উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে সমাজ সংস্কার আন্দোলনে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো ইয়ংবেঙ্গল বা নব্যবঙ্গীয় দের আন্দোলন।
|
ডিরোজিও ও ইয়ংবেঙ্গল
|
সময়কাল
বাংলাদেশে ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিলো উনিশ শতকের কুড়ির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। এটি চলেছিলো উনিশ শতকের চল্লিশের দশকের শেষদিক পর্যন্ত। শিবনাথ শাস্ত্রী বাংলায় "নব্য বঙ্গ যুগ" কে ১৮২৫ থেকে ১৮৪৫ সালের মধ্যে ধরেছিলেন।
তবে খুব সুনির্দিষ্ট ভাবে সাল, তারিখের উল্লেখ করা না গেলেও, মোটামুটি ভাবে এটা বলা যায়, উনিশ শতকের কুড়ি, ত্রিশ ও চল্লিশের দশক ছিলো ইয়ংবেঙ্গলদের চিন্তা, মতাদর্শ ও কর্মকান্ডের যুগ।
সম1য়কালের নিরিখে মাত্র ৩০ বছর স্থায়ী হলেও, এই ৩০ বছরের মধ্যেই ইয়ংবেঙ্গল দল বাংলায় - (১.) নতুন প্রগতিশীল চিন্তাধারা, (২.) যুক্তিবাদ এবং (৩.) চরমপন্থী মতাদর্শ দ্বারা প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সমাজ, ধর্ম এবং প্রচলিত ব্যবস্থার ভিত্তিমূলে তীব্র কুঠারাঘাত করে নবজাগরনের পথ প্রশস্ত করে দেন।
নামকরন
শুরুর দিকে বা সমসাময়িক কালে নব্যবঙ্গীয়রা অবশ্য "নব্য বঙ্গ" নামে পরিচিত ছিলেন না। প্যারিচাঁদ মিত্র ১৮৭৭ খ্রিঃ ডেভিড হেয়ারের জীবন চরিতে এই আন্দোলনের নাম দিয়েছিলেন, "ইয়ং ক্যালকাটা"। শিবনাথ শাস্ত্রী আবার এই আন্দোলনকে "নব্য বঙ্গ" বলে অভিহিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকরা এই আন্দোলনকে নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল নামেই অভিহিত করেন।
সমকালীন সময়ে ইয়ং বেঙ্গলদের অবশ্য অন্য নামেও ডাকা হতো। যেমন -
- কিশোরীচাঁদ মিত্র এদের "কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া" বলে অভিহিত করেছিলেন।
- এছাড়াও নব্যবঙ্গীয়দের উগ্র কার্যকলাপের জন্য অনেকে তাদের - "কালাপাহাড়", উচ্ছৃঙ্খল, সমাজ বিচ্ছিন্ন উগ্র গোষ্ঠী ইত্যাদি নামেও অভিহিত করতেন।
নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সংজ্ঞা ও ভিত্তিভূমি
নব্যবঙ্গ আন্দোলনের প্রানপুরুষ এবং ভিত্তি ভূমি ছিলো - হিন্দু কলেজের তরুন শিক্ষক হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও এবং তার চিন্তাধারা, দর্শন ও মতাদর্শ।
ডিরোজিওর নেতৃত্বে এবং তার মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে হিন্দু কলেজের কিছু তরুন হিন্দু ধর্ম, সংস্কার এবং প্রচলিত সমাজের ওপর শ্রদ্ধা হারিয়ে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরনের মাধ্যমে দেশে এক চরমপন্থী মতাদর্শ প্রচার করতে থাকেন। এদের মতাদর্শ, কর্মকান্ড ও নানা আচার আচরনের ফলে হিন্দু ধর্ম ও সমাজের ভিত কেঁপে ওঠে। এটিই সাধারন ভাবে ইতিহাসে "নব্যবঙ্গ আন্দোলন" বা "ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট" নামে পরিচিত হয়।
ইয়ংবেঙ্গল চক্র
নব্যবঙ্গীয় চক্রের সদস্যদের মধ্যে সকলেই ছিলেন ডিরোজিওর ছাত্র। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন -
- কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়,
- তারাচাঁদ চক্রবর্তী,
- রসিককৃষ্ণ মল্লিক,
- রামগোপাল ঘোষ,
- দক্ষিনারঞ্জন মুখোপাধ্যায়,
- প্যারিচাঁদ মিত্র,
- মাধবচন্দ্র মল্লিক,
- গোবিন্দ চন্দ্র বসাক,
- হরচন্দ্র ঘোষ,
- শিবচন্দ্র দেব,
- রামতনু লাহিড়ি,
- রাধানাথ শিকদার,
- চন্দ্রশেখর দেব প্রমুখ।
ডিরোজিওর মতাদর্শে এরা সকলেই দীক্ষিত ছিলেন বলে ইতিহাসে এরা "ডিরোজিয়ান" নামেই প্রসিদ্ধ হন।
ডিরোজিয়ানরা সংখ্যায় যে খুব বেশি ছিলেন, এমন কিন্তু নয়। খুব বেশি হলে ডিরোজিওর ২০ থেকে ২৫ জন ছাত্রদের নিয়েই ইয়ং বেঙ্গল চক্র গড়ে উঠেছিলো।
মনে রাখতে হবে, ১৮১৭ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজে হিন্দু শিক্ষার্থী ছাড়া অন্য কেউ পড়তে পারতো না। হিন্দুদের মধ্যে পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারের উদ্দেশ্যেই এই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিলো।উনিশ শতকের প্রথম দিকে হিন্দু কলেজের মোট ছাত্র ছিলো ৫০০ জন। এরা প্রায় প্রত্যেকেই রক্ষনশীল হিন্দু পরিবার থেকে এসেছিলেন।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই পরিবার ও প্রচলিত সমাজের বিরুদ্ধে কিছু করবার মতো সাহস বেশিরভাগ ছাত্রদেরই ছিলো না। খুব অল্পই ছাত্র ডিরোজিওর মতাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। সুতরাং অনুমান করা চলে উনিশ শতকে ইয়ংবেঙ্গল চক্রের আয়োতন খুব বেশি বড়ো আকারের কখনই ছিলো না।
তবে আকার আয়তনে ইয়ংবেঙ্গলদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও, ২০ - ২৫ জনের নব্যবঙ্গীয়দের প্রায় সকলেই তাদের মেধা আর যুক্তিবাদী মননের বিদ্রোহ দিয়ে প্রচলিত ঐতিহ্য, কুসংস্কার ও পুরাতনতন্ত্রের ভিত্তি মূলে কুঠারাঘাত করে আধুনিক চিন্তাচেতনা ও প্রগতিশীল ভাবধারার এমন কয়েকটি দিকের ছাপ রেখে যান, যা পরবর্তী কয়েক দশক ধরে বাঙালির মনীষাকে প্রভাবিত করেছিলো।
আর ঠিক এই কারনেই সমসাময়িক কালে নব্যবঙ্গীয়রা যতটা ধিকৃত, নিন্দিত এবং সমালোচিত হয়েছিলেন, পরবর্তীকালে ঐ বিশেষ অবদানের জন্য তারা ততটাই বরনীয় ও স্মরণীয় হিসাবে স্থান করে নেন ইতিহাসের পাতায়।
ডিরোজিওর মতাদর্শ ও ইয়ংবেঙ্গল
আমরা আগেই বলেছি, ডিরোজিয়ানদের মতাদর্শের মূল ভিত্তিভূমি ছিলো ডিরোজিওর নীতি, আদর্শ ও শিক্ষা। ডিরোজিও তার প্রতিটি ছাত্রের মনে যুক্তিবাদ, সত্যানুসন্ধান, এবং ফরাসি বিপ্লবের মূল আদর্শ সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বীজ বপন করে দেন।
সত্যানুসন্ধানের জন্য তিনি প্রতিটি ছাত্রকে যুক্তি দিয়ে সব কিছু বিচার করতে বলতেন এবং সর্বদাই তর্ক করতে উৎসাহিত করতেন। এ প্রসঙ্গে তার স্মরণীয় উক্তি ছিলো - যে তর্ক করে না, সে অন্ধ গোড়ামীতে ভুগছে। যে তর্ক করতে পারে না, সে নির্বোধ। এবং যে তর্ক -ই করে না, সে ক্রীতদাস।
প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তার অভিমত ছিলো - প্রাচীন যা কিছু সব অভ্রান্ত মনে করার কোন কারন নেই। যুক্তি ও তর্কের মধ্য দিয়ে সব কিছু যাচাই করে নিতে শেখো।
মহান ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি ছাত্রদের শিখিয়ে দেন, প্রত্যেক মানুষ নিজের ইচ্ছেমতো স্বাধীন ভাবে জন্মগ্রহণ করে। কারো বলে দেওয়া বিশেষ কোন মুহূর্তে মানুষ জন্মায় না। তুমিও জন্মাও নি। সুতরাং মনে রেখো, স্বাধীনতা প্রত্যেক মানুষের জন্মগত অধিকার। সুতরাং প্রচলিত সমাজের ঐতিহ্য ও সংস্কারের বাঁধন থেকে নিজেদের মুক্ত করে স্বাধীন হয়ে ওঠো। স্বাধীন ভাবে চিন্তা করো। কারো দ্বারা প্রভাবিত হয় না, এমনকি আমার দ্বারাও নয়।
|
ডিরোজিওর সংক্ষিপ্ত পরিচয় |
প্রচলিত সমাজের প্রতি বিদ্রোহ
ডিরোজিওর শিক্ষা ও আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইয়ংবেঙ্গলরা প্রচলিত হিন্দু ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। যুক্তিবাদী দর্শনের আলোকে হিন্দু ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থাকে বিচার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তারা -
- বহুকাল ধরে চলে আসা নারী সমাজের ওপর বৈষম্যমূলক কুপ্রথা গুলির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।
- হিন্দু ধর্মের প্রচলিত রীতি নীতি ও আচার আচরন গুলিকে তারা ভ্রান্ত, অযৌক্তিক ও কুসংস্কার বলে প্রচার করতে থাকেন।
- এছাড়া, কুলীন প্রথা, সতীদাহ প্রথা, বাল্য বিবাহ প্রথা, বহু বিবাহ ইত্যাদি কুপ্রথা গুলির বিরুদ্ধেও তারা সরব হন।
মতাদর্শের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ
ডিরোজিও তার যুক্তিবাদী শিক্ষা ও মতাদর্শকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গিয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করেন -
- এক, একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা, এবং
- দুই, বিভিন্ন পত্র পত্রিকার প্রকাশ।
মাথায় রাখতে হবে, ডিরোজিও সর্বদাই তার অনুগামী ছাত্রদের তর্ক করে সব কিছু যাচাই করে নিতে বলতেন। কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে স্বতন্ত্র ভাবে নিজের মত তুলে ধরতে বলতেন। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলি যথার্থ ভাবে পূরন করবার জন্যই তিনি এগুলি প্রতিষ্ঠায় ছাত্রদের উৎসাহিত করেন এবং মূলত এই দুটি প্রতিষ্ঠানের হাত ধরেই বাংলায় ইয়ংবেঙ্গলদের আন্দোলন ঘনীভূত হয়ে উঠেছিলো।
একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন
১৮২৮ খ্রিঃ (মতান্তরে ১৮২৭) ডিরোজিও ও তার অনুগামী ছাত্ররা প্রতিষ্ঠা করেন - "একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন"। শ্রীকৃষ্ণ সিংহের মানিকতলার বাগানবাড়িতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয় গুলি নিয়ে এই সভায় নানা তর্ক, বিতর্ক ও আলোচনা চলতো। সভায় পৌরহিত্য করতেন ডিরোজিও। বিতর্ক শেষে তার মত ও উপদেশ শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহন করা হতো।
একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন অবশ্য ডিরোজিওর মৃত্যুর পরও ১৮৩৯ খ্রিঃ পর্যন্ত টিকে ছিলো।
মূল উদ্দেশ্য
অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিলো -
- ডিরোজিয়ানদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটানো।
- হিন্দু ধর্ম ও সমাজের কুসংস্কার ও অর্থহীন আচার অনুষ্ঠান গুলির বিরোধিতা করা।
- অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ, নারী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতা এবং ইংরেজ শাসনের ক্ষতিকর দিক গুলি নিয়ে আলাপ আলোচনা ও বিতর্ক করা।
গুরুত্ব
অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিলো তিন টি -
- এটি ছিলো ভারতের প্রথম ছাত্র সংগঠন।
- এই প্রতিষ্ঠানটির মধ্য দিয়ে ডিরোজিও তার আদর্শ ও চিন্তাধারাকে একটি "সংগঠিত" রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
- সামাজিক ত্রুটি ও প্রগতিশীল সমাজ সংস্কারের নানা মৌলিক ভাবনার জন্ম এই প্রতিষ্ঠানের আলোচনা সভা গুলি থেকে উঠে এসেছিলো।
পত্র পত্রিকা ও অন্যান্য সভাসমিতি গঠন
ডিরোজিওর শিষ্যরা নিজেদের চিন্তাধারা প্রকাশের জন্য একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন ছাড়াও বেশ কিছু পত্র পত্রিকা ও সভা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে কিছু ডিরোজিওর জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কয়েকটি হয়েছিলো তার মৃত্যুর পর।
ডিরোজিয়ানদের প্রকাশিত পত্রিকা গুলির মধ্যে ছিলো - পার্থেনন, এনকোয়ারার, জ্ঞানান্বেষন, কুইল, বেঙ্গল স্পেকটেটর, হিন্দু পাইওনিয়ার, পার্থেনন, হেসপেরাস ইত্যাদি।
- পার্থেনন পত্রিকাটি ১৮৩০ খ্রিঃ ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়েছিলো। এতে স্ত্রী শিক্ষা ও হিন্দু ধর্মীয় নানা কুসংস্কার গুলি নিয়ে আলোচনা চলেছিলো।পত্রিকার দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পরই রক্ষনশীলদের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
- এনকোয়ারার পত্রিকাটি প্রকাশ করেন কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়। এতে তিনি প্রাচীনপন্থীদের গোড়ামী মানসিকতাকে তীব্র ভাবে আক্রমণ করেন।
- জ্ঞানান্বেষন পত্রিকাটি প্রকাশ করেন দক্ষিনারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। পত্রিকাটি বাংলা এবং ইংরেজী দুই ভাষাতেই প্রকাশিত হতো। ১৮৪৪ খ্রিঃ পর্যন্ত পত্রিকাটি টিকে ছিলো।
- কুইল পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিলো তারাচাঁদ চক্রবর্তীর উদ্যোগে।
- ১৮৪২ নব্যবঙ্গীয়দের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছিলো আরোও একটি পত্রিকা - বেঙ্গল স্পেকটেটর।
১৮৩৮ খ্রিঃ ডিরোজিয়ানদের উদ্যোগে "সোসাইটি ফর দি একুইজিসন অফ জেনারেল নলেজ" বা "জ্ঞানান্বেষন সমিতি" গড়ে উঠেছিলো। এর সভাপতি ছিলেন তারাচাঁদ চক্রবর্তী। ১৮৪০ - ৪৩ সালের মধ্যে এই সোসাইটিতে পাঠকরা প্রবন্ধ গুলি ৩ টি বৃহৎ গ্রন্থে প্রকাশ করা হয়েছিলো।
১৮৩৯ খ্রিঃ ডিরোজিয়ানরা "মেকানিক্যাল ইনস্টিটিউট" প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৪৪ খ্রিঃ কিশোরীচাঁদ মিত্র গঠন করেন "হিন্দু থিওফিলানথ্রাফিক সোসাইটি"।
রাজনীতির স্রোতে বিলীন হওয়া
মনে রাখতে হবে, ডিরোজিয়ানদের উদ্যোগে গড়ে তোলা এইসব সভা সমিতি গুলির সবগুলিই ছিলো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু চল্লিশের দশকের শেষের দিকে এইসব প্রতিষ্ঠান গুলি রাজনীতির দিকে ঘেষতে শুরু করেছিলো।
আসলে ডিরোজিও তার শিষ্যদের মনে "স্বাধীনতা ও যুক্তিবাদের" যে আগুন প্রজ্বলিত করেন, তা প্রথম পর্বে প্রচলিত হিন্দু সমাজের নানা কুপ্রথাকে দগ্ধ করে অন্তিম পর্বে ধাবিত হয় রাজনৈতিক স্বতন্ত্রবাদের দিকে।
উনিশ শতকের মধ্যভাগে তাই লক্ষ্য করা যায়, রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও তার সংঘবদ্ধ স্রোতের মধ্যে ইয়ংবেঙ্গল দল ক্রমশ বিলিন হয়ে পড়তে থাকে। এইভাবেই ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলনের রূপান্তর ঘটে এবং এই আন্দোলনের অবসান হয়।
ইয়ংবেঙ্গলদের প্রতিক্রিয়াশীল আচরন ও সমাজের প্রতিক্রিয়া
ইয়ংবেঙ্গলরা তাদের যুক্তিবাদী শিক্ষা ও চরমপন্থী মতাদর্শের প্র্যাকটিক্যাল প্রয়োগ ঘটাতে গিয়ে সমাজে এমন কিছু উগ্র কাজকর্মের সৃষ্টি করে, যা প্রচলিত সমাজেই শুধু নয়, সরকারের অভ্যন্তরেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
১৮৩০ খ্রিঃ ১০ ই ডিসেম্বর ইয়ং বেঙ্গল দল টাউন হলে ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবের স্মরনে এক সভা আহ্বান করে। এই সভায় প্রায় ২০০ লোক সমবেত হয়। সভাতে সাম্য আর স্বাধীনতা আদর্শের প্রচারকে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার খুব একটা সুনজরে দেখে নি।
ইয়ংবেঙ্গলদের কাজকর্ম ও আচার আচরন গুলি সমাজও মেনে নিতে পারে নি। ইয়ংবেঙ্গলদের অনেকেই ডিরোজিওর এন্টালীর বাসায় গিয়ে নিষিদ্ধ খাদ্য ও পানীয় খেতেন। কোন কোন সদস্য আবার রাস্তা ঘাটে ব্রাহ্মন দেখলেই তাড়া করতেন এই বলে যে, "আমরা গরু খাই গো"। ইয়ংবেঙ্গলদের মধ্যে কেউ কেউ আবার কালী ঠাকুরকে মাথা নীচু করে প্রনাম করার বদলে বলতেন, "গুড মর্নিং ম্যাডাম"।
প্যারিচাঁদ মিত্রের লেখনী থেকে জানা যায়, ছেলেরা উপনয়নকালে উপবীত বা পৈইতে নিতে চাইতো না। এদের অনেকেই যুক্তিবাদীতার পরিচয় দিতে গিয়ে পৈইতে ত্যাগ করেছিলেন। কোন নব্যবঙ্গীয়কে ভয় দেখিয়ে অথবা প্রহার করে বলপূর্বক উপবীত দিয়ে সন্ধ্যাবেলা সন্ধ্যা আহ্নিক করতে বললে, বেয়াদপি করে তারা হোমারের ইলিয়াড থেকে উদ্ধৃতি আবৃত্তি করতেন।রসিককৃষ্ণ মল্লিক কোর্টে দাড়িয়ে সদর্পে ঘোষনা করেছিলেন, "আমি গঙ্গা জলের পবিত্রতায় বিশ্বাস করি না"।
শুধু তাই নয়, ইয়ংবেঙ্গল দল সমাজে সবধরনের মেকিপনা ও কৃত্রিমতাকেও তীব্র কষাঘাত করেছিলেন। প্রসন্ন কুমার ঠাকুর নিজেকে নাস্তিক এবং রামমোহনের অনুগামী বলে প্রচার করতেন। অথচ সেই তিনিই কিনা দিব্যি দুর্গাপুজায় অংশ নিতেন। ডিরোজিয়ানরা তার এই মেকিপনাকে তীব্র সমালোচনা করেন। এমনকি নব্যবঙ্গীয়রা রামমোহনকেও ছেড়ে কথা বলতেন না।
নব্যবঙ্গীয়দের (১.) একের পর এক প্রথা বিরুদ্ধ কাজ, (২.) হিন্দু ধর্ম ও আচার অনুষ্ঠান গুলিকে অস্বীকার ও আক্রমণ, সর্বোপরি (৩.) গরুর মাংস ও বিয়ারের বোতলের মধ্য দিয়ে উদারনীতিবাদ প্রতিষ্ঠার উচ্ছৃঙ্খল দিকটিতে সমাজে হলুস্থুল পড়ে যায়। কলকাতায় নব্যবঙ্গীয়দের বিরুদ্ধে নানা গালগল্প ও কুৎসা প্রচারিত হতে থাকে।
রক্ষনশীলদের পত্রিকা সংবাদ প্রভাকর ও সমাচার চন্দ্রিকাতে অত্যন্ত অমার্জনীয় ভাষায় হিন্দু কলেজের শিক্ষকদের আক্রমণ করা হয়। তাদের অশিক্ষা ও কুশিক্ষার ফলেই ছেলেরা বিপথগামী হচ্ছে মনে করে দলে দলে অভিভাবকরা হিন্দু কলেজ থেকে ছেলেদের ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে অন্যত্র ভর্তির ব্যবস্থা করতে থাকেন।
ডিরোজিওর পদত্যাগ ও অপসারণ
এই ঘটনায় কলেজের সুনাম নষ্ট হওয়ায় কলেজ পরিচালন কমিটি যাবতীয় দুর্নামের জন্য ডিরোজিওকে দায়ী করেন। পরিচালন কমিটির রক্ষনশীল সদস্যরা ডিরোজিওকে বরখাস্তের প্রস্তাব দেয়। এই ঘটনার কথা শুনে অভিমানী ডিরোজিও ১৮৩১ খ্রিঃ ২৫ এপ্রিল কলেজের অধ্যাপক পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
পদত্যাগ করবার মুহূর্তে রাগে, দুঃখে ডিরোজিও বলেছিলেন, "আমাকে জিজ্ঞাসা না করে, আমার বক্তব্য না শুনে, এমনকি একটা বিচারের প্রহসন না করেও আপনারা আমাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন!"
হিন্দু কলেজ থেকে পদত্যাগের পর অল্প কিছুকাল ডিরোজিও বেঁচে ছিলেন। ১৮৩১ খ্রিঃ ১৭ ডিসেম্বর, কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২১ বছর বয়সে "নবজাগরনের ঝড়ের পাখির" মৃত্যু ঘটে।
ডিরোজিও উত্তর ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলন
ডিরোজিওর মৃত্যুর পর তার আদর্শকে সম্বল করে তরুন নব্যবঙ্গীয়রা আরোও অন্তত ১০/১২ বছর তাদের আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন টিকে ছিলো ১৮৩৯ খ্রিঃ পর্যন্ত।নব্যবঙ্গীয়রা অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে এক একটি পত্রিকা বের করে তাদের মতাদর্শের প্রচার করতে থাকেন। ডিরোজিওর মৃত্যুর পর অবশ্য বেশ কিছু ছাত্রকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো। এমনকি হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধাচারন করবার জন্য অনেক ইয়ংবেঙ্গলকে বাড়ি থেকেও বিতাড়িত করা হয়। কিন্তু এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, নব্যবঙ্গীয়রা কখনই আদর্শচ্যুত হন নি।
নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনে ভাঙ্গন
তবে ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে সংসারের চাপে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের খাতিরে নব্যবঙ্গীয়রা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকেন এবং প্রচলিত সামাজিক স্রোতের সাথে মিশে যেতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যেই নব্যবঙ্গ আন্দোলনে ভাঙ্গন ধরে। অতিরিক্ত পাশ্চাত্য প্রীতিতে অনেকের মনে অবসাদ আসে। অনেকেই আবার নাস্তিকতা থেকে ধর্মের খোঁজ করেন। বহু নব্যবঙ্গীয় খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। এইভাবেই কালের নিয়মে নব্যবঙ্গীয় অধ্যায়ের ইতি ঘটে।
নব্যবঙ্গীয়দের ব্যর্থতার কারন
নব্যবঙ্গীয় আন্দোলন সমাজে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারলেও, সমাজে কোন স্থায়ী সৌধের নির্মান করতে পারেন নি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন।
তাদের এই ব্যর্থতার মূল কারন ছিলো ৩ টি -
(১.) যোগ্য নেতৃত্বের অভাব
নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনের ব্যর্থতার একটি বড়ো কারন ছিলো ডিরোজিওর পর উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাব। ডিরোজিওর আকস্মিক মৃত্যুতে নব্যবঙ্গীয়রা একেবারেই দিশাহীন হয়ে পড়েন। এইসময় একমাত্র ডিরোজিওর আদর্শ ছাড়া তাদের পাশে আর কেউ ছিলেন না।
সমাজ ছিলো তাদের বিরুদ্ধে। পরিবার ছিলো তাদের বিরুদ্ধে। এমনকি দেশের সরকারও ছিলো তাদের মতাদর্শের বিরুদ্ধে। এমতাবস্থায়, সকলকে একসূত্রে ধরে রাখা এবং গেঁথে রাখার জন্য ডিরোজিওর মতো আর একজন যোগ্য উত্তরসূরীর প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু তেমন কেউ না থাকায় নব্যবঙ্গীয়রা পরবর্তীকালে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং এই আন্দোলন ক্রমে ক্রমে দূর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে।
(২.) অতিরিক্ত পাশ্চাত্য প্রীতি
রামমোহন অনুগামীরা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবধারার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে এগোতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নব্যবঙ্গীয়রা প্রাচ্যকে সম্পূর্ণ নসাৎ করে অতিরিক্ত পাশ্চাত্যপ্রীতি দেখান।
ভারতে পাশ্চাত্যবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তারা গোমাংস ভক্ষন করেন, মদ্যপান করেন, পৌত্তলিকতা ও ব্রাহ্মন সংস্কার গুলির বিরোধীতা করতে থাকেন। প্রচলিত সমাজে প্রতিক্রিয়াশীল এইসব পাশ্চাত্যবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে, তারা নিজেরাই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। প্রচলিত সমাজের সমর্থন না থাকায়, নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনের জনভিত্তি ছিলো যথেষ্ট দূর্বল। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই তারা সাফল্য লাভ করতে পারেন নি।
(৩.) প্রচলিতদের স্বার্থে আঘাত
নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনের ব্যর্থতার আরেকটি বড়ো কারন ছিলো রক্ষনশীল হিন্দু সমাজ এবং কোম্পানি সরকারের স্বার্থে আঘাত। নব্যবঙ্গীয়রা হিন্দু ধর্ম ও সমাজকে আক্রমণ করায় রক্ষনশীলরা বেজায় চটেছিলেন। অন্যদিকে ডিরোজিওর শিক্ষা ও মতাদর্শে সরকার ও মিশনারিরাও প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
কেননা এদেশে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো কেরানি বা "আজ্ঞাবহ চাকর" তৈরি করা। অন্যদিকে মিশনারিরা শিক্ষার মধ্যদিয়ে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচার করতে চেয়েছিলেন। শিক্ষার মধ্য দিয়ে ছাত্রদের মনে স্বাধীন চিন্তার খোরাক জোগাতে এদের কেউই চান নি। কারনটা খুবই স্পষ্ট। স্বাধীন চিন্তার উদয় ঘটলে ভারতবাসীকে আর অবদমিত করে পরাধীন রাখা যাবে না।
ডিরোজিও শিক্ষার মধ্য দিয়ে সাম্য, স্বাধীনতা ও যুক্তিবাদের যে প্রদীপের শিখা ছাত্রদের মনে উস্কে দেন, তা প্রচলিত সমাজ ও সিস্টেমের মধ্যে তীব্র উত্তাপের উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই, ইয়ংবেঙ্গলদের বিরুদ্ধে সমাজে সকলে একত্রিত হয়েই প্রত্যাঘাত শুরু করেন। এরই দৃষ্টান্ত স্বরূপ -
- ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
- হিন্দু কলেজে যাতে দ্বিতীয় কোন ডিরোজিওর জন্ম যাতে না হয়, সেইজন্য কলেজের পড়াশোনা নির্দিষ্ট রুটিন ও পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়।
- ডিরোজিওর মৃত্যুর পর তার অনুগামী ছাত্রদের কলেজ এমনকি নিজ নিজ বাড়ি থেকেও বহিষ্কার করা হয়।
ইয়ংবেঙ্গলদের সীমাবদ্ধতা
তবে ইয়ংবেঙ্গলদের ব্যর্থতার পিছনে উপরোক্ত কারনগুলি ছাড়াও, তাদের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও তাদের দুর্বলতার জায়গাগুলিকে অনেক বেশি প্রকট করে তুলেছিল। উদাহরন হিসাবে বলা যায় -
- তাদের চিন্তাধারার বেশিরভাগটাই ছিলো ধ্বংসাত্মক ও নেতিবাচক।
- কোন গঠনমূলক কর্মসূচি বা কার্যক্রম তাদের আন্দোলনের মধ্যে ছিলো না।
- এই আন্দোলন কলকাতা শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।
- বৃহত্তর বাংলা বা গ্রামাঞ্চলে এই আন্দোলনের কোন প্রভাব পড়ে নি।
- মুসলিম সমাজ বা কৃষক সমাজের সঙ্গে তাদের কোন আত্মিক যোগ ছিলো না। ফলে আন্দোলনের জনভিত্তি ছিলো খুবই দুর্বল।
- সবচেয়ে বড়ো কথা, প্রচলিত সমাজের সামাজিক ক্রুটি গুলিকে সংশোধন বা সংস্কারের কথা না বলে তারা সেগুলিকে ধ্বংস করতে চান। প্রচলিত সমাজকে অস্বীকার করে তাদের বিদ্রোহ - পুরো সমাজকেই তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা বিদ্রোহী করে তোলে।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই বৃহত্তর সমাজের পাল্টা প্রত্যাঘাত ও প্রতিক্রিয়ায় শেষপর্যন্ত এই আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনের অবদান
উনিশ শতকে নব্যবঙ্গীয়দের আবির্ভাব "বিদ্যুতের আলোক ছটার" মতো হলেও, তারা -
- প্রচলিত রক্ষনশীল সমাজ ও ধর্ম ব্যবস্থায় একটি আলোড়ন সৃষ্টি করেন।
- প্রচলিত সমাজের কুসংস্কার ও রক্ষনশীল বিষয় গুলিকে আঘাত করে নতুন "চিন্তা ও চেতনার" উৎসমুখ গুলি খুলে দেন।
- স্বাধীন চিন্তা, সাম্যের আদর্শ এবং যুক্তিবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে উনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলন ও নবজাগরনের পথকে প্রশস্ত করেন।
- সমাজের সব শ্রেণী ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তারাই প্রথম সোচ্চার হন।
- সমাজে ছুৎমার্গের বিষয়ে, নারীর যোগ্য সামিজিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে,ঘুষ,তোষামোদ, জালিয়াতি,দ্বিচারিতা প্রভৃতি নানা সামাজিক নীতিহীনতার বিষয়ে তাদের তীব্র ঘৃনা ও প্রতিবাদ জাতিকে দিয়েছিলো আত্মপ্রস্তুতির নির্ভুল পথের ইঙ্গিত
- সামাজিক সাম্যকে শিক্ষা ও সাহিত্যে প্রয়োগ করে তারা এক নতুন স্পন্দন ও উচ্ছাস সৃষ্টি করেন।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি যাতে একচেটিয়া ভাবে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে আবদ্ধ না থাকে, সেদিকে নব্যবঙ্গীয়রা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিলেন।এই জন্য প্যারিচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদার "মাসিক পত্রিকা" নামে এক নতুন স্বাদের পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকায় প্রচলিত সাধু ভাষার পরিবর্তে লেখনীর ক্ষেত্রে চলিত ভাষায় অনুসরন করা হয়েছিলো। উদ্দেশ্য ছিলো সহজ চলিত ভাষায় নারী ও শিশুরা যাতে সহজেই বিষয়বস্তু উপলব্ধি করতে পারেন। এই চলিত স্টাইলেই প্যারিচাঁদ লেখেন, "আলালের ঘরের দুলাল"।
সুতরাং সবশেষে এটা বলা যায়, ইয়ংবেঙ্গল দল সমাজে স্থায়ী কোন নির্মান বা কৃতিত্বের সৌধ নির্মান করতে না পারলেও, সত্যনিষ্ঠা, যুক্তিবাদ, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীন চিন্তাধারার রসায়নে প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার যে পথের রেখা অঙ্কন করা যান, তা পরবর্তী কয়েক দশক বাঙালি মনীষাকে গভীর ভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো।