আধুনিক ভারতের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় ছিলো এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন।
১৭৬৫ খ্রিঃ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলাদেশের দেওয়ানী ক্ষমতা লাভ করবার পরেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভূমি রাজস্ব সম্পর্কে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালায় এবং একাধিক ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা |
প্রথম পর্বে কোম্পানির ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা
দেওয়ানী লাভের পর প্রথম পর্বে ১৭৬৫ থেকে ১৭৭২, প্রায় ৭ বছর কোম্পানি সরাসরি দেওয়ানীর ক্ষমতা নিজের হাতে গ্রহন করে নি। এই সময় সে মুঘল ব্যবস্থাই বজায় রাখে এবং বাংলার ভূমি রাজস্ব আদায়ের জন্য মুঘল কর্মচারী রেজা খাঁ ও সিতাব রায়কে "দেওয়ান" নিযুক্ত করে।
রেজা খাঁ ও সিতাব রায় "আমিলদার" নামে কর্মচারী নিযুক্ত করে চুক্তি ভিত্তিক রাজস্ব আদায় শুরু করেন। এই সময় তীব্র শোষন ও অত্যাচার চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ভূমিরাজস্ব আদায় করা হয়।
দেওয়ানী লাভের পরের বছর ভূমি রাজস্ব আদায় ৬৫ লক্ষ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১১৭ লক্ষ টাকা। এর পরিমান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। শেষ পর্যন্ত তীব্র আর্থিক শোষনে ১৭৭০ খ্রিঃ বাংলায় "ছিয়াত্ত্বরের মন্বন্তর" দেখা যায়। এই মন্বন্তরে বাংলায় তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ মারা যায় এবং সমগ্র গ্রাম বাংলা শ্মশানে পরিনত হয়।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ভূমিকা
এই সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে (১.) বাংলার ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং (২.) ভূমি রাজস্বের দায়িত্ব সম্পর্কে কোম্পানির নির্লিপ্ত নীতির কঠোর সমালোচনা করা হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার শাসন ও দেওয়ানীর দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালনের নির্দেশ দিয়ে ওয়ারেন হেস্টিংসকে ভারতে পাঠানো হয়।
হেস্টিংসের প্রবর্তিত ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা
১৭৭২ খ্রিঃ বাংলার গর্ভনর জেনারেল হয়ে আসেন ওয়ারেন হেস্টিংস। বাংলার বিশৃঙ্খল ও অরাজক অবস্থা দূর করতে তিনি একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন -
- প্রথমেই তিনি বাংলার "নবাব" ও "দেওয়ান" পদ দুটি তুলে দিয়ে বাংলায় কোম্পানির প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
- বাংলায় দেওয়ানীর ক্ষমতা রেজা খাঁ ও সিতাব রায়ের হাত থেকে সরাসরি কোম্পানির হাতে গ্রহন করেন।
- এরপর গর্ভনর কাউন্সিলের ৪ জন সদস্যকে নিয়ে ভূমি রাজস্ব বন্দোবস্তের জন্য একটি "ভ্রাম্যমান কমিটি" গঠন করেন।
পাঁচশালা বন্দোবস্ত
পাঁচশালা বন্দোবস্তের ত্রুটি
- এই ব্যবস্থায় যারা জমি লাভ করেছিলেন, তাদের অনেকেই ছিলেন বেনিয়া।
- জমির সঙ্গে এদের কোন আত্মিক সম্পর্ক ছিলো না।
- এরা উচ্চ মূল্যে সরকারকে ভূমি রাজস্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও পাঁচ বছরের আগেই ভূমি রাজস্ব লুঠ করে পালিয়ে যান।
একশালা বন্দোবস্ত
- একবছরের চুক্তিতে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়।
- জমি বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে ইজারাদারদের বদলে জমিদারদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
- তিন বছরের আদায়ীকৃত রাজস্বের গড়ের ভিত্তিতে ভূমি রাজস্ব স্থির করা হয়।
কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা
- প্রতি বছর জমি বন্দোবস্ত দেওয়া কোম্পানির কাছে খুবই ঝামেলার একটি বিষয় ছিলো।
- এমনিতেই তখন কোম্পানির লোকবল ছিলো যথেষ্ট কম।
- তাছাড়া, মাত্র একবছর হাতে পাওয়ায় জমিদারেরাও ঠিকভাবে রাজস্ব আদায় করে উঠতে পারতেন না।
গ্রান্ট - শোর বিতর্ক
- এই সময় রাজস্ব বিভাগের প্রধান স্যার জন শোর জমিদারদের সঙ্গে স্থায়ী ভূমি বন্দোবস্তের প্রস্তাব দেন।
- অন্যদিকে কোম্পানির দলিল বিভাগের প্রধান জেমস গ্রান্ট এর বিরোধীতা করে সরাসরি কৃষকদের সঙ্গে স্থায়ী ভূমি বন্দোবস্তের কথা বলেন।
- ভূমি রাজস্ব আদায়ের ঐতিহ্যের সঙ্গে জমিদাররা দীর্ঘ দিন ধরেই জড়িত।
- এর ফলে কৃষি ও কৃষকেরও কল্যান হবে।
- জমিদাররা ব্রিটিশ সরকারের সমর্থক ও অনুগত একটি অভিজাত শ্রেনী হিসাবে গড়ে উঠবে।
দশশালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন
- জমিদারদের ওপর ধার্য রাজস্বের হার চিরদিনের জন্য চিরস্থায়ী থাকবে।
- জমিদাররা বছরের নির্দিষ্ট দিনে এই স্থায়ী রাজস্ব দিয়ে দিলে, তাদের জমিদারি স্বত্ত্বও চিরস্থায়ী থাকবে। তাদের উচ্ছেদ করা হবে না, এবং বংশানুক্রমিক ভাবে তারা জমি ভোগদখল করতে পারবে।
- সূর্যাস্ত আইন অনুযায়ী বছরের নির্দিষ্ট দিনে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে জমিদারদের রাজস্ব পরিশোধ করতে হবে।
- খরা, বন্যা, বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে রাজস্ব মুকুব করা হবে না।
ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা
- (১.) রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত,
- (২.) মহলওয়ারি বন্দোবস্ত,
- (৩.) ভাইয়াচারি বন্দোবস্ত ইত্যাদি।
(১.) রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত
- উৎপাদনের ভিত্তিতে জমিকে ৯ টি ভাগে ভাগ করে রাজস্ব ধার্য করা হয়।
- ৩০ বছরের জন্য স্থায়ী রাজস্বের হার নির্দিষ্ট করা হয়।
- এই ব্যবস্থায় জমির মালিকানাস্বত্ব সরকারকে দেওয়া হয়। কৃষকরা শুধু জমির ভোগদখলের অধিকারী ছিলো।
- রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতেন সরকারি কর্মচারীরা।
(২.) মহলওয়ারি বন্দোবস্ত
- ২০ - ৩০ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়।
- উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ অর্থমূল্যে সরকারকে খাজনা দিতে হতো।
- রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের মতো এখানেও জমিদারের মতো কোন মধ্যসত্ত্বভোগীর অস্তিত্ব ছিলো না।
(৩.) ভাইয়াচারি বন্দোবস্ত
- প্রত্যেক চাষীর ওপর পৃথক ভাবে রাজস্ব ধার্য করা হয়েছিলো।
- চাষীদের কাছ থেকে গ্রামের একজন প্রধান ব্যক্তি রাজস্ব সংগ্রহ করে তা সরকারের হাতে তুলে দিতেন।
- কয়েক বছর পর পর সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী রাজস্বের হার বাড়ানো হতো।
ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার ফলাফল
- কৃষকরা জমির মালিকানা হারায়।
- অধিকাংশ ক্ষেত্রে জমিদার বা সরকার জমির মালিকে পরিনত হয়।
- ফলে ভূমি রাজস্ব প্রদানে অপারক কৃষকরা নির্মম শোষন ও নির্যাতনের শিকার হয়।
- সহজেই তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।
- প্রায় প্রতিটি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাতেই একাধিক মধ্যসত্ত্বভোগীর সৃষ্টি হয়, এবং তাদের দ্বারা কৃষকরা নানা ভাবে নির্যাতিত হতে থাকে।
- প্রতিটি ভূমি রাজস্বেই অতি উচ্চ হারে রাজস্ব ধার্য করা হয়, যা দেওয়ার পর কৃষকদের পক্ষে অর্ধাহারে থাকা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিলো না।
- ইংরেজরা নগদে অতি উচ্চ হারে ভূমি রাজস্ব ধার্য করায় কৃষকরা মহাজনদের ঋনের কবলে পড়ে যায়।
- গ্রামীন অর্থনীতিতে মহাজনী কারবার ফুলে ফেঁপে ওঠে এবং মহাজনদের কবলে পড়ে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে যায়।
- গ্রামীন অর্থনীতিতে ভাঙ্গন দেখা যায়। তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে বৃহৎ যৌথ পরিবারে ভাঙ্গন ধরে।
- নায়েব, গোমস্তা, মহাজনদের উৎপীড়নে সহজ ও শান্ত গ্রাম সমাজে অস্থিরতা দেখা যায়।
- তীব্র আর্থিক শোষন ও অত্যাচারের ফলে একের পর এক কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত হতে শুরু করে।
Nice post
ReplyDelete