জাতীয়তাবাদের বিকাশে বর্তমান ভারতের অবদান

পরাধীন ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষে "বর্তমান ভারত" গ্রন্থটি নানা ভাবে সাহায্য করেছিলো। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিবেকানন্দ এই গ্রন্থে ভারতের প্রায় দশ হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করেছিলেন। এই ইতিহাস পর্যালোচনায় স্বামীজি যে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বকীয় চিন্তাধারার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা সত্যিই ছিলো বিস্ময়কর।

জাতীয়তাবাদের বিকাশে "বর্তমান ভারত"
জাতীয়তাবাদের বিকাশে "বর্তমান ভারত" 

ইতিহাসের বিশ্লেষন

ভারত ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে স্বামীজি দেখিয়েছেন, ইতিহাস শ্রেনী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। তাঁর মতে, পৃথিবীর সর্বত্রই ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র - এই চারটি বর্ন পর্যায় ক্রমে পৃথিবী শাসন করবে।

  • ভারতে বৈদিক যুগ থেকে প্রাক্ বৌদ্ধ যুগ পর্যন্ত ছিলো ব্রাহ্মনদের শাসন
  • বৌদ্ধযুগ থেকে মুঘল যুগ পর্যন্ত ভারতে চলেছিলো ক্ষত্রিয়দের শাসন
  • মুঘল যুগের শেষে ভারত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিনস্ত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে ভারতে শুরু হয়েছে বৈশ্যদের শাসন
  • বৈশ্যদের শাসনের অবসানের পরেই আসবে শূদ্রদের শাসন

বর্তমান ভারত ও জাতীয়তাবাদ

"বর্তমান ভারত" গ্রন্থটিতে স্বামীজি ভারতের ইতিহাসের বিশ্লেষন করে এমন কিছু ঐতিহাসিক সত্যের অবতারনা করেন, যা বিশ শতকে বর্তমান ভারতের পরাধীন জাতিকে (১.)নতুন আশা, (২.)প্রানশক্তি এবং (৩.)জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে।


(১.) শূদ্র জাগরনের ভবিষৎ বানী

স্বামীজি ভারতের ইতিহাসের বিশ্লেষন করে দেখিয়েছেন, ভারতে ব্রাহ্মন ও ক্ষত্রিয়দের শাসন শেষ হয়ে গেছে। বৈশ্য শক্তি ইংরেজদের শাসনও অল্প কিছুদিন পরে শেষ হবে। এর পর ঐতিহাসিক নিয়মে অবধারিত ভাবেই শুরু হবে শূদ্রদের শাসন। বলা বাহুল্য, শূদ্র বলতে স্বামীজি এখানে কোন বিশেষ জাতি বা সম্প্রদায়কে বোঝান নি।

 "শূদ্র" বলতে এখানে তিনি কুলহীন সর্বহারা সাধারন মানুষ বা জনতাকে বুঝিয়েছেন। স্বামীজির ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের এই ভবিষ্যৎ বানী পরাধীন সর্বহারা ভারতীয়দের হীনমন্যতা কাটিয়ে নতুন আশা ও চেতনায় উদ্দীপিত করে তোলে।

(২.) সামাজিক সংহতির আহ্বান

অতীত ইতিহাসের বিশ্লেষন করে স্বামীজি দেখিয়েছেন, সামাজিক সংহতি না থাকায় ভারত বারবার বৈদেশিক আক্রমণ এবং স্বৈরাচারী শাসনের কবলে পড়েছে। সামাজিক সংহতির জন্য তাই স্বামীজি জাতিগত বৈষম্যের অবসানের ডাক দিয়ে শূদ্র, মুচি, মেথর, অজ্ঞ, সকল দেশবাসীকে আপন করে নিতে বলেছেন। 

(৩.) জাতিগত বিদ্বেষের প্রতিবাদ

স্বামীজি জানতেন, জাতিগত বিদ্বেষই জাতীয়তাবাদের পথে সবথেকে বড়ো বাধা। তাই তিনি বর্তমান ভারতে জাতিগত বিদ্বেষের প্রবল সমালোচনা করে লেখেন - 

ইংরেজরা ভারতীয়দের ওপর জাতিগত বিদ্বেষ দেখায় বলে আমাদের রাগ হয়। কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যে কি কম জাতিগত বিদ্বেষ আছে? আজ যদি পুনরায় ব্রাহ্মনের শাসন আরম্ভ হয়, তাহলে শূদ্রদের জিভ ছিড়ে নেওয়া হবে না, একথা কে বলতে পারে? স্বামীজি তাই বর্তমান ভারতে ভারতীয়দের সামাজিক দূর্বলতা ও বিভেদ গুলি দূর করার আহ্বান জানান। 

(৪.) অন্ধ বিদেশী অনুকরনের সমালোচনা

উনিশ শতকে আমাদের দেশের একদল লোক ইংরেজদের অন্ধ অনুকরন করে তাদের বংশবদে পরিনত হয়ে যান। বর্তমান ভারত গ্রন্থে স্বামীজি ভারতীয়দের এই অন্ধ অনুকরন প্রিয়তার নিন্দা করেন। তিনি বলেছেন - 

ব্যাঘ্র চর্ম পরিধান করলেই ব্যাঘ্র হয়ে ওঠা যায় না। শ্রেষ্ঠত্বের উন্নীত হবার জন্য প্রয়োজন আত্মশক্তি অর্জনের। 

(৫.) আত্মশক্তির বানী 

স্বামীজি বর্তমান ভারত গ্রন্থে ভারতের অতীত ইতিহাস থেকে আত্মশক্তি অর্জনের রসদ সংগ্রহ করেছেন। ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যকে স্মরন করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন - 

"হে ভারত, এই পরানুবাদ, পরানুকরন, পরমুখাপেক্ষা.... দাসসুলভ দূর্বলতা। হে ভারত ভুলিও না তোমার নারী জাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তি, ভুলিও না তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শঙ্কর। ভুলিও না, তোমার ধন, তোমার জীবন... ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে... ভুলিও না তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত"। 

(৬.) জনজাগরনের মন্ত্র 

স্বামীজি দশ হাজার বছরের ভারতের ইতিহাসের সমীক্ষা করে সিদ্ধান্তে এসেছেন, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পরেও ভারত একটি শক্তিশালী জাতি হয়ে ওঠে নি। ভারতে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র বা শাসনেরও জন্ম হয় নি। এর একমাত্র কারন হলো প্রজাপুঞ্জের ঐক্যের অভাব। 

পাশ্চাত্যের যে দেশ গুলি আজ শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে, সেইসব দেশগুলির শাসনভার সেখানকার প্রজাদের হাতেই ন্যাস্ত আছে। সেখানে শাসিতরাই নিজেদের শাসন করছে। কিন্তু ভারতে তার একান্তই অভাব। এইজন্য সবার প্রথমে প্রয়োজন "জনজাগরনের"। 

জনজাগরনের জন্য স্বামীজি বর্তমান ভারতে সমস্ত রকমের জাতিগত, লিঙ্গগত বৈষম্যকে দূরে সরিয়ে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হবার ডাক দেন। তার মতে ঐক্যবদ্ধ প্রজাপুঞ্জ ও জনজাগরন একটি শক্তি। এই শক্তি অর্জনের মধ্য দিয়েই ভারত তার পরাধীনতা থেকে মুক্তি লাভ করবে। 

তার ভবিষ্যৎ বানী শেষপর্যন্ত সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো। ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ জনজাগরনের ফলেই শেষ পর্যন্ত ভারত স্বাধীনতা লাভে সমর্থ হয়। 

মূল্যায়ন 

এইভাবে দেখা যায়, অতীত ইতিহাসের প্রেক্ষিতে স্বামী বিবেকানন্দের "বর্তমান ভারত" এর বিশ্লেষন - 
  • ভারতীয়দের নানা ভাবে আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।
  •  উনিশ শতকে পরাধীনতার অপমানে নুহ্যমান দেশবাসীর মনে নতুন আশা ও চেতনার সঞ্চার করে। 
  • ভারতীয়দের হাজার বছরের দূর্বলতা গুলিকে দূর করে ভারতীয়দের একটি শক্তিশালী জাতি হিসাবে গড়ে উঠতে আহ্বান জানায়।
  •  সর্বোপরি এই গ্রন্থে স্বামীজি ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদের প্রকৃত সংজ্ঞা ও তার অর্থের কথা বুঝিয়ে দেন। তাঁর মতে, মানুষকে উপেক্ষা করে কখনই কোন দেশের জাতীয়তাবাদ সফলতা লাভ করতে পারে না। জাতীয়তাবাদের প্রধান শর্ত হলো সংঘবদ্ধ সমাজ ও মানবপ্রেম। 
  • তাঁর মতে মানবপ্রেম ও স্বদেশ প্রেমের সমন্বিত রূপেই আত্মপ্রকাশ করে প্রকৃত জাতীয়তাবাদ। ঐতিহাসিক আর জি প্রধান এইজন্য যথার্থ অর্থেই স্বামী বিবেকানন্দকে "আধুনিক ভারতের জাতীয়তাবাদের জনক" বলে অভিহিত করেছেন।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post