বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাকে কেন ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয়?

 উনিশ শতকে ভারতে একাধিক সভা সমিতি গড়ে উঠেছিলো। এই সব সভা সমিতি গুলির মধ্যে প্রথম রাজনৈতিক  সভা বা প্রতিষ্ঠান ছিলো - "বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা"।  

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাকে কেন ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয়?
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাকে কেন ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয়? 

প্রতিষ্ঠা

১৮৩৬ খ্রিঃ ৮ ই ডিসেম্বর, টাকির জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরী, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, হরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।

  • এই সভার প্রথম সভাপতি ছিলেন - গৌরিশংকর তর্কবাগীশ/ভট্টাচার্য। এবং 
  • প্রথম সম্পাদক ছিলেন - পন্ডিত দুর্গাপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন

প্রেক্ষাপট

"বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা"র নাম থেকেই বোঝা যায়, এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার চর্চা ও তার স্বার্থ রক্ষা করা একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো।

দীর্ঘ প্রাচ্য পাশ্চাত্য বিতর্কের পর ১৮৩৫ খ্রিঃ মেকলের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে ভারতীয় ভাষা গুলির গুরুত্বকে উপেক্ষা করে ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বেন্টিঙ্ক মেকলের প্রতিবেদনকে সরকারি স্বীকৃতি জানান এবং ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা দানের ওপর সরকারি ঘোষনা করেন।

১৯৩৫ খ্রিঃ সরকারি স্তরে ইংরেজি ভাষায় গুরুত্ব আরোপে বাংলাভাষীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ইংরেজী ভাষার প্রাবল্যে যাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা কোনমতেই উপেক্ষিত না হয়ে পড়ে সেই জন্যই ১৮৩৫ এর ঠিক পরের বছরই ১৮৩৬ খ্রিঃ "বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা" প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো

মনে রাখতে হবে, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলাতে বেশ কিছু সংবাদপত্রও প্রকাশিত হয়ে আসছিলো। এইসব বাংলা সংবাদপত্র গুলির অস্তিত্ব, উৎকর্ষতা এবং জনপ্রিয়তা বাংলা ভাষার চর্চা ও গ্রহণযোগ্যতার ওপরেই নির্ভরশীল ছিলো। 

এই কারনে দেখা যায়, ইংরেজি ভাষার বিপ্রতীপে বাংলা ভাষার স্বার্থ রক্ষার্থে যে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা গঠিত হয়, তার প্রধান উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সংবাদপত্রের সম্পাদক। উদাহরন হিসাবে সংবাদ পূর্নচন্দ্রোদয় পত্রিকার সম্পাদক হরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এবং সংবাদ ভাস্কর পত্রিকার সম্পাদক গৌরিশংকর তর্কবাগীশের কথা প্রসঙ্গক্রমে আমরা বলতে পারি।

উদ্দেশ্য

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রধান মূল উদ্দেশ্য ছিলো ৩ টি -
  1. বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনুশীলন করা এবং তার স্বার্থ বজায় রাখা।
  2. দেশের পক্ষে হিতকর বিষয় গুলিকে নিয়ে আলাপ আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণ করা। 
  3. সরকারি নীতি ও কাজকর্মের সমালোচনা করা।

বৈশিষ্ট্য

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য গুলি হল - 
  1. প্রত্যেক বৃহস্পতিবার এই সভার অধিবেশন বসতো। পরের দিকে অবশ্য এই দিন পরিবর্তিত হয়েছিলো।
  2. এই সভায় ধর্ম নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ ছিলো। 
  3. প্রধানত ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনার জন্যই এই সভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।
  4. শেষের দিকে এই সভা সরকারের দেশবিরোধী নীতি ও কাজের সমালোচনা করেছিলো।

কর্মসূচি

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা তার সীমিত স্থায়িত্ব কালীন সময়ে দুটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলো -
  1. ১৮২৮ খ্রিঃ আইন অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার নিষ্কর ভূমির ওপর কর আদায় শুরু করলে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা তার তীব্র প্রতিবাদ করে। এছাড়া,
  2. পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ইংরেজি ভাষার প্রসারের সাথে সাথে বাংলা ভাষা শিক্ষা যাতে কোনরকম ভাবে উপেক্ষিত না হয়ে পড়ে, সেইজন্য বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা রাজনৈতিক সচেতনতা বোধের জাগরন ঘটায়।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার বিলুপ্তি ও কৃতিত্ব 

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। প্রধানত দুটি কারন এই সভার দুর্বলতাকে প্রকট করে তুলেছিল -
  1. সদস্যদের মধ্যে ঐক্যের অভাব, এবং
  2. সরকারি নীতি ও সভার সিদ্ধান্তের বিষয় গুলি নিয়ে সদস্যদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিরোধ
এর ফলে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এই সভা ভেঙ্গে পড়েছিলো।কোন উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের স্মারক বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা নির্মান করতে না পারলেও, ইতিহাসে এর কৃতিত্বের মূল দিক ছিলো ২ টি - 
  • ভারতীয়দের রাজনৈতিক চেতনার জাগরনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। 
  • এটি ছিলো ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাকে কেন ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয়? 

যোগেশচন্দ্র বাগল বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাকে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে উল্লেখ করেছিলেন।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাকে অনেক গুলি কারনে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় -
  1. রাজনৈতিক সচেতনতা বোধের জাগরন থেকে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা ১৮৩৬ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয়।
  2. ১৯৩৫ খ্রিঃ মেকলের প্রতিবেদনে ভারতীয় ভাষা গুলির গুরুত্বকে উপেক্ষা করে ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।  মেকলের এই প্রতিবেদন সরকারি স্বীকৃতি লাভ করলে ভারতীয় রক্ষনশীল সমাজে চাঞ্চল্য দেখা যায়। 
  3.  ১৯৩৫ খ্রিঃ সরকারি স্তরে ইংরেজি ভাষায় গুরুত্ব আরোপে বাংলাভাষীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ইংরেজী ভাষার প্রাবল্যে যাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা যাতে কোনমতেই উপেক্ষিত না হয়ে পড়ে সেই জন্যই ১৮৩৫ এর ঠিক পরের বছরই ১৮৩৬ খ্রিঃ "বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা" প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। অর্থাৎ ভারতীয়দের ভাষাগত স্বার্থ রক্ষার রাজনৈতিক সচেতনতাবোধ থেকেই বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার জন্ম হয়। এছাড়া, 
  4. ব্রিটিশদের রাজনৈতিক সংগঠন গুলিতে যেমন রাজনৈতিক বিষয় গুলি নিয়ে যুক্তিতর্ক চলতো তেমনি  বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাতেও যুক্তি তর্কের মধ্য দিয়ে নানা আলোচনা চলতো। 
  5. ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের যে সমস্ত বিষয় গুলির সঙ্গে ভারতীয়দের স্বার্থ জড়িত ছিলো, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা সেইসব বিষয় গুলি নিয়ে আলোচনা করতো।
  6. পূর্বোক্ত সভা সমিতি গুলিতে ধর্মীয় নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাতে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ ছিলো। ব্রিটিশ শাসনে ভারতবাসীর স্বার্থের অনুকূল বিষয় গুলির আলাপ আলোচনার উদ্দেশ্যেই এই সভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। 
  7. ১৮২৮ খ্রিঃ আইন অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার নিষ্কর ভূমির ওপর কর আদায় শুরু করলে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা তার তীব্র প্রতিবাদ করে। 
উপরোক্ত এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য ও রাজনৈতিক প্রবনতা গুলির জন্যই বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাকে ভারতের "প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান" বলা হয়ে থাকে। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post