স্বামী বিবেকানন্দের "বর্তমান ভারতের" সংক্ষিপ্তসার

 "বর্তমান ভারত" প্রবন্ধটিতে স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের দশ হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করেছিলেন। প্রথমেই তিনি বৈদিক যুগ থেকে মুঘল যুগ পর্যন্ত ভারতের ইতিহাসের ক্রমবিবর্তন আলোচনা করেছেন। এরপর ভারতের ব্রিটিশ শাসনের বিষয়টিকে অবতারনা করেছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দের বর্তমান ভারতের সংক্ষিপ্তসার
স্বামী বিবেকানন্দের বর্তমান ভারতের সংক্ষিপ্তসার

মূল আলোচ্য বিষয়বস্তু

সমগ্র প্রবন্ধটিতে তিনি -

  1. ব্রাহ্মন্য শক্তির উদ্ভব,
  2. রাজশক্তির উদ্ভব, 
  3. রাজশক্তির সঙ্গে প্রজা শক্তির তুলনা,
  4. প্রাচীন ভারতে স্বায়ত্ত্বশাসন ও প্রজাতন্ত্রের অস্তিত্ব, 
  5. ভারতের শাসন পদ্ধতির দোষ গুন,
  6. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিরোধ,
  7. স্বদেশ মন্ত্র ও দেশপ্রেম নিয়ে আলোচনা করেছেন।
মনে রাখতে হবে, বর্তমান ভারত একটি দার্শনিক গ্রন্থ/প্রবন্ধ ছিলো। এর ভাষা ও ভাব দুইই অত্যন্ত জটিল ও দুর্বোধ্য। তা সত্ত্বেও, আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি ও সীমিত জ্ঞানে এই মহাগ্রন্থটি পাঠ করে যতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি, সেটাই খুব সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরবো। 

বর্তমান ভারত গ্রন্থটি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক ইতিহাসের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একটাই, যাতে এই প্রবন্ধটির মূল বিষয়বস্তু এবং তার মূল নির্যাসের ঘ্রাণ অন্তত কিছুটা হলেও প্রিয় ছাত্র ছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। আশা করছি,পাঠ্যপুস্তকের সীমাবদ্ধ লেখনীর বাইরে এই লেখাটি থেকে কিছু নতুন তথ্য ও ধারনা লাভ করে ছাত্র ছাত্রীরা সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারবে।

বৈদিক যুগ - পুরোহিত শক্তির উত্থানের যুগ 

বর্তমান ভারত এ স্বামী বিবেকানন্দ তার ইতিহাস পর্যালোচনা শুরু করেছেন বৈদিক যুগ থেকে। কারন তখনও সিদ্ধু সভ্যতার আবিষ্কার হয় নি, এবং মনে করা হতো বৈদিক যুগ থেকেই ভারতীয় সভ্যতার সূচনা ঘটেছিলো। স্বামীজি লিখেছেন - বৈদিক যুগ একান্তই ছিলো পুরোহিতদের যুগ

বৈদিক যুগের পুরোহিতরা মন্ত্রবলে বলীয়ান ছিলেন। এইসময় রাজা এবং দেবতা দুজনেই পুরোহিতদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। দেবতারা এসময় ব্রাহ্মনদের দেয় ভোগের আহুতি থেকে শক্তি লাভ করতেন। অন্যদিকে পুরোহিতরা রাজাকে পরামর্শ, বুদ্ধি ও কূটনীতি প্রদান করে রাজার শক্তি বৃদ্ধি করতেন। ভারতের ইতিহাসের প্রথম পর্বের যুগ ছিলো তাই পুরোহিতদের উত্থান ও আধিপত্যের যুগ। মস্তিষ্ক প্রসূত জ্ঞানে বলীয়ান পুরোহিতরা এইসময় নানা ভাবে রাজশক্তিকে নিয়ন্ত্রন করতেন।

বৈদিক যুগের রাজারা তাই সবসময় পুরোহিতদের সন্তুষ্ট করবার জন্য চেষ্টা করতেন। পুরোহিতরাও তাই ধনবর্ষনকারী বৃহৎ অশ্বমেধ যজ্ঞকারী রাজাদেরই কৃপা করতেন। দেবনাম প্রিয় রাজা অশোক যতই মহান ও প্রজাদরদি হউন না কেন, যেহুতু তিনি পুরোহিতদের সন্তুষ্ট করেন নি, তাই তিনি পুরোহিতদের কাছে ছিলেন নামমাত্র একজন তুচ্ছ রাজা।

 বিবেকানন্দ তাই লিখেছেন - "অশ্বমেধ যজ্ঞকারী বর্ষার বারিদের মতো ধনবর্ষনকারী রাজাদের নামই পুরোহিত প্রাসাদে জাজ্বল্যমান। দেবতাগনের প্রিয় প্রিয়দর্শি ধম্মশোক ব্রাহ্মন্য জগতে নামমাত্রই একজন রাজা"।

বৈদিক যুগের রাজারা তাই ধীরে ধীরে নিজেদের ভোগ বিলাস বৃদ্ধির জন্য, রাজ্য রক্ষার জন্য এবং নিজেদের আত্মীয় স্বজন তথা পুরোহিতদের তুষ্টির জন্য প্রজাদের শোষন করতে থাকলেন। বৈশ্যরা হয়ে উঠলো রাজার খাদ্য এবং তার দুগ্ধবতী গাভী। কারন এই বৈশ্যরাই রাজাকে যাবতীয় কর প্রদান করেন। তাদের টাকার ওপরেই রাজার শ্রীবৃদ্ধি নির্ভর করে।

রাজতন্ত্র ও প্রজাতান্ত্র সম্পর্কে স্বামীজির মত 

ভারতে রাজশক্তির কথা বলতে গিয়ে বিবেকানন্দ বলেন, ভারতবর্ষ সুদীর্ঘকাল রাজতন্ত্রের অধীনে থাকলেও, ভারতে প্রজা কল্যানকামী রাজার সংখ্যা খুবই অল্প। রামচন্দ্র, অশোক, আকবরের মতো তারা অল্পই জন্মান।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিবেকানন্দ রাজতন্ত্রকে পছন্দ করেন নি। তার মতে, "রাজা যতই কীর্তিমান হউনা কেন, মহাসমুদ্রে শিশির বিন্দুপাতের ন্যায় কালসমুদ্রে তাহার যশঃসূর্য চিরদিন অস্তমিত।" তিনি আরও বলেছেন, রাজা যত বড়োই হউন আর শ্রেষ্ঠ হউন, সর্বদায় শিশুর ন্যায় পালিত হইলে অতি বলিষ্ঠ যুবাও দীর্ঘকায় শিশু হইয়া যায়। দেবতুল্য রাজা দ্বারা সর্বতোভাবে পালিত প্রজা কখনও স্বায়ত্ত্বশাসন শিখে না। রাজার মুখাপেক্ষী হয়ে নিবীর্য ও নিঃশক্তি হইয়া যায়। "

স্বাভাবিক ভাবেই বিবেকানন্দ" বর্তমান ভারতে" গুনবান ও শ্রেষ্ঠ রাজশক্তির চাইতে সচেতন ও সজাগ প্রজা শক্তি কামনা করেছেন। তার মতে, সম্মিলিত প্রজাশক্তিই পারে অত্যাচারী শাসনের অবসান ঘটাতে। বর্তমান আমেরিকাতে এই প্রজা শক্তির জাগরন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেখানে শাসিতরাই নিজেদের শাসন করছে। সেখানে জনগনের দ্বারা জনগনের জন্য জনগনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 

কিন্তু এইরকম গনতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি অতীতে ভারতবর্ষে যে একেবারেই ছিলো না এমন নয়। বৌদ্ধ গ্রন্থে ভারতের কিছু প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে খ্রিঃ পূর্ব ষষ্ঠ শতকে ষোড়শ মহাজনপদের কথা আমরা স্মরন করতে পারি। ঐসময় ভারতে ১৬ টি ছোট ছোট রাজ্য গড়ে উঠেছিলো। এর মধ্যে বজ্জি ও মল্ল রাজ্যদুটি ছিলো প্রজাতান্ত্রিক। 

স্বামীজি আক্ষেপ করে লিখেছেন, প্রাচীন ভারতে প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠলেও, প্রজাতান্ত্রিক ধ্যান ধারনা পঞ্চায়েতি রাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেলো। বৃহত্তর সমাজে গনতান্ত্রিক ধ্যান ধারনার কোন প্রসার ঘটলো না। প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন ভারতে গনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য কিছু কিছু গড়ে উঠলেও তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে পড়ে। 

বৌদ্ধ যুগ - রাজশক্তির বিকাশের যুগ

যাইহোক, বৈদিক যুগের পরে বৌদ্ধ যুগের প্লাবন আসে। এই যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো - পুরোহিত শক্তির ক্ষয় এবং রাজশক্তির বিকাশ। মনে রাখতে হবে, বৌদ্ধ যুগের পুরোহিতরা ছিলেন সর্বত্যাগী মঠাশ্রয়ী এবং সাংসারিক জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ও উদাসীন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বৈদিক যুগের পুরোহিতদের মতো বৈষয়িক কারনে রাজশক্তিকে নিজেদের অনুশাসন, নির্দেশ বা আদেশে পদানত করে রাখবার কোন ইচ্ছা বৌদ্ধ পুরোহিতদের ছিলো না। 

এই কারনে বৌদ্ধ যুগে রাজশক্তি পুরোহিতদের নিয়ন্ত্রন থেকে মুক্ত হয়ে দুর্বার হয়ে উঠলো। স্বাভাবিক নিয়মেই এই সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের বদলে বড়ো বড়ো রাজ্য বা সাম্রাজ্য গড়ে উঠতে আরম্ভ করলো। 

রাজপুত যুগ - পুরোহিত শক্তি ও রাজশক্তির সহাবস্থান 

বৌদ্ধ যুগের শেষদিকে আধুনিক হিন্দুধর্ম রাজপুত জাতির উত্থান ঘটে। এই সময় অখন্ড রাজশক্তির বদলে অনেক গুলি ছোট ছোট রাজ্যখন্ডে ভারত বিভক্ত হয়ে যায়। বৈদিক যুগ থেকে বৌদ্ধ যুগ পর্যন্ত ভারতে পুরোহিত শক্তি বনাম রাজশক্তির মধ্যে ক্ষমতা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্ব চলেছিলো। বৈদিক যুগে ব্রাহ্মন শক্তি ছিলো সবার ওপরে এবং তা রাজশক্তিকে নিয়ন্ত্রন করতো। বৌদ্ধ যুগে ব্রাহ্মন শক্তি নীচে নেমে আসে এবং ওপরে উঠে আসে ক্ষত্রিয় শক্তি। 

ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে ব্রাহ্মন্য শক্তির সঙ্গে ক্ষত্রিয় শক্তির যে দ্বন্দ্ব চলেছিলো বৌদ্ধ যুগের শেষে রাজপুত যুগে এসে তার অবসান হয়। পুরোহিত শক্তি এবং রাজশক্তি এইসময় পরস্পরের সহায়ক হয়ে ওঠে। এই বন্ধন বা মিলন সম্ভব হয়েছিলো পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার তাগিদে। 

এইসময় রাজশক্তি ও পুরোহিত শক্তি (বৈদিক পুরোহিত শক্তি) বৌদ্ধ বংশের সমূল উৎপাটনে তার যাবতীয় অবশিষ্ট শক্তি নিঃশেষ করে ফেলে। এইসময় প্রজাপীড়ন ও শোষন চালিয়ে রাজারা পুরোহিতদের তুষ্টি বিধান করতে থাকলেন। বড়ো বড়ো রাজসূয় যজ্ঞ করে নিজেদের খাঁটি হিন্দু প্রমান করার চেষ্টা করতে থাকলেন। সমাজে ও প্রশাসনে চাটুকার লোকেদের প্রার্দুভাব বাড়লো। সর্বোপরি, হিন্দু ধর্ম নানা তন্ত্র মন্ত্র ও আচার বিচারের জালে জড়িয়ে পড়ে "পশ্চিম দেশাগত মুসলমান ব্যাধনিচক্ষের সুলভ মৃগয়ায় পরিনত হল।" 

মুসলিম যুগ -  রাজশক্তির চূড়ান্ত বিকাশ 

মধ্যএশিয়া থেকে মুসলিম আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে শুরু হয় মুসলিম যুগ। মুসলমান রাজত্বের পুরোহিত শক্তি তার ক্ষমতা ও প্রভাব দুই হারালেন। মুসলমান রাজত্বে স্বয়ং রাজাই পুরোহিত। তিনি একাধারে ধর্মগুরু ও সম্রাট। 

স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিম যুগে ধর্ম শাস্ত্রের বদলে কোরানই হয়ে উঠলো দন্ডনীতি। সংস্কৃত ভাষার বদলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো পার্সি ও আরবি। সংস্কৃত ভাষার গুরুত্ব শুধু থেকে গেলো ধর্মকর্মাদির অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য। এ যুগে পুরোহিত শক্তি বিবাহ প্রদান, দান গ্রহন ও পুজা আর্চা করেই কোনরকমে অপরের দান ও দয়ায় বেঁচে থাকে। মূর্তিপুজাকারী হিন্দুরা এযুগে "কাফের" নামে অভিহিত হয় এবং এই যুগের শেষে সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হয়। 

বৈদিক যুগ থেকে মুঘল যুগ পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস সমীক্ষা করে বিবেকানন্দ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন - 
  1. ঋকবৈদিক ও পরবর্তী বৈদিক যুগে পুরোহিত শক্তির পিষনে রাজশক্তির উত্থান ঘটতে পারে নি। 
  2. বৌদ্ধ যুগে ব্রাহ্মন্য শক্তির বিনাশের সাথে সাথে রাজশক্তির উত্থান ঘটে। 
  3. বৌদ্ধ যুগের বিনাশ ও মুসলমান যুগের সূচনার মধ্যবর্তীকালে রাজপুত জাতির সাহায্যে পুরোহিত শক্তি নবজীবনের অর্থাৎ নিজেদের উত্থানের চেষ্টা করেছিলো। 
  4. পদদলিত পুরোহিত শক্তি মুসলমান রাজা এবং কিছু মৌর্য, গুপ্ত ও অন্ধ্র রাজাদের পুনরুদ্ভাসিত করতে সক্ষম হয়েছিলো। 
  5. মুঘল যুগের শেষ দিকে হিন্দু শক্তি মারাঠা বা শিখদের মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের চেষ্টা চালায়। 
বলা বাহুল্য, হিন্দু ধর্মের এই পুনরুত্থানে পুরোহিত শক্তির কোন ভূমিকা ছিলো না। এমনকি শিখেরা প্রকাশ্যে ব্রাহ্মন চিহ্নাদি সকল ত্যাগ করে "স্বধর্মলিঙ্গে ভূষিত করিয়া ব্রাহ্মন সন্তানকে স্বম্প্রদায়ে গ্রহন করে।" 

বহু ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে পুরোহিত শক্তির পর রাজশক্তি কয়েক শতাব্দী ধরে ভারত শাসন করে। মূলত বৌদ্ধ যুগ থেকে মুসলমান যুগ পর্যন্ত ভারত ছিলো ক্ষত্রিয়দের শাসনে।

বৈশ্য শক্তির উত্থান

কিন্তু মুঘল যুগের শেষে বৈশ্য শক্তির উত্থান ঘটলো। পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র ইংল্যান্ডেই বৈশ্য শক্তির জাগরন ঘটে। বৈশ্য শক্তি অসীম বুদ্ধি বলে সমুদ্র পার করে রাজাদের তার পুতুল বানিয়ে ফেলতে আরম্ভ করলো। 

ভারতে কোম্পানি শাসনের প্রথম পর্বে এই ঘটনা গুলিই ঘটতে আরম্ভ করলো। ক্রমে বৈশ্য শক্তির দাপটে রাজশক্তির বিনাশ ঘটলো এবং বৈশ্যরাই রাজা হয়ে উঠলেন। 

ভারত ইতিহাসের সারাংশ

"বর্তমান ভারতে" ভারতের প্রায় দশ হাজার বছরের ইতিহাস পর্যবেক্ষণের পর স্বামী বিবেকানন্দ সিদ্ধান্তে এসেছেন - 
  1. পৃথিবীর সর্বত্রই ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র এই চারটি বর্ন পর্যায় ক্রমে পৃথিবী শাসন করবে
  2. এই চারটি বর্নের উপস্থিতি পৃথিবীর সব সভ্যতাতেই দেখা যায়। 
  3. ভারতের মতোই চিন, সুমনের, ব্যাবিলন, মিশর, ইরান, আরব প্রভৃতি সভ্যতার সমাজে "নেতৃত্ব ও শাসন" প্রথম পর্যায়ে ছিলো ব্রাহ্মনদের হাতে। দ্বিতীয় পর্যায়ে তা যায় ক্ষত্রিয়দের হাতে। 
  4. মুঘল যুগের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে ক্ষত্রিয় যুগের অবসান ঘটেছে। এবং ইংরেজ শক্তির ভারত শাসনের মধ্য দিয়ে বৈশ্য শক্তির জাগরন ঘটেছে। 
  5. বর্তমানে বৈশ্য শক্তি ভারত শাসন করলেও, খুব শীঘ্রই এই বৈশ্য শক্তির পতন ঘটবে এবং চতুর্থ পর্যায়ে শুরু হবে শূদ্র জাগরন ও শূদ্রদের শাসন। ইতিমধ্যেই চিনে ঘটে চলেছে শূদ্র জাগরন। 
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, শূদ্র বলতে এখানে স্বামীজি অসহায়, নির্যাতিত, সাধারন জনশক্তিকেই বুঝিয়েছেন।কমিউনিস্ট মতাদর্শে কায়িক শ্রমজীবীদেরই সর্বহারা আখ্যা দেওয়া হয়। চিনে সর্বহারা কমিউনিস্ট শাসন শুরু হবার ৫০ বছর আগে স্বামীজি কিভাবে তা জানতে পেরেছিলেন, তা ভাবলে আজও পরম বিস্মিত হয়ে যেতে হয়। 

ইতিহাসের সারাংশ ও সার সত্য

"বর্তমান ভারত" প্রবন্ধে একেবারে শেষ লগ্নে ইতিহাস ও জগতের কতকগুলি সার সত্য বিবেকানন্দ তুলে ধরেন। ইতিহাসের গতি ও তার পট পরিবর্তন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি লেখেন - 
  1. বিদ্যা, বুদ্ধি, ধন, জন, বল প্রকৃতি যা আমাদের কাছে সঞ্চিত করেন, তা পুনরায় সঞ্চিত করবার জন্য নয়। তা বিতড়ন করবার জন্য। কিন্তু এটি না করে যখনই মানুষ প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদ গুলি পুনরায় সঞ্চয় করতে উদ্যত হয় এবং ঐ গুলি তার অধিকার হিসাবে জাহির করতে সচেষ্ট হয়, তখনই ঘটে বিপত্তি। 
  2. প্রকৃতি ব্রাহ্মনদের মধ্যে বুদ্ধি ও বিদ্যার জ্ঞানশক্তি সঞ্চয় করেছিলো। যতদিন তারা ঐ জ্ঞান ও বিদ্যা বুদ্ধিকে অপরকে নির্দ্ধিধায় বিলিয়ে দিয়েছিলেন এবং  জগৎ কল্যানে তাকে ব্যবহার করেছিলেন, ততদিন পর্যন্ত সব ঠিকই ছিলো। কিন্তু যখন থেকে তারা নিজ জ্ঞান শক্তিকে অপরকে নির্দ্ধিধায় বিতরনের বদলে নিজেদের মধ্যে সঞ্চয়ে সচেষ্ট হয়ে উঠলো, অপর বর্নের দ্বার রুদ্ধ করে বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, সম্পদ সব নিজেদের অধিকার বলে ঘোষনা করে ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ করতে লাগলো, তখনই ঘটলো ব্রাহ্মন্য শক্তির সঙ্গে রাজশক্তির দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে শেষপর্যন্ত পরাভূত হলো ব্রাহ্মন্য শক্তি। 
  3. একই ভাবে প্রজাপালনকারী রাজার কাছে প্রকৃতি সম্পদ ও ক্ষমতা সঞ্চয় করেন। কিন্তু রাজা প্রকৃতি প্রদত্ত সঞ্চিত সম্পদ পুনরায় সঞ্চয়ের জন্য উদ্যোগী হন। সম্পদে সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি প্রজাদের ওপর আরোও কর বাড়ান। রাজ্য জয় করে রাজ্যের পরিধিও বাড়াতে থাকেন। শাসনের নাগপাশ কে আরোও কঠোর ও দৃঢ় করেন। আর এর ফলে রক্ষকই একসময় হয়ে ওঠেন ভক্ষক। রাজার বিরুদ্ধে সৃষ্টি হয় প্রতিরোধ ও বিক্ষোভ। 
  4. রাজা প্রজা পালন করেন পিতার শিশু পালনের মতোই। কিন্তু শিশু সন্তানও একসময় সাবালক হয়। পিতার কঠোর অনুশাসন ও মতামতের ক্ষেত্রে দেখা দেয় মতপার্থক্য। দীর্ঘ দিন রাজার শাসনে থাকবার ফলে প্রজাও কখনও কখনও সাবালক হয়ে ওঠে। অবাধ্য প্রজাদের শায়েস্তা করতে রাজা তাই তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে আরোও সুদৃঢ় করতে থাকেন। 
  5. আর এটি করতে গিয়েই রাজা প্রজাগন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ক্ষমতার বিষপানে একাকি ছটফট করতে থাকেন এবং সবশেষে তার মৃত্যু (পতন) ঘটে। প্রায় দশ হাজার বছরের ভারতের ইতিহাসের এ এক অনন্ত সত্য

প্রজা শক্তির গুরুত্ব

বিবেকানন্দ তাই বলেছেন, সমাজের নেতৃত্ব বিদ্যাবলের দ্বারাই হোক (ব্রাহ্মন) বা বাহুবলের দ্বারাই হোক (ক্ষত্রিয়) - তার মূল আধার কিন্তু জনশক্তি অর্থাৎ প্রজাপুঞ্জ। 

ভারতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যখন থেকে ব্রাহ্মন শক্তি প্রজাদের কাছ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে বলতে থাকলেন, বেদ একমাত্র ব্রাহ্মনরাই পাঠ করতে পারবে। যজ্ঞ করবার, মন্ত্রপাঠ করবার একমাত্র অধিকার আছে ব্রাহ্মনের। সংস্কৃত দেবভাষা, সুতরাং তা পড়ার একমাত্র অধিকারী হলো ব্রাহ্মনরা  - তখনই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ব্রাহ্মন শক্তি একাকি স্বার্থপর হয়ে উঠলো এবং তার পতন ঘটলো। 

একই ভাবে রাজশক্তি ক্ষমতা আর বাহুবলকে আরোও সঞ্চিত ও বৃদ্ধি করবার জন্য প্রজাদের ওপর কর বৃদ্ধি করতে থাকেন, রাজ্য জয় করতে থাকেন, নিজ ক্ষমতাকে ধরে রাখবার জন্য অধিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে শাসনের নাগপাশকে কঠোর ও দৃঢ়তর করে তুলতে থাকেন। ক্রমে এসব করতে করতে শক্তি আর ক্ষমতার দম্ভে রাজা রক্ষক থেকে ভক্ষক হয়ে ওঠেন এবং প্রজাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং তার পতন ঘটে। 
একই নিয়মে বৈশ্য শক্তি চাইছে, সমাজের সমস্ত ধন তার কোষাগারে জমা হোক। এই ধনই হলো বৈশ্যের শক্তি। তা সঞ্চিত করতে গিয়ে বৈশ্যরাও একসময় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং সমাজে বৈশ্য শক্তিকে উচ্ছেদ করে শুরু হবে শূদ্রের শাসন। 

বর্তমান ভারত প্রবন্ধে ভারতবর্ষের শাসনপ্রনালীর বিশ্লেষন করতে গিয়ে স্বামীজি লিখেছেন, মৌর্য সাম্রাজ্য পতনের পর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত কোন সর্বব্যাপী শক্তিমান শাসন ব্যবস্থা ভারতে গড়ে ওঠে নি। ভারতবর্ষ বারংবার বিদেশী জাতীর আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। রাজার উচ্ছেদ ঘটেছে, আবার নতুন রাজা এসেছে - কিন্তু প্রজা জাগরন
 ঘটে নি। আর ঠিক এই কারনেই ভারতে কোন শক্তিশালী প্রজাতন্ত্র গড়ে ওঠে নি। 

ইংরেজ শাসন সম্পর্কে অভিমত

ভারতে ইংল্যান্ডের বর্তমান শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, সম্পূর্ণ স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী রাজার অধীনে পরাজিত জাতি বিশেষ ঘৃনার পাত্র হয় না। স্বেচ্ছাচারী সম্রাটের কাছে সকল প্রজাই সমান, অর্থাৎ কোন প্রজারই কোন অধিকার থাকে না। কিন্তু যেখানে প্রজাই রাজা অথবা যেদেশে প্রজাতন্ত্র থাকে, সেই দেশ যখন অপর কোন দেশ জয় করে, তখন সেখানে বিজিত ও বিজয়ীর মধ্যে এক বিরাট ব্যবধান থাকে। 

পরাজিত জাতির বিন্দুমাত্র কল্যান সাধন না করে, বিজয়ী জাতি সবসময় চেষ্টা করে, পরাজিত জাতিকে তার অধিনে রাখতে। বর্তমান ভারতে ইংল্যান্ড ঠিক এমনটিই করছে। নিজের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় সে ভারতীয়দের প্রতি জাতি বৈষম্য প্রদর্শন করে। ভারতীয়দের কালো, বর্বর, অসভ্য বলে অভিহিত করে। 

 বিদেশী ইংরেজদের জাতিগত বিদ্বেষে আমরা রাগান্বিত হই। কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যে কি জাতিগত বিদ্বেষ কম আছে? একজন মুর্খ ক্ষত্রিয় রাজা হলে ব্রাহ্মনরা যে আবার শূদ্রদের জিভ ছিঁড়ে নেবে না, তাদের শূলে চড়াবে না - কে বলতে পারে? 

আসলে ভারত সাম্রাজ্য যাতে হাতছাড়া না হয়, সেইজন্য ইংরেজ জাতি সবসময় চায় ভারতবাসীর মনে ইংরেজ জাতির গৌরব সদা সর্বদা জাগ্রত থাকুক। ভারতবাসী ইংরেজ জাতির শ্রেষ্ঠত্বের মোহে মোহিত হয়ে তার অধিন হয়ে পড়ুক। কিন্তু মুর্খ ইংরেজ বোঝে না, যেদিন আসমুদ্র হিমাচল ভারতের সকল খন্ড বিখন্ড প্রজাপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক বিরাট শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে, তখন ইংরেজ সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতোই ভেঙ্গে পড়বে। 

দেশপ্রেম ও গন জাগরনের বানী

গ্রন্থ শেষে বিবেকানন্দ তাই এদেশে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরনের সমালোচনা করে ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যকে স্মরন করিয়ে দিয়ে বলেছেন - 

"হে ভারত, এই পরানুবাদ, পরানুকরন, পরমুখাপেক্ষা... দাসসুলভ দুর্বলতা। হে ভারত ভুলিও না.. তোমার নারী জাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তি, ভুলিও না তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শঙ্কর। ভুলিও না তোমার ধন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয়সুখের... নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে... ভুলিও না তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত। ভুলিও না, নীচ জাতি, মুর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর, তোমার রক্ত, তোমার ভাই। হে বীর, সাহস অবলম্বন করো, সদর্পে বল - আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যান আমার কল্যান। 

বর্তমান ভারতে স্বামীজির এই বানী জাতিগত শোষনে নূহ্যমান দেশবাসীর হীনমন্যতা কাটিয়ে দেশবাসীর মধ্যে মানবপ্রেম ও স্বদেশ প্রেমের জাগরন ঘটায়। দেশবাসীর মনে নতুন চেতনা ও আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার করে। সমগ্র জাতিকে জাতীয়তাবাদের মহামন্ত্রে উজ্জিবিত করে তোলে। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post