সতীদাহ আন্দোলনে রামমোহনের ভূমিকা

 সতীদাহ প্রথা নিয়ে উনিশ শতকে শিক্ষিত বাঙালি শ্রেনীর যাবতীয় বৌদ্ধিক চিন্তা ভাবনার সূত্রপাত ঘটান রাজা রামমোহন রায়। ১৮১১ খ্রিঃ রামমোহনের দাদা জগমোহনের মৃত্যু হলে তার স্ত্রীকে জোর করে সহমরনে যেতে বাধ্য করা হয়। এই ঘটনায় রামমোহন অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং প্রতীজ্ঞা করেন, তিনি যেমন করেই হোক এই নিষ্ঠুর প্রথার অবসান করবেন।

 ১৮১৪ খ্রিঃ রামমোহন রায় কলকাতা পাকাপাকি ভাবে চলে আসবার পর কলকাতা অঞ্চলেও সতীদাহ প্রথার ব্যপকতা লক্ষ্য করেন এবং তা নিবারন করবার জন্য ১৮১৮ খ্রিঃ থেকেই সতীদাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। রামমোহন রায় প্রায় ৪৬ বছর বয়সে সতীদাহ আন্দোলন শুরু করেন। 

সতীদাহ আন্দোলনে রামমোহনের ভূমিকা
সতীদাহ আন্দোলনে রামমোহনের ভূমিকা 

সতীদাহ প্রথার নিবারনে রামমোহনের ভূমিকা 

ভারতের ইতিহাসে সতীদাহ প্রথা নিবারনে রাজা রামমোহন রায়ের মৌলিক অবদানের মূল দিক ছিলো ৩ টি - 
  1. রামমোহনই প্রথম দেখান, সতীদাহ প্রথা হিন্দুশাস্ত্র সম্মত কোন প্রথা নয়। 
  2. এই প্রথার সঙ্গে ধর্মের কোন যোগ নেই। এবং এটি হিন্দু ধর্মের একটি কুসংস্কার মাত্র। 
  3.  শাস্ত্রীয় যুক্তিজালের বুনন ঘটিয়ে সতী বিতর্ককে তিনি একটি আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যান এবং এই প্রথার স্বপক্ষে সমস্ত আনুগত্য ও শ্রদ্ধার ভিত্তিমূল নষ্ট করে দেন। এর ফলে খুব সহজেই সরকারের পক্ষে সতীদাহ নিবারনে আইন প্রণয়ন এবং তাকে বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়। 

সতীদাহের বিরুদ্ধে রামমোহনের আন্দোলন 

রাজা রামমোহন রায় (১.) জনমত গঠন (২.) লোকশিক্ষা এবং (৩.) জনসচেতনতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সতীদাহ প্রথার অবসান ঘটাতে চান। 

সতীদাহের বিরুদ্ধে জনমত গঠন

রামমোহন উপলব্ধি করেছিলেন, সার্বিক ভাবে "সামাজিক সচেতনতার" জাগরন ঘটাতে  না পারলে কখনই সতীদাহের মতো একটি সামাজিক ব্যাধিকে প্রচলিত সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব হবে না। তাই সতী আন্দোলনে রামমোহন জনমত গঠনে জোর দেন। এই উদ্দেশ্যে - 
  1. ১৮১৮ খ্রিঃ রামমোহন সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রকাশ করেন তার প্রথম পুস্তিকা - "সহমরন বিষয়ক প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ"। 
  2. ১৮১৯ খ্রিঃ রক্ষনশীল হিন্দুরা "বিধায়ক" নামে পুস্তিকায় রামমোহনের বক্তব্যের বিরোধিতা করলে, রামমোহন সতীদাহের বিরুদ্ধে রক্ষনশীলদের যুক্তি গুলি খন্ডন করে প্রকাশ করেন - "সহমরন বিষয়ক প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ"।
  3. পরে আরোও কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজি পুস্তিকা প্রকাশ করে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এছাড়া, "সম্বাদ কৌমুদি" পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ প্রকাশ করে তিনি জনমত গঠন করতে থাকেন। 

সতীদাহের বিরুদ্ধে রামমোহনের শাস্ত্রীয় যুক্তি

রামমোহন ৩ টি শাস্ত্রীয় যুক্তির মধ্য দিয়ে সতীদাহ আন্দোলন সংগঠিত করেন। তিনি শাস্ত্রীয় যুক্তি ও তথ্যপ্রমান পেশ করে দেখান, সতীদাহ প্রথা সম্পূর্ণই শাস্ত্র বিরোধী একটি প্রথা। শাস্ত্রীয় যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন - 
  1. হিন্দু ধর্মের পালনীয় শাস্ত্র গুলির সবকটিই সহমরনের বিরুদ্ধে। এই শাস্ত্রগুলিতে বিধবাদের ব্রহ্মচর্য পালনের মধ্য দিয়ে সংযমী জীবন যাপনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা না করে বিধবা স্বর্গে স্বামী সঙ্গের লোভে সহমরনে যাচ্ছে। সহমরন আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর শাস্ত্রে বলা হয়েছে, লোভ এবং আত্মহত্যা দুটোই মহাপাপ। সুতরাং সতীদাহ শাস্ত্র সম্মত কোন প্রথা নয়। 
  2. রামমোহন সতীদাহের বিরুদ্ধে তার দ্বিতীয় যুক্তিতে বলেন, সহমরনে গেলে নারী কখনই নির্বান লাভ করতে পারে না। রক্ষনশীলরা সতীদাহের সমর্থনে শাস্ত্রীয় যুক্তি দিয়েছিলো যে, সহমরনে গেলে নারী মুক্তি লাভ করবে। রামমোহন এর পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেন, হিন্দু শাস্ত্রে নির্বান বলতে "যোনী" থেকে মুক্তি লাভকেই বোঝানো হয়েছে। স্বামীর চিতায় মরলে নারী স্বর্গে স্বামী সুখ পাবে ঠিকই, কিন্তু তাতে করে পরজন্মে সে - "নারী" হয়েই জন্মাবে। কেননা সহমরনে নির্বান তথা "যোনী" থেকে মুক্তির কোন বিধান শাস্ত্রে নেই। "যোনী" থেকে মুক্তির জন্য নারীকে কঠিন ব্রহ্মচর্যের মধ্য দিয়ে নারীকে বৈধব্য জীবন পার করতে হবে। 
  3. রামমোহন তার তৃতীয় যুক্তিতে দেখান, সতীদাহের পিছনে আসল কারন হলো সম্পত্তির প্রতি লোভ। হিন্দু শাস্ত্রের দায়ভাগ আইনে স্বামীর সম্পত্তির ওপর স্ত্রীর অধিকার দেওয়া হয়েছিলো। বাংলাদেশে দায়ভাগ ঘরানার আইন প্রচলিত ছিলো। এইজন্য বিধবা নারীর প্রাপ্য সম্পত্তি আত্মসাৎ করবার লক্ষ্যেই আত্মীয় স্বজনরা সতীদাহ প্রথায় উৎসাহ দিতেন। এবং বাংলার অধিকাংশ সতীদাহ সম্পত্তি আত্মসাৎ এর লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়। 

সরকারের কাছে আবেদনপত্র প্রেরন

রামমোহন তার অকাট্য শাস্ত্রীয় যুক্তি গুলি শুধু জনগনের মধ্যে প্রচার করবার ব্যবস্থাই করলেন না, এ সম্পর্কে সরকারকেও অবহিত করতে সচেষ্ট হলেন। ১৮১৯ খ্রিঃ রামমোহন সতীদাহ প্রথা বন্ধের বিরুদ্ধে একটি গন স্বাক্ষর সম্বলিত আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠান। 

সতী প্রথা বন্ধে ব্যক্তিগত উদ্যোগ 

"সতী" আন্দোলনে রামমোহনের ভূমিকা শুধু এইটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। সতীদাহ বন্ধ করতে রামমোহন তার বন্ধু ও অনুগামীদের নিয়ে ব্যক্তিগত স্তরে একটি ছোট দল তৈরি করেছিলেন। যেখানেই সহমরনের খবর পেতেন সেখানেই ছুটে গিয়ে তা বন্ধ করার চেষ্টা করতেন। এইজন্য রামমোহনকে শুধু তিরস্কার, অপমান ও লাঞ্ছনাই ভোগ করতে হয় নি, তার প্রান সংশয় পর্যন্ত হয়েছিলো। 

সতীদাহ বন্ধে বেন্টিঙ্কের উদ্যোগ

  • লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৮ খ্রিঃ ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে আসবার পর সতী আন্দোলন এক নতুন দিকে মোড় নেয়। 
  • উপযোগ দর্শনে বিশ্বাসী বেন্টিঙ্ক মানবিক কারনেই সতীদাহ বন্ধে উৎসাহী হন। রামমোহনের কাছ থেকে যাবতীয় শাস্ত্রীয় যুক্তি লাভ করার পর বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা নিবারনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন।
  • বেন্টিঙ্ক জানতেন, এই নিষ্ঠুর প্রথার অবসান একমাত্র কঠোর সরকারি আইনের পক্ষেই করা সম্ভব। এইজন্য তিনি সতীদাহ বন্ধে আইন প্রণয়নের কথা চিন্তা করেন। 
কিন্তু শুধু আইন তৈরি হলেই তো হবে না। সেই আইনকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে গেলে জনগনের সম্মিলিত প্রতিরোধ ও আক্রমণ নেমে আসতে পারে সরকারের ওপর। পাল্টা মামলাও হতে পারে। তাই বেন্টিঙ্ক আইন প্রণয়নের পূর্বে সমগ্র প্রশাসনের মনোভাব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইলেন। 

এইজন্য তিনি সতীদাহ নিবরন সম্পর্কে ৪৯ জন সুদক্ষ সেনাপতির অভিমত জানার চেষ্টা করলেন। এদের মধ্যে ২৪ জন অবিলম্বে সতীদাহ রদ করার পক্ষে সায় দিলেন। মাত্র ৫ জন কোন পরিবর্তন ঘটানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন না। কাজেই সেনাবিভাগ সম্পর্কে নিশ্চিত হবার পর বেন্টিঙ্ক বিচার বিভাগের মতামত জানার চেষ্টা করলেন। বিচার বিভাগের ৫ জন বিচারকের মধ্যে ৪ জন অবিলম্বে সতীদাহ রদের প্রস্তাবে সায় দিলেন। পুলিশ বিভাগ থেকেও সমর্থন পাওয়া গেলো। দেশীয় লোকেদের মধ্যে রামমোহনের দলও বেন্টিঙ্কের পাশে এসে দাড়ালেন এবং তাকে  সবরকম সমর্থন ও সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। 

সতীদাহ নিবারন আইন প্রণয়ন 

সমস্ত দিক থেকে সাহায্য ও সমর্থন সুনিশ্চিত করে বেন্টিঙ্ক - 
  • ১৮২৯ খ্রিঃ ৪ ঠা ডিসেম্বর ১৭ নং রেগুলেশন আইন দ্বারা সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। 
  • এই আইন অনুযায়ী সতীদাহ প্রথা দন্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষনা করা হয়। 
  • বাংলা ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি ছাড়াও ভারতের অন্যান্য ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলে এই রেগুলেশন কার্যকর করা হয়। 

রক্ষনশীলদের প্রতিক্রিয়া 

  • সতীদাহ নিবারন আইন পাশ হলে রক্ষনশীল সমাজে তীব্র চাঞ্চল্য ও প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। 
  • তারা সতীদাহ আইন প্রত্যাহারের জন্য মোট ১১৪৬ জনের স্বাক্ষর করা দুটি অবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠায়। 
  • এর পাল্টা সতীদাহ নিবারন আইন বহাল রাখার জন্য রামমোহনপন্থীরা ৩০০ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র, এবং মিশনারিদের তরফ থেকে ৮০০ জনের গন স্বাক্ষর করা আরেকটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠানো হয়। 

ধর্মসভা গঠন ও আক্রমণ 

রামমোহনপন্থীদের সরকারকে অভিনন্দনপত্র পাঠানোর পরের দিন রক্ষনশীল হিন্দু সমাজ উপলব্ধি করে হিন্দু সমাজকে সংঘবদ্ধ না করলে সতীদাহ আইন রদ করা যাবে না। 

এই জন্য ১৮৩০ খ্রিঃ ১৭ জুন, প্রতিষ্ঠিত হয় রক্ষনশীল সংঘ "ধর্মসভা"। প্রথম দিনেই এই সভাতে সতীদাহের স্বপক্ষে ১১,২৬০ টাকা চাঁদা ওঠে। রক্ষনশীলদের মুখপত্র "সমাচার চন্দ্রিকা" রামমোহনকে তীব্র ভাবে আক্রমন শুরু করে। এর প্রতিবাদ স্বরূপ রামমোহন প্রকাশ করেন, "সহমরন বিষয়ক তৃতীয় প্রস্তাব"। এখানে তিনি সতীদাহের সমর্থনে নতুন করে রাখা ১২৮ জনের যুক্তি খন্ডন করেন। 

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আপীল 

গোঁড়া হিন্দু সমাজ ভারতবর্ষ থেকে সতীদাহ নিবারন আইন রদ হওয়া সম্ভব নয় ভেবে, এই আইন রদের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আপীল করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যাতে রক্ষনশীলদের কথা শুনে সতীদাহ নিবারন আইন ভেস্তে না দেন, তা সুনিশ্চিত করবার জন্য রামমোহন ১৮৩০ খ্রিঃ বিলাত যাত্রা করেন। 

ফলস্বরূপ, ১৮৩২ খ্রিঃ ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিল বাংলার গভর্নর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের ১৮২৯ খ্রিঃ আইন বলবৎ রাখেন। রক্ষনশীলদের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়। 

সতীদাহ আন্দোলনের গুরুত্ব

ভারতের ইতিহাসে সতীদাহ আন্দোলনের গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। যেমন - 
  1. উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সংগঠিত সতীদাহ আন্দোলন ছিলো বাংলার প্রথম সমাজ সংস্কার আন্দোলন
  2. এই আন্দোলনের ফলে ভারতের ইতিহাসের হাজার বছরের একটি সামাজিক কুপ্রথার অবসান ঘটে। 
  3. সতীদাহ আন্দোলনের ফলে ভারতে অন্যান্য নারী সংস্কার গুলির দরজা খুলে যায়। 
  4. সতীদাহ প্রথা রদ হওয়ায় সমাজে বিধবাদের সংখ্যা কয়েক গুন বৃদ্ধি পায়। ফলে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায় এবং বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে আন্দোলন শুরু হয়। 
  5. অন্যদিকে নারীদের বৈধব্য যন্ত্রনা লাঘব করতে সমাজে  বিবাহের অসম ব্যবধান দূর করবার জন্যও আন্দোলন শুরু হয়।এসবই ছিলো সতীদাহ আন্দোলনের পরোক্ষ ফল। 

সতীদাহ আন্দোলন সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য 

  1. সতীদাহ প্রথাকে সমর্থন করে এমন একটি পত্রিকা হলো - সমাচার চন্দ্রিকা। 
  2. সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করে এমন দুটি পত্রিকা হলো - সমাচার দর্পন ও ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া। 
  3. সতীদাহ প্রথা রদ হয় - ১৮২৯ খ্রিঃ ১৭ নং রেগুলেশন আইন আনুযায়ী। 
  4. সতীদাহ আইন পাশ হয় - লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আমলে।
  5. সতীদাহের বিরুদ্ধে লেখা রামমোহনের বই - সহমরন বিষয়ক প্রবর্ত্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ। (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়)। 
  6. সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করবার জন্যই রক্ষনশীল হিন্দুরা ধর্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন।

1 Comments

  1. Sir kub valo laglo ata pora thank you so much for this Anwer.

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post