ব্রাহ্মসমাজের অবদান ও গুরুত্ব

উনিশ শতকে "হিন্দু ধর্মের গর্ভগৃহ" উপনিষদের বুদবুদ থেকে যে ব্রাহ্মসমাজের জন্ম হয়েছিলো, তা হিন্দু ধর্মের মূল নির্যাস ও সুবাস ছড়িয়ে দিয়ে প্রচলিত হিন্দু ধর্মের স্রোতেই বিলিন হয়ে পড়ে। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের এই উদ্ভব, বিবর্তন ও তার মিথস্ক্রিয়া প্রচলিত সমাজের চিন্তা চেতনায় এক গভীর পরিবর্তন নিয়ে আসে। কালের স্রোতে বড়ো পাথর ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যেমন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে। পথের নির্মান করে। ব্রাহ্ম সমাজও তেমনি তার ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে ভাবিকালের জন্য রেখে যায় নতুন ভাবনা আর সম্ভাবনার পথ। 

ব্রাহ্ম সমাজের অবদান ও গুরুত্ব
ব্রাহ্ম সমাজের অবদান ও গুরুত্ব 

ব্রাহ্ম সমাজের অবদান ও গুরুত্ব 

 উনিশ শতকে ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন প্রায় ৬০ বছর ধরে (১৮২৮ - ১৮৮৪) চলেছিলো। এই সময়কালের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন মূলত শহর এলাকার শিক্ষিত শ্রেনীর মধ্যেই প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলো। গ্রামাঞ্চলেসমাজের সর্বস্তরের মধ্যে এই আন্দোলনের তেমন কোন প্রভাব পড়ে নি। তবে প্রভাব না পড়লেও, ব্রাহ্মসমাজের সুফল থেকে অবশ্য সমাজের কোন অংশই বঞ্চিত হয় নি। 

এককথায়, ব্রাহ্ম সমাজের আন্দোলন সমগ্র উনিশ শতকের ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, নারী মুক্তি এমনকি রাজনৈতিক আন্দোলনের ওপর এক ব্যাপকসুদূরপ্রসারী অবদানের ছাপ রেখে যায়। 

সংক্ষেপে এই অবদানের প্রধান দিক গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -

(১.) ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রভাব

ব্রাহ্ম সমাজের আন্দোলন ভারতে হিন্দু ধর্মের পুর্নজাগরনে বিশেষভাবে সাহায্য করে। ব্রাহ্ম সমাজের একেশ্বরবাদসমন্বয়বাদ খ্রিষ্টান ধর্মকে চ্যালেঞ্জ জানায়। ফলে বহু শিক্ষিত তরুন খ্রিষ্টান ধর্মের মোহ থেকে বেরিয়ে এসে ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন ও তাতে দীক্ষিত হন। পরবর্তীতে কালের বিবর্তনে ব্রাহ্মসমাজ খন্ড বিখন্ড হয়ে হিন্দু ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়লে, শিক্ষিত ব্রাহ্মরাও প্রচলিত হিন্দু ধর্মের স্রোতে মিশে যান। 

এইভাবে ব্রাহ্মসমাজ উনিশ শতকে - 

  •  খ্রিষ্টান ধর্মের আগ্রাসন থেকে হিন্দুধর্ম কে রক্ষা করে। 
  • প্রচলিত হিন্দু ধর্মের সংস্কার করে। 
  • একেশ্বরবাদ ও সমন্বয়বাদী আদর্শের প্রভাবে হিন্দু ধর্মকে নব শক্তিতে বলীয়ান করে তোলে। 
হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি ব্রাহ্মসমাজ মুসলিমদের ধর্মীয় পুর্নজাগরনের ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী অবদানের বীজ বপন করে যায়। কেশবচন্দ্র সেনের নির্দেশে ব্রাহ্ম গিরিশ চন্দ্র সেন প্রথম আরবী থেকে বাংলা ভাষায় কোরানের অনুবাদ করেন, যা পরবর্তীকালে বঙ্গীয় মুসলিমদের "ধর্মীয় আইডেন্টিটি" রচনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিলো।

(২.) সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রভাব

ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রভাবেই মূলত ভারতে ব্যাপক আকারে সমাজ সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় -
  1. ব্রাহ্ম সমাজের নেতারা তাদের বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও সভা সমাবেশে হিন্দু সমাজের নানা কুপ্রথা গুলিকে আক্রমণ করেন।
  2. তারা বুদ্ধি ও যুক্তির সাহায্যে হিন্দু সমাজের নানা কুসংস্কার গুলিকে খন্ডন করেন, সেগুলির বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করেন এবং পুরাতন কুসংস্কার গুলির প্রতি  শিক্ষিত সমাজের শ্রদ্ধা ও অনুগত্য নষ্ট করে দেন। 
  3.  জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, কুলীন প্রথা ইত্যাদি কুসংস্কার গুলিকে তারা ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার অবক্ষয়ের মূল কারন বলে চিহ্নিত করেন।
  4. ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাবে ১৮৭২ খ্রিঃ "ব্রাহ্ম বিবাহ আইন" পাশ হয়। এই আইন দ্বারা বিবাহের নূন্যতম বয়স নির্দিষ্ট করে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রোধ করা হয় এবং অসবর্ন বিবাহের প্রচলন করা হয়।
  5. ১৮৫৬ খ্রিঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তিত হবার পর ব্রাহ্ম সমাজ সমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য ব্যপক ভাবে উদ্যোগী হয়।
  6. এগুলি ছাড়াও তৎকালীন সমাজে মদ্যপানের কুফল দূর করতেও ব্রাহ্মসমাজ কাজ করে। "মদ না গরল" নামে পত্রিকার মাধ্যমে এ বিষয়ে ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে জনসচেতনতার জন্য প্রচার করা হয়।

(৩.) নারী শিক্ষা ও সাধারন শিক্ষার বিস্তার 

ব্রাহ্ম সমাজের আন্দোলন ছিলো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনীর আন্দোলন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষার প্রসারে এই সমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। 
  • নারী মুক্তি আন্দোলনকে জোরদার করবার জন্য ব্রাহ্মসমাজের নেতারা নারী শিক্ষা বিস্তারে জোর দেন 
  • ব্রাহ্মবন্ধু সভা, ব্রাহ্মিকা সমাজ, বামাবোধিনী সভা ও পত্রিকা, পরিচারিকা সভা ও পত্রিকা, নেটিভ লেডিজ নর্মাল স্কুল (১৮৭১), ব্রাহ্ম গার্লস স্কুল ইত্যাদির মাধ্যমে ব্রাহ্মসমাজ নারী শিক্ষার বিস্তারে গুরুত্ব আরোপ করে। 
  • নারী শিক্ষা ছাড়াও সাধারন শিক্ষা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা, বয়স্কদের শিক্ষা, মাতৃভাষায় শিক্ষাদান ইত্যাদি বিষয়েও ব্রাহ্মসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
  • বৃত্তিমূলক শিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মসমাজ ১৮৭০ - ৭১ খ্রিঃ একটি শিল্প বিদ্যালয় স্থাপন করে। এছাড়া, জনশিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে এক পয়সা মূল্যের "সুলভ সমাচার" "মদ না গরল" ইত্যাদি পত্রিকাও প্রকাশ করেন। 

(৪.) নারী মুক্তি আন্দোলনে প্রভাব

স্ত্রী স্বাধীনতা ও নারী মুক্তি আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজ এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্রাহ্ম সমাজের প্রচেষ্টার ফলেই প্রকৃতপক্ষে নারীরা - 
  • গৃহস্থ অন্তপুর থেকে বাইরের জগতে পদার্পণের সুযোগ লাভ করে। 
  • পর্দাপ্রথার বেড়াজাল থেকে মুক্তি লাভ করে। 
  • পুরুষের সাথে একত্রে প্রকাশ্য সভায় অংশগ্রহণ, সম অধিকার ও মর্যাদা লাভের অধিকার লাভ করে। 
  •  স্বাধীন ভাবে নিজেদের মতামত প্রকাশের অধিকার ও সাধারন ব্রাহ্মসমাজে ভোটদানের অধিকার লাভ করে। 
ব্রাহ্ম সমাজের সূত্রে প্রাপ্ত এই সমস্ত অধিকার গুলি ভারতে নারী মুক্তি আন্দোলনে  এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। একথা ঠিক ব্রাহ্মসমাজের সূত্রে প্রাপ্ত এই সমস্ত নারী অধিকার গুলির সুযোগ একমাত্র ব্রাহ্মসমাজের মেয়েরাই লাভ করেছিলেন। কিন্তু তার সুফল থেকে ভারতের সাধারন নারী সমাজও বঞ্চিত হয় নি।কেননা ব্রাহ্মসমাজের নারী মুক্তি আন্দোলনের ফলে মুষ্টিমেয় যে প্রগতিশীল নারী নেতৃত্বের জন্ম হয়, তারাই পরবর্তীকালে অবশিষ্ট নারী সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। 

মনে রাখতে হবে, ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক থেকে মহিলা চিকিৎসক, এদের সকলেই ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের অন্তর্ভুক্ত নারী। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজভুক্ত অনেক মেয়ে জাতীয় আন্দোলন ও জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়ে নেতৃত্ব দেন, বক্তৃতা করেন, প্রকাশ্য জনসভায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন, এমনকি সমুদ্রপার অর্থাৎ বিদেশযাত্রা করে স্বাধীন ভাবে নিজেদের স্বামী নির্বাচন করে নারী সমাজকে এক নতুন বিপ্লব ও প্রগতির দিকে পৌঁছে দেন। 

(৫.) নারীদের পোশাক ও পরিধান রীতিতে প্রভাব

ব্রাহ্ম আন্দোলনের ফলে বাঙালি নারীদের পোশাক পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে এক বিরাট বদল আসে। পূর্বে অর্ন্তবাস ছাড়াই নারীরা শাড়ি পরিধান করতেন। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের প্রভাবে বাইরের জগতে নারীদের প্রবেশ ঘটতে থাকে। ফলে তাদের জন্য প্রয়োজন পড়লো এক রুচিশীল পোশাকের। 

এক্ষেত্রে মেয়েদের রুচিশীল পোশাক নির্মানে উল্লেখযোগ্য কাজ করে ব্রাহ্ম জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ীর মেয়েরা। ব্লাউজ ও কুচি দিয়ে শাড়ি পড়াবার প্রচলন এই সময় প্রচলিত হয়। এই পোশাক বিধি পরবর্তীকালে এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, তা সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। 
  

(৬.) শ্রমিক শ্রেণীর কল্যান সাধন ও সমাজসেবা

ভারতে শ্রমিক শ্রেণীর কল্যান সাধনের জন্য ব্রাহ্মসমাজই প্রথম উদ্যোগী হয়। এক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজের উল্লেখযোগ্য অবদান গুলি ছিলো নিন্মরূপ - 
  • বরানগরে ব্রাহ্ম শশীপদ বন্দোপাধ্যায় "ভারত শ্রমজীবী" নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীকে জাগরিত করার চেষ্টা করেন। 
  • ব্রাহ্ম দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় আসামের চা বাগানের কুলিদের সংঘবদ্ধ করতে উদ্যোগী হন। 
  • রামকুমার বিদ্যারত্ন "কুলি কাহিনী" নামক গ্রন্থে ভারতীয় কুলি ও শ্রমজীবীদের ওপর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী তুলে ধরেন। 
  • শ্রমিকদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে একটি নৈশ্য বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। 
  • শিবনাথ শাস্ত্রী শ্রমিকদের কল্যানের জন্য  ব্রাহ্মসমাজের কাছে পৃথক সংগঠন গড়ে তোলার কথা বলেন। 
ব্রাহ্ম সমাজের এই কর্মসূচি ভারতে শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণী সচেতনতার প্রসারে ও শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনে প্রভূত সাহায্য করে। জাতীয় আন্দোলন গুলিতে এর ফলে শ্রমিক সমস্যার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করতে শুরু করেছিলো। 

শ্রমিক শ্রেণীর কল্যান ছাড়াও, দেশে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত দুর্ভিক্ষ, বন্যা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় গুলিতে আর্ত মানুষদের সেবা, সাহায্য ও ত্রান বন্টন করে ব্রাহ্মসমাজ ভাবিকালের জন্য এক উল্লেখযোগ্য সমাজ সেবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যায়। 

(৭.) হরিজনদের কল্যান সাধন

ব্রাহ্মসমাজ অস্পৃশ্যতা দূরীকরনে এবং সামাজিক অছুৎ শ্রেনীর কল্যান সাধনে বিশেষ ভাবে তৎপর হয়। মহাত্মা গান্ধীর বহু পূর্বেই  ব্রাহ্মসমাজ এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়। 
  • এক্ষেত্রে বাংলা আসাম ও মহারাষ্ট্রের ব্রাহ্মসমাজ গুলির উদ্যোগে হরিজনদের শিক্ষার জন্য একাধিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। 
  • এছাড়া, হরিজনদের জন্য আবাসগৃহ, ও দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 
  • পাহাড়ী উপজাতি খাসি, এজভা, হাড়ি, পঞ্চম ও মেথরদের মধ্যে নানা উন্নয়নমূলক কাজেও ব্রাহ্মসমাজ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।

(৮.) চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে প্রভাব

ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যরা ইন্ডিয়ান মিরর, ব্রাহ্ম পাবলিক ওপিনিয়ন, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, সঞ্জীবনী, মর্ডান রিভিউ, প্রবাসী ইত্যাদি পত্র পত্রিকার মধ্য দিয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন এবং নতুন চিন্তাধারা দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দেন। 
  1. তারা প্রাচ্যের যা কিছু শ্রেষ্ঠ তার সঙ্গে পাশ্চাত্যের সমন্বয়বাদের কথা প্রচার করেন। 
  2. রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার সঙ্গে সমাজ কল্যাণ ও সমাজ সংস্কারের ধারনাকে যুক্ত করেন। 
  3. সাধারন ব্রাহ্মসমাজে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ব্যবস্থা করে গনতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার প্রসার ঘটান।
  4. ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের মতো ব্যক্তিগত গুনাবলীর বিকাশ ঘটান। 
  5. ব্রাহ্ম আন্দোলন যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের জাগরন ঘটায় তা পরে রাজনৈতিক চেতনায় রূপান্তরিত হয়। 
এইভাবে দেখা যায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা, জাতীয় ও সামাজিকঐক্য, প্রত্যেক মানুষের যোগ্য মর্যাদা ও অধিকারের কথা বলে এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান গুলির গনতন্ত্রীকরনের কথা বলে ব্রাহ্মসমাজ জনমনে এক নতুন চেতনার সঞ্চার করে। 

 (৯.)  রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব 

ব্রাহ্ম সমাজের আন্দোলন ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের আন্দোলন হলেও, রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদানের সাক্ষ্য রাখে। রাজনৈতিক কর্মসূচিকে বাদ দিয়ে কখনই পরিপূর্ণ অর্থে সমাজ সংস্কার করা যায় না - এই সত্য দেশবাসীর সামনে ব্রাহ্মসমাজের নেতারাই প্রথম তুলে ধরেন। ব্রাহ্মসমাজের নেতারা বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে - 
  1. এদেশের গ্রামীন সমাজের নানা সমস্যার কথা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেন। 
  2. বাংলায় জমিদারদের অত্যাচারকৃষকদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। 
  3. দেশের শিল্প বানিজ্যের পুনরুজ্জীবনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। 
  4.  প্রশাসনের উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগের কথা বলেন। 
  5. ব্রিটিশ প্রশাসনের অযৌক্তিক দিক গুলি নিয়ে সমালোচনা করেন। 
  6. ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও কার্যকরী পদক্ষেপের জন্য শিক্ষিত ভারতীয়দের সংঘবদ্ধ করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। 
পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজের দেখানো এই পথের মধ্য দিয়ে আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলন ঘনীভূত হয়ে উঠেছিলো। 

(১০.) জাতীয়তাবাদের প্রসার 

ব্রাহ্ম সমাজ এদেশে জাতীয়তাবাদের জাগরনের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদানের ছাপ রাখে। এক্ষেত্রে আদি ব্রাহ্মসমাজের কথা বলা যেতে পারে। আদি ব্রাহ্মসমাজের হিন্দু ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির চর্চার ফলে ভারতে হিন্দু ঐতিহ্যবাহী জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে। 

যদিও এই জাতীয়তাবাদকে মুসলিম সমাজের একাংশ মেনে নিতে পারেন নি। এবং এই কারনে জাতীয় আন্দোলনের ধারা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন থাকবার নীতি নেন। পরবর্তীকালে এই জাতীয়তাবাদের পাল্টা মুসলিম সমাজের মধ্যেও স্বতন্ত্রবাদী জাতীয়তাবাদী ভাবধারার উদ্ভব হয়, যা শেষপর্যন্ত দেশকে ভাঙ্গনের দিকে নিয়ে যায়। 

 উপসংহার 

এইভাবে দেখা যায়, সারা উনিশ শতক জুড়ে এবং তার পরবর্তীকালে বিংশ শতাব্দীতে যে যে প্রধান ঘটনা গুলি ভারতীয় ইতিহাসের ধারাকে প্রভাবিত করেছিলো, তার সবগুলিরই বীজ ব্রাহ্মসমাজ বপন করে গিয়েছিলো। এই জন্য উনিশ শতকে ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনকে ভারতের ইতিহাসের একটি কেন্দ্রীয় ঘটনা হিসাবেই দেখা হয় ও বিশ্লেষন করা হয়ে থাকে। 

সমাপ্ত।। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post