সতীদাহ আন্দোলনের পর উনিশ শতকের সবথেকে বেশি আলোড়ন সৃষ্টিকারী সমাজ সংস্কার আন্দোলন ছিলো - "বিধবা বিবাহ" প্রবর্তনের আন্দোলন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনের ৩০ বছর বয়সে এই আন্দোলন শুরু করেন। রাজা রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা নিবারনের প্রায় ২৫ বছর পর বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন করা অত্যন্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছিলো।
|
বিধবা বিবাহ আন্দোলন
|
বিধবা বিবাহ নিয়ে আন্দোলনের কারন
উনিশ শতকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন শুরু করবার পিছনে একাধিক কারন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। এইসব কারন গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) ভারতীয় সমাজ ও বিধবা প্রথা
প্রাচীন কাল থেকে ঋতুমতি হবার আগে কন্যার বিবাহ দেওয়াই ছিলো ভারতীয় সমাজের সামাজিক রীতি। অল্প বয়সে বিবাহ হবার ফলে অথবা বেশি বয়স্ক পুরুষের সাথে বিবাহ হওয়ার ফলে, ভারতীয় নারীদের অর্ধেক জীবন বৈধব্যের মধ্যে কাটাতে হতো।
অন্যদিকে বাংলায় কৌলিন্যপ্রথা প্রচলিত থাকায় এখানে কুলীন পুরুষের বহু বিবাহ একটি সামাজিক অভ্যাস বা রীতি হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বাংলায় বিধবাদের সংখ্যা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে অনেক বেশি ছিলো। যে কারনে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের সবথেকে বেশি প্রয়োজন বাংলাতেই অনুভূত হয় এবং এটি নিয়ে জোরালো আন্দোলন শুরু হয়।
(২.) সতীদাহ নিবারনের সামাজিক প্রতিক্রিয়া
১৮২৯ খ্রিঃ সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ হওয়ায় ফলে নারীরা মৃত্যুর কবল থেকে মুক্তি লাভ করে। আগে সহমরন প্রথায় বিধবা নারীদের একটি বড়ো অংশকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হতো।
কিন্তু এখন সেটি সম্ভব না হওয়ায় স্বাভাবিক নিয়মেই সমাজে বিধবাদের সংখ্যা মারাত্মক ভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, এবং সতীদাহ প্রথা নিবারনের ২৫ বছরের মধ্যেই তা দ্বিগুন আকার ধারন করে।
(৩.) সমাজে নারীঘটিত অপরাধ বৃদ্ধি
সতীদাহ প্রথা নিবারনের পর বিধবা নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে স্বাভাবিক নিয়মেই সমাজে নারী ঘটিত নানা ব্যভিচার ও অপরাধের সংখ্যা মারাত্মক ভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। হিন্দু সমাজে নানা সামাজিক আনাচার, ব্যভিচার ও অনৈতিকতা সমাজের ভিত নষ্ট করে দিতে শুরু করে।
(৪.) বিধবাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন
ভারতীয় সমাজে এমনিতেই বিধবাদের ওপর নানা ধরনের সামাজিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হতো। তাদের কেশ, বেশ, আহার সব কিছুই কেড়ে নিয়ে মুন্ডিত মস্তকে সাদা থান পরে, নিরামিষ খাদ্য গ্রহন ও উপবাসের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করানো হতো।
সতীদাহ নিবারনের আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে রামমোহন সতীদাহের বদলে বিধবা নারীদের ব্রহ্মচর্য পালনের শাস্ত্রীয় নির্দেশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করায় স্বাভাবিক নিয়মেই সতীদাহ নিবারনের পরের বছর গুলিতে বিধবা নারীদের ওপর পারিবারিক নিপীড়ন বহুগুন বৃদ্ধি পায়।
এই সময়ে সম্পত্তি আত্মসাৎ এর জন্য কমবয়সী বিধবাদের প্রায়ই বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। অন্যদিকে যাদের শ্বশুর বাড়িতে ঠাঁই জুটতো, তাদের ওপর সেখানে অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হতো। যতদিন সংসারে বিধবারা শ্রমদান করতে পারতেন, ততদিন পর্যন্তই তারা সেখানে টিকে থাকতে পারতেন। না পারলে তাদের বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়স্থল ছিলো কাশী অথবা বৃন্দাবন।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই উপরোক্ত কারন গুলির জন্য উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে "বিধবা নারীদের সমস্যা" তৎকালীন সমাজের সবচেয়ে বড়ো "সামাজিক সমস্যা" হিসাবে উঠে আসে। আর এই সমস্যার যথার্থ সমাধান করবার জন্যই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর "বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের আন্দোলন" সংগঠিত করেন।
তবে এখানে মনে রাখতে হবে, শাস্ত্রে বিধবা বিবাহের সমর্থন ছিলো বলেই যে বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ আন্দোলন শুরু করেছিলেন , বিষয়টা কিন্তু তেমন নয়। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে বিধবা বিবাহ আন্দোলন শুরু করার পিছনে অন্য সব কারনের থেকেও তার মানবতাবাদী জীবন দর্শনের তাড়না, বিশেষত দুর্বল, অসহায় ও উৎপীড়িত জনের প্রতি তার গভীর মমত্ববোধ ও সহানুভূতিই তাকে বিধবা বিবাহ আন্দোলনে এগিয়ে আসতে সবথেকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিলো। শাস্ত্রীয় যুক্তি ও তত্ত্ব তিনি কেবল কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশবাসীর জ্ঞান চক্ষু খোলার জন্যই ব্যবহার করেছিলেন।
বিধবা বিবাহে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা ও সাফল্য
মনে রাখতে হবে, বিদ্যাসাগর কিন্তু প্রথম বিধবা বিবাহ নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করেন নি। সমাজে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য মুঘল যুগ থেকেই সংস্কারকরা ধারাবাহিক ভাবে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। বিদ্যাসাগর এই প্রচেষ্টারই উত্তরসূরী ছিলেন মাত্র।
বিধবা বিবাহের আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর অন্তত ৪ টি দিক থেকে এমন কিছু মৌলিকত্ব ও অভিনবত্ব ও কৃতিত্বের ছাপ রাখেন, যেগুলির তার পূর্ববর্তী সংস্কারকরা রাখতে পারেন নি। এই বিশেষ অবদান গুলির জন্যই বিধবা বিবাহ আন্দোলনে বিদ্যাসাগর তার পূর্ববর্তী সংস্কারকদের থেকে অনেক বেশি সাফল্য লাভ করেন।
মনে রাখতে হবে -
- বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের সমর্থনে যেভাবে জোরালো শাস্ত্রীয় তথ্য প্রমান পেশ করতে পেরেছিলেন, তা তাঁর পূর্ববর্তী কোন সংস্কারকরাই সেভাব করতে পারেন নি।
- বিদ্যাসাগর "বিধবা প্রথাকে" একটি ব্যতিক্রমী সামাজিক দৃষ্টান্ত হিসাবে না দেখে একটি প্রধান সামাজিক সমস্যা হিসাবে তুলে ধরেন। এর ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রথার পক্ষে ও বিপক্ষে সমাজে প্রবলভাবে জনমত সংগঠিত হয়, যা ইতিপূর্বে ঘটে নি।
- এছাড়া, পত্র পত্রিকা ও প্রচার পুস্তিকায় বিধবা বিবাহের বিষয়টি নিয়ে বিদ্যাসাগর যেভাবে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেন এবং বিষয়টিকে ব্যপকতা প্রদান করেন, তাও এর আগের বিধবা বিবাহ আন্দোলন গুলিতে ঘটে নি।
- সর্বোপরি, বিধবা বিবাহ প্রচলনে -
- আইন প্রণয়নের জন্য সরকারকে প্রভাবিত করা,
- প্রয়োজনীয় শাস্ত্রীয় যুক্তির সমর্থন দিয়ে সরকারকে আইন রচনায় সাহায্য করা,
- আইনের বাস্তবায়নে নিজে উদ্যোগী হয়ে বিধবা বিবাহের আয়োজন করা,
ইত্যাদি কাজ গুলি বিদ্যাসাগর যেভাবে সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তা তার কোন পূর্বসূরীই করতে পারেন নি। এদিক থেকে বিচার করে বিধবা বিবাহ আন্দোলনে বিদ্যাসাগরের অবদান ও ভূমিকার মূল্যায়ন করতে গিয়ে একথা জোর দিয়েই বলা যায়,
বিধবা বিবাহ আন্দোলনে বিদ্যাসাগর তার পূর্ববর্তী সংস্কারকদের থেকে অনেক বেশি সাফল্য লাভ করেছিলেন এবং "শাস্ত্রীয় যুক্তি" ও "সরকারি আইনের" মধ্য দিয়ে বিধবা বিবাহের বিষয়টিকে
সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
প্রাক্ বিদ্যাসাগর পর্বে বিধবা বিবাহ
এখানে মনে রাখতে হবে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিধবা বিবাহ নিয়ে আন্দোলন শুরু করবার আগেই এই বিষয়টি নিয়ে অনেকে আন্দোলন সংগঠিত করবার চেষ্টা করেন।
(ক.) দক্ষিন ভারতে বিধবা বিবাহ আন্দোলন
প্রাক্ বিদ্যাসাগর পর্বে দক্ষিণ ভারতে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের অনেকগুলি প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। ১৮৩৭ খ্রিঃ রত্নাগিরির একজন তেলেগু ব্রাহ্মন বিধবা বিবাহের সমর্থনে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। এই বইটি নিয়ে "মুম্বাই দর্পন" প্রবল সমালোচনাও চলেছিলো।
এই ঘটনার কিছুদিন পর জৈন সম্প্রদায়ের নেতা বাবা পদ্মনজি বিধবা বিবাহকে সমর্থন করে একটি আলোড়ন সৃষ্টির প্রচেষ্টা করেন। কিন্তু তিনিও এক্ষেত্রে বিষয়টির গ্রহনযোগ্যতা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি। ১৮৪১ খ্রিঃ নাগপুরের একজন মারাঠা ব্রাহ্মন শাস্ত্রীয় যুক্তি তুলে ধরে বিধবা বিবাহ প্রচলনের চেষ্টা করেন এবং ব্যর্থ হন। এরপর ১৮৫৩ খ্রিঃ রঘুনাথ জনার্দন নামে একজন ব্রাহ্মন বিধবা বিবাহ প্রচলন করতে গিয়ে নিজে বিধবা বিবাহ করেন।
বলা বাহুল্য, প্রাক্ বিদ্যাসাগর পর্বে দক্ষিণ ভারতের বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের এই প্রচেষ্টা গুলির কোনটিই সেভাবে -
- সফলতা লাভ করতে পারে নি।
- সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে নি।
- কোন আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে নি।
- বিষয়টির গ্রহনযোগ্যতাও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নি।
(খ.) বাংলাতে বিধবা বিবাহের প্রচেষ্টা
বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনের প্রায় ১০০ বছর আগে বাংলাদেশে ঢাকার রাজা রাজবল্লভ (১৬৯৮ - ১৭৬৩) বিধবা বিবাহ প্রচলনের চেষ্টা করেও অপর একজন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের চক্রান্তের কারনে ব্যর্থ হন।
সংবাদপত্রে বিধবা বিবাহের প্রস্তাব
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ নিয়ে আন্দোলনের প্রাক্ মুহুর্তে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র গুলিতে প্রায়ই বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত নানা আলোচনা ও লেখাপত্র প্রকাশিত হতো। ১৮৩৫ খ্রিঃ ১৪ মার্চ শান্তিপুরের কিছু কুলীন মহিলা বিধবা বিবাহের দাবি জানিয়ে একটি পত্র সমাচার দর্পনের সম্পাদককে পাঠিয়েছিলেন। সেই পত্রটি পরবর্তীকালে সমাচার দর্পনে প্রকাশিত হয়।
এর কিছুদিন পর ঐ একই দাবি জানিয়ে চুচূড়ার কিছু বিধবা মহিলা সমাচার দর্পনে চিঠি লেখেন। ১৮৩৭ খ্রিঃ ইয়ং বেঙ্গল দলের পত্রিকা "জ্ঞানান্বেষন" এ কলকাতায় বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে একটি সভা আহ্বানের সংবাদ পাওয়া যায়। এই সভাকে সমর্থন জানিয়ে তার একটি খবর সমাচার দর্পনে প্রকাশিত হয়েছিলো।
এই ঘটনার কয়েকবছর পর ১৮৪২ খ্রিঃ বেঙ্গল স্পেকটেটর এ জনৈক পত্র লেখক বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে কিছু জোরালো শাস্ত্রীয় যুক্তি তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি তিনি এমন পরামর্শও দেন, সমাজের রক্ষনশীলরা যদি বিষয়টি মেনে নাও নেয়, তাহলে সরকারের উচিৎ আইনের মধ্য দিয়ে বিষয়টির গ্রহনযোগ্যতা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা।
অন্যদিকে এইসময় রক্ষনশীলদের পত্রিকা সংবাদ প্রভাকরেও বিধবা বিবাহ নিয়ে নানা সংবাদ পরিবেশন করা হতো।
সভাসমিতিতে বিধবা বিবাহ নিয়ে আলোচনা
সংবাদপত্রের আলোচনা ছাড়াও বিধবা বিবাহের বিষয়টি নিয়ে সেইসময়ের বিভিন্ন সভা সমিতিতেও নানা বিতর্ক ও আলোচনা চলতো। রামমোহনের আত্মীয়সভা থেকেই প্রথম বিধবা বিবাহ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। পরে ইয়ং বেঙ্গলদের প্রতিষ্ঠান"অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন" এর বৈঠক গুলিতে বিধবাদের দুঃখ দুর্দশাময় জীবন নিয়ে প্রায়ই আলোচনা চলতো। ১৮৪৫ খ্রিঃ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য তত্ত্ববোধিনী সভার সঙ্গে একাধিক পত্রালাপও করেছিলো।
প্রাক্ বিদ্যাসাগর পর্বের বিধবা বিবাহ নিয়ে এই ধরনের প্রচেষ্টা গুলি থেকে বোঝা যায় -
- বিদ্যাসাগর হঠাৎ করেই বিধবা বিবাহ আন্দোলন শুরু করেন নি।
- বিদ্যাসাগরের আন্দোলন শুরুর বহু আগে থেকেই বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা হিসাবে উঠে আসে।
- পূর্ববর্তী সংস্কারকদের ব্যর্থতা বিদ্যাসাগরকে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য আন্দোলনে এগিয়ে আসতে অনেকাংশে অনুপ্রাণিত করে।
পূর্ববর্তী সংস্কারকদের প্রচেষ্টা ও চিন্তা ভাবনার ফলে তৎকালীন শিক্ষিত শ্রেনীর একাংশের মধ্যে বিধবা বিবাহের প্রচলন নিয়ে যে সচেতনতাবোধ ও সহানুভূতির পরিবেশ তৈরি হয়েছিলো, তা নিঃসন্দেহে পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনটিকে সংঘবদ্ধ করে তুলতে অনেকখানি সাহায্য করেছিলো। তাই বিধবা বিবাহ আন্দোলনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকার কথা তুলে ধরতে গেলে অবশ্যই পূর্ববর্তী সংস্কারকদের কৃতিত্ব ও প্রচেষ্টা গুলিকেও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়।
বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সূচনা
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জানতেন, বিধবা বিবাহের মতো একটি সামাজিক বিষয় রক্ষনশীল হিন্দু সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে সবার প্রথমে এ সম্পর্কে "জনসচেতনতা ও জনমত" সংগঠিত করতে হবে। তার থেকেও বড়ো কথা, বিধবা বিবাহ যে "শাস্ত্র সম্মত" একটি বিষয় সে সম্পর্কে প্রচলিত সমাজের যাবতীয় দ্বিধা ও সংশয়ের অবসান ঘটাতে হবে।
আন্দোলনের প্রথম পর্যায় (১৮৫০ - ১৮৫৪)
(১.) বাল্যবিবাহের দোষ প্রবন্ধের প্রকাশ
১৮৫০ খ্রিঃ আগস্ট মাসে "সর্বশুভকরী পত্রিকায়" ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর "বাল্যবিবাহের দোষ" নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এখানে তিনি বিধবা বিবাহ প্রচলনের পক্ষে তার বক্তব্য ও চিন্তা ভাবনার কথা প্রথম তুলে ধরেন।
এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হবার পর রক্ষনশীল হিন্দু সমাজ বিদ্যাসাগরকে প্রবলভাবে সমালোচনা করে। এমনকি এ নিয়ে শিক্ষা গুরু শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতির সঙ্গেও বিদ্যাসাগরের আদর্শগত সংঘাত আরম্ভ হয়।
এই সমালোচনা থেকে বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেন, সমাজে বিধবা বিবাহের মতো একটি বিষয়কে তখনই প্রতিষ্ঠিত করা যাবে, যখন এ সম্পর্কে জোরালো শাস্ত্রীয় সমর্থনের যুক্তি উপস্থাপন করা যাবে। ধর্মভীরু সমাজকে স্বমতে নিয়ে আসবার জন্য এবং অজ্ঞ দেশবাসীর জ্ঞান চক্ষু খোলার জন্য বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে শাস্ত্রীয় সমর্থন যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়, তা অচিরেই বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করতে পারেন।
১৮৫০ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক পদে যোগ দিয়ে বিদ্যাসাগর তাই দিনরাত এক করে সংস্কৃত কলেজের গ্রন্থাগারে বিধবা বিবাহের শাস্ত্রীয় যুক্তি ও তথ্যপ্রমান অনুসন্ধান করতে থাকেন।
(২.) তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশ
১৮৫৪ খ্রিঃ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে পর পর কয়েকটি প্রবন্ধ লিখে প্রকৃতপক্ষে বিদ্যাসাগর তার বিধবা বিবাহ আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত করেন। এই প্রবন্ধ গুলিতে তথ্য প্রমান পেশ করে তিনি দেখান - প্রাচীন শাস্ত্রে বিধবা বিবাহের একাধিক প্রমান রয়েছে। এবং প্রাচীন কাল থেকে কোন সময়েই বিধবা বিবাহ একেবারেই অপ্রচলিত একটি বিষয় ছিলো না।
(৩.) কালীকৃষ্ণ মিত্রের সমর্থন ও আলোড়ন সৃষ্টি
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে বিদ্যাসাগরের প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হবার পরে তা কলকাতা সহ বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের শিক্ষিত শ্রেনীর মধ্যে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করে।
এর কিছুদিন পর কৃষ্ণনগরে এক সভায় কালীকৃষ্ণ মিত্র বিধবা বিবাহের সমর্থনে বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রীয় যুক্তি গুলির প্রচার করেন এবং সেগুলির বৈধতা প্রমান করেন।
এর ফলে বিধবা বিবাহের বিষয়টিকে নিয়ে বাংলার শিক্ষিত মহলে একটি আলোড়ন ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।
আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় (১৮৫৫, 'জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর)
পুস্তিকা প্রকাশ ও জনমত গঠন
আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে জনমতকে আরোও শক্তিশালী করে তোলার জন্য বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ খ্রিঃ ২২ জানুয়ারি, "বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিৎ কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব" নামে ২২ পাতার একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন।
এই পুস্তিকাটিতে বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে বিদ্যাসাগর অসংখ্য তথ্য প্রমান তুলে ধরেন। এই তথ্য সংগ্রহের কাজে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক ভরতচন্দ্র শিরোমনি ভট্টাচার্য, তারানাথ তর্কবাচস্পতি, গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন বিদ্যাসাগরকে প্রভূত সাহায্য করেন।
পরাশর সংহিতার শ্লোক
এই পুস্তিকাটিতে বিদ্যাসাগর পরাশর সংহিতার চতুর্থ অধ্যায়ের একটি শ্লোককে ভিত্তি করেই বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে তার সমস্ত শাস্ত্রীয় যুক্তিজাল বিস্তার করেন।
পরাশর সংহিতাকে বেছে নেবার একটি প্রধান কারন ছিলো রক্ষনশীল সমাজপতি এবং সমস্ত শাস্ত্রকারেরা মনে করতেন, পরাশর সংহিতার পালনীয় নির্দেশ গুলি কলিযুগের মানুষের জন্যই রচনা করা হয়েছিলো। এইজন্য বিদ্যাসাগর পরাশর সংহিতার একটি শ্লোককে ভিত্তি করেই তার সমস্ত শাস্ত্রীয় যুক্তি জাল গুলি সাজান।
পরাশর সংহিতার চতুর্থ অধ্যায়ের শ্লোকটিতে বলা হয়েছিলো -
"নষ্ট মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ
পঞ্চসাপাৎসু নারীনাং পতিরেন্য বিধীয়তে।।"
অর্থাৎ কোন নারীর যদি স্বামী মারা যায়, নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, সন্ন্যাস গ্রহন করে অথবা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হয়, তাহলে সেই নারী দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারে। পরাশর সংহিতায় স্পষ্টতই নারীর পুর্নবিবাহের কথা বলা হয়েছিলো।
বিদ্যাসাগর তার বক্তব্যকে আরোও জোরালো করার জন্য পরাশর সংহিতার প্রথম অধ্যায়ের আরোও একটি শ্লোককে তুলে ধরেছিলেন। যেখানে বলা হয়েছিলো - "মনুনিরূপিত ধর্ম যেমন সত্যযুগের ধর্ম, গৌতমমুনি রূপিত ধর্ম ত্রেতাযুগের ধর্ম, শঙ্খনিরুপিত ধর্ম ছিলো দ্বাপর যুগের ধর্ম, তেমনি পরাশর নিরূপিত ধর্ম হল কলিযুগের ধর্ম।" খুব স্বাভাবিক ভাবেই পরাশর সংহিতার বিধানকে রক্ষনশীল হিন্দুদের পক্ষে খন্ডন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ব্যাপক জন আলোড়ন সৃষ্টি
শক্তিশালী শাস্ত্রীয় যুক্তির কারনে বিদ্যাসাগরের" বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব" বইটি কলকাতায় তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে একটি প্রবল জনমত গঠন করে।
বইটি তৎকালীন সমাজে কি রূপ প্রভাব ফেলেছিলো, তা এর বিক্রির পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়। বইটির প্রথম সংস্করন ২০০০ কপি ছেপে বেরিয়েছিলো, যা এক সপ্তাহের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় সংস্করনে ৩০০০ কপি ছেপে বেরিয়েছিলো। সেটিও অল্প সময়ে বিক্রি হয়ে যায়। তৃতীয় সংস্করনে ১০,০০০ কপি মুদ্রিত হয়। এটিও অল্প সময়ে বিক্রি হয়ে যায়।
মনে রাখতে হবে, আমরা যে সময়ের ইতিহাস আলোচনা করছি, সেই সময়ে কলকাতায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা নেহাতই মুষ্ঠিমেয় ছিলো। তা সত্ত্বেও বইটির তুমুল বিক্রি, প্রচার ও জনপ্রিয়তা থেকে বোঝা যায়, বইটি বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে কি বিরাট শক্তিশালী জনমত তৈরি করতে পেরেছিলো।
রক্ষনশীলদের প্রতিক্রিয়া
বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে বিদ্যাসাগরের আন্দোলন কলকাতার শিক্ষিত মহলে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করলে, রক্ষনশীল হিন্দু সমাজ শঙ্কিত হয়ে ওঠে। তারা বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে বিদ্যাসাগরের যুক্তি গুলিকে খন্ডন করে এইসময় পাল্টা ৩০ টি পুস্তিকা প্রকাশ করেন ।
বিদ্যাসাগর পাল্টা রক্ষনশীলদের যুক্তি গুলিকে খন্ডন করে ১৮৫৫ খ্রিঃ বিধবা বিবাহের সমর্থনে প্রকাশ করেন তার দ্বিতীয় গ্রন্থ - "বিধবা বিবাহ বিষয়ক দ্বিতীয় পুস্তক"। এই পুস্তিকাতে বিদ্যাসাগর রক্ষনশীলদের ৩০ টি পুস্তকে রাখা রক্ষনশীলদের সমস্ত যুক্তি গুলিকেই খন্ডন করে দেন।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই রক্ষনশীল হিন্দুরা বিধবা বিবাহ আন্দোলনের বৌদ্ধিক আলোচনা ও বিতর্কের পর্যায়ে সব দিক থেকেই বিদ্যাসাগরের কাছে পরাভূত হন। এর ফলে রক্ষনশীল হিন্দুরা বেশ কিছুটা মারমুখী হয়ে ওঠেন।
এইসময় বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে তারা সর্বত্র কটুকথা ও গালিবর্ষন করতে থাকে। তাকে বেশ কয়েকবার হত্যা করারও চেষ্টা করা হয়। এই সময় বিদ্যাসাগর এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে, প্রকাশ্য রাস্তায় রক্ষীবিহীন ভাবে তিনি চলাফেরা পর্যন্ত করতে পারতেন না। সমকালীন সময়ে প্রায় সমস্ত সংবাদপত্রেই বিদ্যাসাগরের নিন্দা করা হয়। একমাত্র ৩ টি পত্রিকা বিদ্যাসাগরকে সমর্থন করেছিলো - তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, সম্বাদ ভাস্কর এবং মাসিক পত্রিকা।
যাইহোক, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রক্ষনশীলদের এই প্রতিক্রিয়া থেকে উপলব্ধি করেন, শুধু জনমত সংগঠিত করেই বিধবা বিবাহ কে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। এইজন্য সরকারেরও হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। এই কারনে বিধবা বিবাহ আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়ে বিদ্যাসাগর সরকারের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায় (১৮৫৫ খ্রিঃ, অক্টোবর - ১৮৫৬ খ্রিঃ জুলাই )
সরকারের কাছে আবেদনপত্র প্রেরন
বিধবা বিবাহ আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়ে বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ খ্রিঃ ৪ ঠা অক্টোবর ১,০০০ ব্যক্তির স্বাক্ষর করা একটি আবেদনপত্র ভারত সরকারের কাছে পাঠান। এই আবেদন পত্রে তিনি বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের স্বপক্ষে সরকারের কাছে একটি আইন তৈরির সুপারিশ করেন।
এই প্রস্তাবে তৎকালীন সময়ে বহু প্রখ্যাত ব্যক্তি স্বাক্ষর করে ছিলেন। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্র, অক্ষয়কুমার দত্ত, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, কালীকৃষ্ণ মিত্র। এছাড়াও বর্ধমান, নবদ্বীপ, ঢাকা ময়মনসিংহের জমিদাররাও পৃথক ভাবে সরকারের কাছে আবেদনপত্র প্রেরন করেন।
বিধবা বিবাহের আইন প্রণয়ন
১৮৫৫ খ্রিঃ ১৮ নভেম্বর, Legislative council এর সদস্য J P Grant প্রথম বিধবা বিবাহ আইনের খসড়া উত্থাপন করেন। স্যার জেমস কলভিল এটিকে সমর্থন করেন।
প্রথমবার আলোচনা সভায় ভারতে বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হয়। ১৮৫৬ খ্রিঃ ৯ জানুয়ারি বিধবা বিবাহ আইনের প্রস্তাবটি দ্বিতীয় বারের জন্য পাঠ করা হয় এবং সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠানো হয়।
পরস্পর বিরোধী শিবির
বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য যখন আইন সভায় আইন তৈরির প্রক্রিয়া চলছিলো, তখন তাকে কেন্দ্র করে কলকাতার শিক্ষিত সমাজ পরস্পর বিরোধী দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
এইসময় রক্ষনশীল হিন্দুরা কলকাতায় রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে এক সভায় মিলিত হয়। এই সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিধবা বিবাহ আইন যাতে প্রচলিত না হয়, সেইজন্য রক্ষনশীল সমাজ গন স্বাক্ষর করা একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠাবে। প্রয়োজনে বিলাতেও গন স্বাক্ষর করা আবেদনপত্র পাঠানো হবে।
কথামতো ১৮৫৬ খ্রিঃ ১৭ মার্চ ৩৬,৭৬৩ টি গন স্বাক্ষর করা একটি আবেদনপত্র এবং আরোও অন্যান্য জায়গা থেকে ৪০ টি আবেদনপত্রে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ব্যক্তির গন স্বাক্ষর করা প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা পড়ে। অর্থাৎ বিধবা বিবাহ আইনের বিপক্ষে প্রায় ১ লক্ষ গন স্বাক্ষর করা আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠানো হয়।
অন্যদিকে বিধবা বিবাহ আইনের সমর্থনে মাত্র ২৫ টি আবেদন পত্রে ৫,০০০ ব্যক্তির গন স্বাক্ষর করা প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা পড়ে।
বিধবা বিবাহ আইন পাশ
বিধবা বিবাহের বিপক্ষে রক্ষনশীলদের আবেদনের সংখ্যা ও জনমত অনেক বেশি শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও, আইন সভায় তাদের সমস্ত আবেদন ও প্রস্তাব গুলিই প্রত্যাখ্যান করা হয়। এবং আইনসভায় বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়ে যায়।
আইন সভায় বিধবা বিবাহ আইন পাশে জে পি গ্রান্টের অসাধারণ বাগ্মীতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি মূল্যবান কথা বলেন - "বিধবা বিবাহের জন্য যে আইনটি তৈরি হচ্ছে, সেই আইনটির মধ্য দিয়ে কিন্তু কোথাও কোন ধর্মের ক্ষেত্রে বা সমাজ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বা পারিবারিক কোন ঐতিহ্য বা প্রথার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে না। যারা একটু ব্যতিক্রমী ও উদারনৈতিক ভাবে জীবনধারন করতে ইচ্ছুক, তাদের সেই সুযোগ দেওয়ার জন্য এই আইনটি তৈরি হচ্ছে।
এর পাশাপাশি আইন পাশের প্রাক্ মুহুর্তে আইনের সমর্থনে আরোও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন," যদি রক্ষনশীলরা এই আইনটি মেনে নাও নেয় বা সমাজে সকলে যদি এই আইনটি প্রত্যাখ্যানও করে, তা হলে ইংরেজ জাতীর সুনামের স্বার্থে এই আইনটি পাশ করা প্রয়োজন।"
যাইহোক, জে পি গ্রান্টের প্রস্তাবনা, বক্তব্য এবং আইনসভার সদস্যদের সিদ্ধান্তের ফলে ১৮৫৬ খ্রিঃ ২৬ জুলাই "পঞ্চদশ আইন" প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে বিধবা বিবাহ আইনত বৈধ বলে ঘোষিত হয়। বিধবা বিবাহের ফলে যে সন্তান জন্ম নেবে, সেই সন্তানও এই আইনে আইনী স্বীকৃতি লাভ করে।
এইভাবে দেখা যায়, বিদ্যাসাগরের আপসহীন লড়াই, শানিত শাস্ত্রীয় যুক্তি এবং আইন সভার সদস্য জে পি গ্রান্টের অসাধারন বাগ্মীতার জন্য শেষপর্যন্ত বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, লর্ড ডালহৌসির আমলেই এই ঐতিহাসিক আইনটি পাশ হয়েছিলো।
বিধবা বিবাহ আইনের প্রভাব
বিধবা বিবাহ আইন পাশ হওয়ার পর তা সারা বাংলায় একটি বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর অসংখ্য প্রমান পাওয়া যায়, শিবনাথ শাস্ত্রীর "রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ" গ্রন্থটিতে।
এই গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রী দেখিয়েছেন, বিধবা বিবাহ আইন পাশ হওয়ার পর তা নিয়ে অনেক গান রচনা করা হয়েছিলো। বেশ কিছু গান গরুর গাড়ির চালকদের মুখে মুখে ফিরতো। এই সময় ধনী, গরিব, শিক্ষিত, মূর্খ, ছেলে, মেয়ে, যুবক, বৃদ্ধ সকলের কাছেই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে বিধবা বিবাহ। শান্তিপুরের তাঁতিরা এইসময় "বিদ্যাসাগর পেড়ে" নামে শাড়ি তৈরি করেছিলো, যার পাড়ে লেখা থাকতো -
"সুখে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে
সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবাদের হবে বিয়ে।"
বিধবা বিবাহ নিয়ে এইসময় বেশ কিছু নাটক লেখা হয় এবং কলকাতা রঙ্গমঞ্চেও বিধবা বিবাহ নিয়ে একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। এছাড়া, অনেক পাঁচালিও এইসময় রচনা করা হয়।
এই সমস্ত সাংস্কৃতিক প্রভাব গুলি থেকে সহজেই বুঝে নেওয়া যায়, তৎকালীন সময়ে বিধবা বিবাহ আন্দোলনটি কিভাবে সেই সময়ের মানুষকে প্রভাবিত করেছিলো।
আন্দোলনের চতুর্থ পর্যায় - "বিধবা বিবাহের আয়োজন"
বিদ্যাসাগর জানতেন, শুধু জনসচেতনতার প্রচার বা আইন তৈরি করলেই সমাজে বিধবা বিবাহ প্রতিষ্ঠিত হবে না। এটিকে বাস্তবে প্রয়োগ করে "সামাজিক দৃষ্টান্ত" তৈরি করতে হবে।
বিধবা বিবাহ আন্দোলনের চতুর্থ তথা শেষ পর্যায়ে বিদ্যাসাগর তাই ব্যক্তিগত ভাবে উদ্যোগী হয়ে সমাজে একাধিক বিধবা বিবাহের আয়োজন করেন।
- তার উদ্যোগের ফলে ১৮৫৬ খ্রিঃ ৭ ই ডিসেম্বর, কলকাতার প্রথম বিধবা বিবাহ টি সম্পন্ন হয় শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সঙ্গে কালীমতি দেবীর।
- এর পরের দিনেই পানিহাটি নিবাসী মধুসূদন ঘোষের সঙ্গে কলকাতার ঈশ্বরচন্দ্র মিত্রের ১২ বৎসর বিধবা কন্যার বিবাহ সম্পন্ন হয়।
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ - ১৮৬৭ পর্যন্ত ৬০ টি বিধবা বিবাহের আয়োজন হয়। এই বিবাহ গুলি সম্পন্ন করতে বিদ্যাসাগরের প্রায় ৮০,০০০ টাকা খরচ হয় এবং তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে যান।
যাইহোক, ১৮৫৭ খ্রিঃ সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হলে বিধবা বিবাহ আন্দোলনে ভাঁটা পড়ে। সিপাহী বিদ্রোহ শেষ হবার পর পুনরায় বিধবা বিবাহ সংগঠিত হতে থাকে।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই সময় বিধবা বিবাহের সূত্র ধরে সমাজে পুরুষের বহু বিবাহের বিষয়টি ফিরে আসতে থাকে। অনেক পুরুষ অর্থলোভে প্রথম বার বিধবা বিবাহ করে, দ্বিতীয়বার আরেকটি বিবাহ করে নিতে থাকেন। এজন্য বিদ্যাসাগর বহু বিবাহ রোধ করতে উদ্যোগী হন। এই সময় বিধবা বিবাহে সম্মতদের তিনি একটি অঙ্গীকার করিয়ে নিতেন যে তারা আর দ্বিতীয়বার বিবাহ করবে না। ১৮৭০ খ্রিঃ বিদ্যাসাগর তার নিজের পুত্র নারায়ন চন্দ্রের সঙ্গেও একটি বিধবা কন্যার বিবাহ দেন।
বিদ্যাসাগরের পর ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে বহু তরুন ব্রাহ্ম বিধবা বিবাহ করতে থাকেন। এইভাবেই বিধবা বিবাহ আন্দোলন ধীরে ধীরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিধবা বিবাহ আন্দোলনের গুরুত্ব
বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম -
- সতীদাহ আন্দোলনের পর বিধবা নারীদের সংখ্যা হিন্দু সমাজে যেভাবে অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিলো, বিধবা বিবাহ আন্দোলনের ফলে তার সংখ্যা কিছুটা হলেও হ্রাস পায়।
- বিধবা বিবাহ আইনী স্বীকৃতি লাভ করায় বহু বিধবা নারী পুর্নবিবাহের সুযোগ লাভ করে। ফলে হিন্দু সমাজের নারী ঘটিত ব্যভিচার ও অপরাধের মাত্রা বহুগুন হ্রাস পায়।
- বিধবা বিবাহ আন্দোলন থেকে "পুরুষের বহু বিবাহ" ও "নারীর বাল্য বিবাহের" পরিনাম সম্পর্কে সমাজে সচেতনতা বোধের জাগরন ঘটে।
- ১৮৭২ খ্রিঃ নারী পুরুষের বিবাহের ক্ষেত্রে নূন্যতম বয়সসীমা নির্ধারনের জন্য এইকারনে ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে "তিন আইন" পাশ করা হয়েছিলো।
- কালক্রমে সমাজে বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহের সংখ্যা হ্রাস পেলে বিধবাদের সংখ্যাও হ্রাস পেতে শুরু করে।
- বাংলার বিধবা বিবাহ আন্দোলনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে দক্ষিণ ভারতেও বিধবা বিবাহ আন্দোলন শুরু হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন বীরসালিঙ্গম পনতলু। ১৮৭৮ খ্রিঃ "সোসাইটি ফর সোশ্যাল রিফর্ম" গঠন করে তিনি তেলেগু ভাষী অঞ্চলে বিধবা বিবাহ আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেন। এইজন্য তাকে "দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর" বলা হয়।