সভা সমিতি যুগের বৈশিষ্ট্য

 ভারতের রাজনৈতিক চেতনার জাগরনের ক্ষেত্রে একটি  গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিলো - "সভা সমিতি যুগ"।

সভা সমিতি যুগের বৈশিষ্ট্য
সভা সমিতি যুগের বৈশিষ্ট্য 

প্রবক্তা

কেম্ব্রিজ ঘরানার ঐতিহাসিক ডঃ অনীল শীল তার "দি এমারজেন্স অফ ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম : কম্পিটিশন অ্যান্ড কোলাবরেশন ইন দি লেট নাইন্টিয়েথ সেঞ্চুরি" গ্রন্থে উনিশ শতককে "সভা সমিতির যুগ" বা "Age of association" বলে অভিহিত করেছেন।

সভা সমিতির যুগ বলতে কাকে বোঝায়?

ভারতীয়দের মধ্যে সংঘবদ্ধ চেতনারাজনৈতিক সচেতনতার জাগরন থেকে সমগ্র উনিশ শতক জুড়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য ছোট ছোট সভা সমিতি গড়ে উঠেছিলো। এইজন্য ঐতিহাসিক অনীল শীল উনিশ শতককে "সভা সমিতির যুগ" বলে অভিহিত করেছেন।

 সভা সমিতি গড়ে উঠবার সাধারন কারন

উনিশ শতকে সভা সমিতি গুলি গড়ে উঠবার পিছনে কতকগুলি সাধারণ কারন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। মনে রাখতে হবে, উনিশ শতকের পূর্বে ভারতীয়রা সামাজিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ বা সংঘবদ্ধ ছিলো না। ধর্মীয় ও সামাজিক নানা কুসংস্কার ও দ্বন্দ্বে ভারতীয়রা শতবিভক্ত ছিলেন।

কিন্তু উনিশ শতকে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা ভারতীয়দের মধ্যে সংঘবদ্ধ চেতনার জাগরন ঘটায়। 

(১.) প্রথমত, এই সময় একাধিক ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন চলেছিলো। এই আন্দোলন গুলিতে ভারতীয়রা পরস্পর বিরোধী দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। দুই শিবিরই এইসময় নিজেদের সংঘবদ্ধ করে তুলতে একাধিক সভা সমিতি ও সংগঠন গড়ে তোলে। 

(২.) দ্বিতীয়ত, উনিশ শতকের পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের ফলে ভারতীয় শিক্ষিত শ্রেনীর মধ্যে অল্পবিস্তর জাতীয়তাবাদী ধারনারাজনৈতিক সচেতনতার জাগরন ঘটে। তারা নিজেদের শ্রেনী, অঞ্চল ও সম্প্রদায়ের অধিকার বোধের প্রতি সচেতন হয়ে ওঠে। এই অধিকার বোধ সংঘবদ্ধ চেতনার জাগরন ঘটাতে সাহায্য করে। 

(৩.) তৃতীয়ত, ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোতে ভারতীয়দের অংশগ্রহণের বা প্রতিনিধিত্বের কোন সুযোগ ছিলো না। এমতাবস্থায়, ভারতে ব্রিটিশ শাসকের কাছে ভারতীয়দের নায্য দাবি দাওয়া, চাহিদা, ও অভিযোগের দিক গুলি তুলে ধরার জন্য শিক্ষিত শ্রেনী নিজেদের ছোট ছোট সভা সমিতির  মধ্য দিয়ে সংঘবদ্ধ করে তোলার কথা চিন্তা ভাবনা করে। এই চিন্তা ভাবনা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকেই উনিশ শতকে ভারতে একাধিক সভা সমিতির জন্ম হয়। 

সভা সমিতির উদাহরন

উনিশ শতকে ভারতে গড়ে ওঠা সভা সমিতি গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -

(১.) বাংলায় গড়ে ওঠা সভা সমিতি

  • বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা (১৯৩৬ কালীনাথ রায়চৌধুরী, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন),
  • জমিদার সভা বা ল্যান্ড হোল্ডার্স সোসাইটি (১৮৩৮ প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজা রাধাকান্ত দেবের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়),
  • বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (১৮৪৩, জর্জ টমসন প্রতিষ্ঠা করেন),
  • ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৫১,জমিদার সভা ও বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি একত্রিত হয়ে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়),
  • ইন্ডিয়ান লিগ (১৮৭৫, শিশির কুমার ঘোষ, হেমন্ত কুমার ঘোষ এটি প্রতিষ্ঠিত করেন),
  • ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বা ভারতসভা (১৮৭৬, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আনন্দমোহন বসু এটি প্রতিষ্ঠিত করেন),

(২.) বাংলার বাইরে গড়ে ওঠা সভা সমিতি

  • বোম্বাই অ্যাসোসিয়েশন (১৮৫২, দাদাভাই নৌরজী এটি প্রতিষ্ঠিত করেন),
  • পুনা সার্বজনীন সভা (১৮৭০, গোপাল হরি দেশমুখ এটি প্রতিষ্ঠা করেন),

সভাসমিতি যুগের বৈশিষ্ট্য

উনিশ শতকে সভা সমিতি যুগের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
  1. উনিশ শতকের সভা সমিতি গুলি প্রথমে বাংলায় গড়ে ওঠে। পরে বাংলার অনুকরনের ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও সভা সমিতি গড়ে উঠতে আরম্ভ করেছিলো।
  2. মূলত কোলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ, পুনা প্রভৃতি বড়ো বড়ো শহরকে কেন্দ্র করেই এই সভা সমিতি গুলি গড়ে উঠেছিলো।
  3. সভা সমিতি গুলি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিলো ভারতীয়দের স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে কিছু দাবি দাওয়া সরকারের কাছে পেশ করা
  4. সমাজে প্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত ধনী ব্যবসায়ী ও জমিদারদের উদ্যোগেই এই সভা সমিতি গুলি গড়ে উঠেছিলো।
  5. সভা সমিতি গুলির সঙ্গে দেশের সাধারন অশিক্ষিত, দরিদ্র শ্রেনীর মানুষদের কোন আত্মিক যোগ ছিলো না
  6. সভা সমিতি গুলির সবকটিরই চরিত্র ছিলো আঞ্চলিক, এবং তাদের কর্মকান্ড আঞ্চলিক বা স্থানীয় স্তরেই আবদ্ধ ছিলো।
  7. সভা সমিতি গুলি বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থের বাহক ছিলো। অর্থাৎ নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা শ্রেনীর স্বার্থ রক্ষা করবার উদ্দেশ্যেই এগুলি গড়ে তোলা হয়েছিলো। 
  8. সভাসমিতি গুলির নেতৃত্বের বেশিরভাগই এসেছিলেন উচ্চবর্নের হিন্দু সম্প্রদায় থেকে।
  9. সভা সমিতি গুলি জাতি, ধর্ম, বর্ন ইত্যাদি সংকীর্ণতার গোন্ডি অতিক্রম করে গড়ে উঠেছিলো। 

সভা সমিতি যুগের গুরুত্ব

ভারতে রাজনৈতিক চেতনার জাগরনে সভা সমিতি যুগের গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম -
  1. উনিশ শতকের সভা সমিতির অনুশীলনের মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষ বিশ শতকের আধুনিক রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করে।
  2. সভা সমিতি গুলি প্রকাশ্যে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য জানালেও, তারা সরকারের কাজকর্ম ও নীতির অবিরাম ও যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করে দেশে রাজনৈতিক চেতনার জাগরন ঘটায়। 
  3. ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার ঐক্য ও ইংরেজি ভাষার প্রসারের সুযোগ নিয়ে প্রাদেশিক সভা সমিতি গুলি একে অন্যের মত ও আদর্শের আদান প্রদান করে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক চেতনার প্রসার ঘটায়।
  4. সভা সমিতি যুগের অভিজ্ঞতা থেকে ভারতীয়রা ব্রিটিশ সরকারের কাছে ভারতীয়দের ন্যায্য দাবি ও অধিকার গুলি আদায়ের জন্য সর্বভারতীয় সংগঠন ও সর্বভারতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার শিক্ষা লাভ করে।
  5. এই শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে ভারতীয়দের সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করে। এরই ফলশ্রুতিতে ভারতে ১৮৮৫ খ্রিঃ সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গড়ে ওঠে। এই জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বেই ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রবল আকার ধারন করে।
এইভাবেই দেখা যায়, সভা সমিতি যুগ ভারতে রাজনৈতিক চেতনার জাগরন ও প্রসারে এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post