উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আগে ভারতে যেসব রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠেছিলো, তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য ছিলো - "ভারত সভা" বা "Indian Association"।
ভারতসভা ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় |
প্রতিষ্ঠা
১৮৭৬ খ্রিঃ ২৬ শে জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারত সভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন -
- সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ( যাকে বাংলার "মুকুটহীন রাজা" বলা হতো। "এ নেশন ইন মেকিং" ছিলো তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ।),
- আনন্দমোহন বসু,
- শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ।
প্রথম সভাপতি ও সম্পাদক
- ভারত সভার প্রথম সভাপতি ছিলেন - রেভারেন্ট কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং
- সম্পাদক ছিলেন - আনন্দমোহন বসু।
- "দ্য বেঙ্গলী" পত্রিকা ছিলো এই সভার মুখপত্র।
ভারতসভার বৈশিষ্ট্য
- জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আগে ভারতের সবথেকে প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠন ছিলো ভারতসভা।
- ভারতসভা ছিলো প্রধানত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান।
- এই সভার পরিচালন সদস্যদের ৫৪ % কর্মকর্তাই ছিলেন ব্রাহ্ম। ব্রাহ্মরা ছাড়াও উকিল, ব্যারিস্টার, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক প্রভৃতি পেশার মানুষরা এই সভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
- পূর্ববর্তী সভা সমিতি গুলিতে জমিদারদের ব্যপক প্রভাব ছিলো। কিন্তু ভারত সভায় জমিদারদের কোন প্রভাব ছিলো না।
- এই প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক চাঁদার হার ছিলো ৫ টাকা এবং কৃষক সদস্যদের চাঁদা ছিলো ১ টাকা।
- ভারতসভা কলকাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। কলকাতার বাইরে গ্রামাঞ্চলে ১২৪ টি জায়গায় এর শাখা ছিলো।
- এছাড়া বাংলার বাইরে ভারতের অন্যান্য প্রদেশে বিশেষত লখনৌ, মিরাট, লাহোর প্রভৃতি স্থানে এই সভার শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। অর্থাৎ ১৮৮৫ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারতের সবথেকে বড়ো রাজনৈতিক সংগঠন ছিলো "ভারতসভা"।
ভারতসভার উদ্দেশ্য
৪ টি মূল উদ্দেশ্যকে পূরনের লক্ষ্যে ভারতসভার প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। যথা -
- দেশে শক্তিশালী জনমত গঠন করা,
- ভারতের বিভিন্ন জাতি ও মতালম্বী গোষ্ঠি গুলিকে রাজনৈতিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ করা,
- হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে ঐক্যবোধ গঠন করা,
- জনসাধারণকে গন আন্দোলনে সামিল করা।
ভারতসভার কর্মসূচি
(ভারতসভার আন্দোলনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা)
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ভারতসভার প্রানপুরুষ। তার হাত ধরেই ১৮৭৬ খ্রিঃ ২৬ শে জুলাই "ভারত সভা" প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতালির ঐক্য আন্দোলনের পুরোধা যোশেফ মাৎসিনির "ইয়ং ইতালির" মতো ভারতীয়দের রাজনৈতিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ করবার উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি "ভারতসভার" প্রতিষ্ঠা করেন।
তার সুদক্ষ নেতৃত্ব ভারতসভা প্রাক্ কংগ্রেস পর্বে -
- ভারতের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহত্তম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে এবং
- ভারতীয়দের রাজনৈতিক আশা আকাঙ্খা পূরনের একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেশবাসীর কাছে স্বীকৃতি লাভ করে।
সংক্ষেপে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গৃহীত ভারতসভার মূল কর্মসূচি ও আন্দোলনের পরিচয় আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) আদর্শ ও সংগঠনের বিস্তার
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য শক্তিশালী সংগঠন এবং তার ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক ভাবে ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ করার কথা প্রথম চিন্তা ভাবনা করেন। এইজন্য তিনি -
- সারা ভারতে পরিভ্রমন করে ভারতসভার মূল লক্ষ্য ও আদর্শ প্রচার করেন।
- তাঁর অসাধারণ বাগ্মীতা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে বাংলার গ্রামাঞ্চলে ভারতসভার ১২৪ টি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং
- বাংলার বাইরে উত্তর প্রদেশে, বোম্বাই ও মাদ্রাজে অনেক গুলি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।
(২.) কৃষক সমস্যার সমাধান
সভা সমিতি যুগের প্রতিষ্ঠান গুলির মধ্যে ভারতসভা একমাত্র ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান ছিলো, যারা প্রথম এদেশের কৃষকদের সমস্যার কথা যথার্থ ভাবে উপলব্ধি করতে এবং কার্যকরী পদক্ষেপ করতে সক্ষম হয়।
- ভারতসভা বাংলার নানা স্থানে "কৃষক সভা" প্রতিষ্ঠা করে জমিদারদের অত্যাচার থেকে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করে। এছাড়া,
- ১৮৮৪ খ্রিঃ প্রজাস্বত্ব আইনটিরও এই সভা বিরোধীতা করেছিলো।
(৩.) সরকারি নীতির সমালোচনা
- ভারতসভা সরকারের নানা জনবিরোধী নীতিরও সমালোচনা ও বিরোধীতা করে।
- সরকারের বৈষম্যমূলক শুল্ক আইন, সম্পদের নিষ্কাশন, এবং আসামের চা কুলিদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করে ভারতসভা।
(৪.) সিভিল সার্ভিসের জন্য আন্দোলন
- ১৮৭৬ খ্রিঃ (লর্ড লিটন) ব্রিটিশ সরকার সিভিল সার্ভিসে ভারতীয় পরিক্ষার্থীদের বয়স ২১ থেকে কমিয়ে ১৯ করে দিলে ভারতসভা তার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করে।
- সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই সময় আইন সংশোধনের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিখ্যাত বাগ্মী লালমোহন ঘোষকে পাঠান।
(৫.) দমনমূলক আইনের প্রতিবাদ
১৮৭৮ খ্রিঃ লর্ড লিটন "ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট" (মাতৃভাষা সংবাদপত্র আইন) ও "অস্ত্র আইন" এনে ভারতীয়দের বাক স্বাধীনতা হরন করতে এবং তাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলে ভারতসভা তার বিরুদ্ধেও তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
(৬.) ইলবার্ট বিল আন্দোলন
লর্ড রিপন তার শাসনকালের কালে (১৮৮৩ খ্রিঃ) ইলবার্ট বিল এনে বিচার ব্যবস্থায় ভারতীয় ও ইওরোপীয়দের মধ্যে বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করলে, ইওরোপীয়রা এর তীব্র বিরোধিতা করে। এই সময় ভারতসভা এই বিলের স্বপক্ষে জোরালো আন্দোলন ও জনমত গঠন করে।
(৭.) সর্বভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের ডাক
ভারতসভার আন্দোলন ও এর একাধিক ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা থেকে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় উপলব্ধি করেন, সর্বভারতীয় কোন প্রতিষ্ঠান ছাড়া সরকারের বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী প্রতিরোধ বা সংগ্রাম পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
এই কারনে ১৮৮৩ খ্রিঃ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এবং ভারতসভার উদ্যোগে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে "সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন" আহ্বান করা হয়। এই সম্মেলনের আদর্শ ও গৃহীত প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ১৮৮৫ খ্রিঃ ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৬ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে ভারতসভা জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে যায়।
ভারতসভার গুরুত্ব
ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে ভারতসভার গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। সংক্ষেপে গুরুত্বের দিক গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
- ভারতসভা ছিলো প্রাক্ কংগ্রেস যুগের ভারতবর্ষের সবথেকে বৃহত্তম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
- ভারতসভাই প্রথম বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ভারতের সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষকে এক ছাতার তলায় ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়।
- কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী - সমাজের সকল স্তরের মানুষদের সমস্যা নিয়ে ভারতসভা আন্দোলন করে বুঝিয়ে দেয়, একমাত্র ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং দাবি আদায় সম্ভব।এই শিক্ষা পরবর্তীকালে জাতীয় কংগ্রেসকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো।
- সর্বোপরি, ভারতসভার আদর্শ ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়। অনেকে তাই ভারতসভা কে "জাতীয় কংগ্রেসের মহড়া" বলেও অভিহিত করে থাকেন।