরু, দুর্বল, কাপুরুষ সম্বোধনের যোগ্য প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্য হিন্দুমেলা শরীরচর্চা, ব্যায়াম ও শারীরিক নানা কসরতের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী জাতি নির্মানের আদর্শ স্থাপন করে।
- এই আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ভারতের প্রথম গুপ্ত সমিতি "অনুশীলন সমিতি" গড়ে উঠেছিলো।আর অনুশীলন সমিতির মধ্য দিয়েই প্রথম ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের অভিষেক হয়েছিলো।