নববিধান ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ

১৮৬৬ খ্রিঃ অখন্ড ব্রাহ্মসমাজকে ভেঙ্গে কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে যে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, তা মাত্র ১২ বছর টিকে থাকতে পেরেছিলো। উনিশ শতকের সত্তরের দশকে ব্রাহ্মসমাজ পুনরায় ভাঙ্গনের মুখে পড়ে। এই সময় ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ "নববিধান" ও "সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ" এই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ব্রাহ্মসমাজের এই ভাঙ্গনের ক্ষেত্রকে ত্বরান্বিত করেছিলেন দক্ষিণেশ্বরের পাগলা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। 

নববিধান ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ
নববিধান ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ 

কেশবচন্দ্রের রামকৃষ্ণদেবের সান্নিধ্য লাভ 

উনিশ শতকে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে রামকৃষ্ণ দেবের আবির্ভাব একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিলো। 

কেশবচন্দ্র সেন রামকৃষ্ণদেবের সান্নিধ্যে আসেন ১৮৭৫ খ্রিঃ মার্চ মাসে। কলকাতায় তখনও শ্রীরামকৃষ্ণের খ্যাতি সেভাবে ছড়িয়ে পড়ে নি। রামকৃষ্ণদেবের সান্নিধ্যে এসে কেশবচন্দ্রের সমস্ত অহংকার ও ব্রহ্ম উপলব্ধি শিথিল হয়ে যায় এবং নতুন বোধের জাগরন ঘটে।

রামকৃষ্ণদেব কেশবচন্দ্র সেনের মন থেকে ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে সাকার ও নিরাকার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটান। এর ফলে প্রচলিত হিন্দু ধর্মের প্রতি কেশবচন্দ্র সেনের আস্থা ও শ্রদ্ধা ফিরে আসে

শ্রীরামকৃষ্ণদের প্রভাবে এসে ১৮৭০ এর দশকের শেষ দিকে কেশবচন্দ্রের নিরাকার ব্রহ্ম প্রচ্ছন্ন কালী মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়। ব্রহ্মের ধ্যান পরিনত হয় শ্যামাসঙ্গীতে। কেশবচন্দ্র সেন তার ধর্মতত্ত্ব পত্রিকাতে নিয়মিত শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ ও বানী প্রচার করতে থাকলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবও স্বয়ং ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে আসতে থাকলেন। 

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সান্নিধ্যে এসে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে নামসংকীর্তন প্রথার প্রচলন করেন। ১৮৭৮ খ্রিঃ ২১ সেপ্টেম্বর, কেশবচন্দ্র সেনের বাড়িতে এরকমই এক নামসংকীর্তন অনুষ্ঠানে রামকৃষ্ণদেবের ভাবসমাধি হয়। দন্ডায়মান অবস্থায় সমাধিরত রামকৃষ্ণদেবের বিখ্যাত ফটোগ্রাফিটি এই সময়েই তোলা হয়েছিলো। 

ব্রাহ্ম সমাজের অভ্যন্তরে পাল্টা প্রতিক্রিয়া 

রামকৃষ্ণদেবের সংস্পর্শে এসে কেশবচন্দ্রের চৈতন্যপ্রীতি, গুরুবাদ ও ভক্তিবাদে আকর্ষণ, হিন্দু দেবদেবীদের প্রতি বিশ্বাস ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের অভ্যন্তরে এক বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তরুন ও সনাতনী ব্রাহ্মদের অনেকেই এই বিষয় গুলি মেনে নিতে পারছিলেন না। ব্রাহ্মসমাজের সভাগুলিতে তারা তাদের অসন্তোষ গোপন রাখতে পারেন নি। 

অনেকেই এই সময় মনে করতে থাকেন, কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছেন। শেষপর্যন্ত এইসব ধর্মীয় অসন্তোষ খুব শীঘ্রই বিরোধের রূপ নেয়। 

কেশবচন্দ্রের সঙ্গে অন্যান্য ব্রাহ্মদের বিরোধ

হিন্দু ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হবার পরে কেশবচন্দ্র সেনের মনে রক্ষনশীল মানসিকতার জন্ম হয়। এর ফলে ব্যাপক সমাজ সংস্কারের প্রশ্নে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের অন্যান্য ব্রাহ্মদের সঙ্গে কেশবচন্দ্র বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। 

ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শ অনুযায়ী স্ত্রী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার পক্ষে এবং বাল্য বিবাহের বিপক্ষে প্রচার চালানো সত্ত্বেও, কেশবচন্দ্র সেন পর্দাপ্রথা সম্পূর্ণ ভাবে উঠিয়ে দেওয়া, নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা এবং নারীদের উচ্চ শিক্ষার বিরোধী হয়ে পড়েন। এইসব বিষয় গুলি নিয়ে কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে অন্যান্য ব্রাহ্মদের নানা অশান্তি ও বিতর্ক চলতেই থাকে। 

শেষপর্যন্ত, কেশবচন্দ্র সেনের কন্যার বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়টিকে কেন্দ্র করে এই অশান্তি ও বিরোধ চরমে পৌঁছায়।

কেশবচন্দ্র সেন তার কন্যা সুনীতাদেবীর বিবাহ দেন কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ন ভূপের সঙ্গে। রাজমাতার দাবি মতো এই বিবাহ অনুষ্ঠানটি হিন্দু মতে সম্পন্ন হয়। তাছাড়া, বিবাহের ক্ষেত্রে ১৮৭২ খ্রিঃ সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী পাত্র পাত্রী দুজনেই নাবালক ছিলেন। এই বিয়েতে পাত্র পাত্রীর বয়স ছিলো যথাক্রমে ১৫ ও ১৪। 

খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই বিয়েটি ব্রাহ্ম আদর্শ ও সমাজ সংস্কার কর্মসূচির সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলো। কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজের আচার্য হিসাবে ব্রাহ্মসমাজের সর্বোচ্চ পদে থেকে এমন কাজ করেন কিভাবে? 

কেশব কন্যার বিবাহের সংবাদে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে সকল সদস্যরা প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এই বিবাহের বিরুদ্ধে আনন্দমোহন বসু, শিবচন্দ্র দেব, উমেশচন্দ্র দত্ত, প্রমুখ ব্রাহ্মরা টাউন হলে তীব্র প্রতিবাদ জানান। 

তবে ব্রাহ্মদের সমস্ত প্রতিবাদ, আপত্তি ও বিরোধীতাকে অস্বীকার করে কেশবচন্দ্র সেন তার কন্যার বিবাহ মোটামুটি নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন করেন। যদিও এর ফলে তার ভাবমূর্তি অনেকখানি ম্লান হয়ে পড়ে। এই ঘটনার সূত্র ধরে ব্রাহ্মসমাজের ভাঙ্গন অনিবার্য হয়ে পড়ে। 

 ভারতবর্ষীয় সমাজের চূড়ান্ত ভাঙ্গন

আচার্য পদ থেকে অপসারন

কেশব কন্যার বিবাহের অব্যবহিত পরেই ১৮৭৮ খ্রিঃ কেশব বিরোধীরা ব্রাহ্ম মন্দিরে এক সভা ডাকেন। এখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজের পরিপন্থী কাজ করেছেন। সুতরাং ব্রাহ্মসমাজের আচার্য পদে তার আর থাকবার কোন অধিকার নেই। সভাতে কেশবচন্দ্র সেনকে উপাচার্য পদ থেকে বহিষ্কার করে নতুন উপাচার্য নিয়োগ করা হয়। 

কেশবচন্দ্রের অনুগামীরা কেশব বিরোধী ব্রাহ্মদের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ন আচরন দেখে যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এর পরেই ঘটলো চরম নাটকীয় এক ঘটনা যা সেই সময়ের সংবাদপত্র গুলিতে এক উপভোগ্য সংবাদ হিসাবে পরিবেশিত হয়েছিলো। 

ব্রাহ্ম মন্দিরের অধিকার নিয়ে লড়াই 

কেশবচন্দ্র সেনকে যেদিন আচার্য পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, ঠিক তার পরদিনই কেশব অনুগামীরা ব্রাহ্ম মন্দিরে প্রবেশ করে বাইরে থেকে মন্দিরের গেটে তালা লাগিয়ে দেন। বাইরে বিরোধীদের আটকে দেওয়ার জন্য পুলিশও মোতায়েন করা হয়। ব্রাহ্ম মন্দিরের ভিতরে তখন ব্রহ্ম উপাসনা চলছিলো। 

কিছু পরে কেশব বিরোধীরা ব্রাহ্ম মন্দিরের সামনে এলে পুলিশ তাদের আটকে দেয়। শেষপর্যন্ত বলপ্রয়োগ করে  তালা ভেঙ্গে হুড়োহুড়ি করে তারা ব্রাহ্ম মন্দিরে প্রবেশ করে। 

মন্দিরে প্রবেশ করেই নতুন আচার্যদের বেদীতে বসানোর জন্য দুই গোষ্ঠীর তরুন ব্রাহ্মদের মধ্যে তীব্র ধ্বস্তাধস্তি চলতে থাকলো। কোন পক্ষই ব্রাহ্ম মন্দিরের অধিকার ছাড়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। এই সময় হুড়োহুড়িতে কেশবচন্দ্র সেন আচার্যের বেদীতে উঠে পড়ে নিজের অধিকার জাহির করলে, ক্ষুব্ধ কেশব বিরোধী ব্রাহ্মরা চিৎকার করে বলতে থাকে, "এটা ব্রাহ্ম মন্দির নয়। এই মন্দিরে ব্রহ্ম কখনই থাকতে পারেন না। চলুন এই মন্দির ত্যাগ করি"। 

সাধারন ব্রাহ্মসমাজ

১৮৭৮ খ্রিঃ উক্ত ঘটনার পর ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ দু টুকরো হয়ে গেলো। প্রতিবাদী ব্রাহ্মরা ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ব্রাহ্মসমাজ গঠন করলেন। কেশবচন্দ্র সেনের কাছে হাতে গোনা কয়েকজন ঘনিষ্টই রয়ে গেলেন। 

ভারতবর্ষীয় সমাজ থেকে বেরিয়ে আসবার পর ১৮৭৮ খ্রিঃ শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাস প্রমুখ ব্রাহ্মরা "সাধারন ব্রাহ্ম সমাজ" গঠন করেন।  

নামকরনের অর্থ

ব্রাহ্মসমাজ যাতে অতীতের মতো কোন ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছা অনিচ্ছা ও ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিনত না হয়ে ওঠে, তাই সাধারন ব্রাহ্মসমাজের সদস্যরা ঠিক করেন, সমাজের সমস্ত কাজ ও সিদ্ধান্ত গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সদস্যদের মতামত (ভোটদান) নিয়েই করা হবে। সর্বসাধারনের মতামত ও ক্ষমতায়নের জন্যই এই সমাজের নামকরন টি "সাধারন ব্রাহ্মসমাজ" রাখা হয়েছিলো। 

সাধারন ব্রাহ্মসমাজের কর্মসূচি

  • সাধারন ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হবার পর প্রায় সমস্ত প্রাদেশিক ব্রাহ্ম সমাজ সাধারন ব্রাহ্মসমাজের প্রতি তাদের সমর্থন ও আনুগত্য জানায়। 
  • ১৮৮১ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে কলকাতার বিধান সরনীতে সাধারন ব্রাহ্মসমাজের একটি মন্দির স্থাপিত হয়। 
  • শিক্ষা বিস্তার, স্ত্রী স্বাধীনতার প্রসার, অস্পৃশ্যতা নিবারন, ইত্যাদি সামাজিক কর্মসূচি গুলিকে সাধারন ব্রাহ্মসমাজের সদস্যরা এগিয়ে নিয়ে যান। 
  • এমনকি জাতীয় আন্দোলন সংগঠনেও এই সভার সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 

সাধারন ব্রাহ্মসমাজের পরিনতি

তবে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হবার কয়েক বছরের মধ্যেই এই সমাজের সদস্যরা ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্মের মূল স্রোতের সাথে মিশে যেতে থাকেন। তাদের বৈপ্লবিক চিন্তাধারাও ধীরে ধীরে প্রমিত হতে থাকে। এই সমাজের অন্যতম প্রধান সদস্য বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী চরম রেডিক্যাল চিন্তাধারা থেকে সরে এসে দক্ষিণেশ্বরের যতমত ততপথের বিশ্বাস বোধে উদ্দীপ্ত হন। 

এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সাধারন ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যান এবং রাধাকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। অন্যান্য সদস্যদের অনেকেই সমাজের মূল স্রোতে ধীরে ধীরে বিলিন হয়ে যান। 

উনিশ শতকের শেষদিকে ভারতে জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনা শিক্ষিত সমাজকে প্রভাবিত করতে থাকে। ১৮৮৫ খ্রিঃ ভারতে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হবার পর সর্বভারতীয় জাতীয় আন্দোলন ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে শুরু করে। সাধারন ব্রাহ্মসমাজের অবশিষ্ট সদস্যরা সমাজের এই মূল স্রোতেই নিজেদের ধীরে ধীরে বিলিন করে দেন। 

ফলে ব্রাহ্ম উন্মাদনারও ধীরে ধীরে অবসান ঘটে। 

নববিধান 

১৮৭৮ খ্রিঃ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হবার দু বছর পর ১৮৮০ খ্রিঃ কেশবচন্দ্র সেন "নববিধান" ঘোষনা করেন এবং তার সঙ্গে থাকা অবশিষ্ট ব্রাহ্মসমাজ "নববিধান" নামে  খ্যাত হয়। এই পর্বে কেশবচন্দ্র সেনের সহযোগী ছিলেন - 
  • প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, 
  • অঘোরনাথ গুপ্ত, 
  • গিরিশচন্দ্র সেন। 
এখানে একটি তথ্য জেনে রাখা প্রয়োজন, কেশবচন্দ্র সেনের নির্দেশে এই গিরিশ চন্দ্র সেনই প্রথম কোরানের বঙ্গানুবাদ করেন। তার অনুদিত কোরানই ছিলো বাংলা ভাষার অনুদিত প্রথম কোরান। 

নামকরনের অর্থ 

কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজের নাম নববিধান কেন হয়েছিলো, তারও একটি কারন ছিলো - 

সমস্ত ধর্মীয় বিবাদ ও দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে কেশবচন্দ্র সেন সর্বধর্ম সমন্বয় ও সহিষ্ণুতার নতুন বিধান রচনা করেছিলেন বলে তার প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ "নববিধান" নামে পরিচিত হয়।

নববিধানের পরিনতি

নববিধান দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদি ব্রাহ্মসমাজের মতো খুব বেশিদিন এগিয়ে যেতে পারে নি। ১৮৮৪ খ্রিঃ ৮ ই জানুয়ারি, কেশবচন্দ্র সেন মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মারা যান। তার মৃত্যুর পরেই উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে নববিধান প্রচলিত হিন্দু সমাজের স্রোতে মিশে যায়। 


মূল্যায়ন ও উপলব্ধির শেষ কথা

এইভাবেই দেখা যায় রামমোহনের একেশ্বরবাদের পথ ধরে যে ব্রাহ্মসমাজের যাত্রা শুরু হয়, তা শেষ হয় পরমহংসদেবের সর্বধর্ম সমন্বয়ের পথে। হিন্দু ধর্মের প্রকৃত স্বরূপকে ব্যাখ্যা করবার এবং রক্ষা করবার অমোঘ নিয়মে যার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো, ঐতিহাসিক সেই কর্তব্যটুকু সমাপন করে ব্রাহ্ম সমাজ ধীরে ধীরে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এই কর্তব্যকর্মের পথে ব্রাহ্ম সমাজ যখনই নিজের স্বতন্ত্র্যতা বজায় রেখে হিন্দু ধর্ম থেকে পৃথক হয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলো, তখনই সে বারংবার অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষত বিক্ষত হতে থাকে এবং আপনি আপনার প্রভাবকে খর্ব করতে থাকে। 

তবে ব্রাহ্ম সমাজের এই অবক্ষয় প্রচলিত সমাজে কোন ক্ষতি বা শূন্যতা সৃষ্টি করে নি। বরং হিন্দু ধর্মকে আরোও উদার ও প্রশস্ত হতে সাহায্য করেছিলো। 

ব্রাহ্ম সমাজের আন্দোলন সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সাল 

  • ১৮২৮ - রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্ম সভা প্রতিষ্ঠা করেন।
  • ১৮৩০ - ব্রাহ্ম সভার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ব্রাহ্মসমাজ। 
  • ১৮৩৯ - দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন ।
  • ১৮৪৩ - তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রকাশ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মসমাজে যোগদান। 
  • ১৮৫৭ - কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন। 
  • ১৮৬২ - দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কেশবচন্দ্র সেনকে ব্রহ্মানন্দ উপাধি দেন।
  • ১৮৬৬ - ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম ভাঙ্গন। অখন্ড ব্রাহ্মসমাজ ভেঙ্গে কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে আদি ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হয়। 
  • ১৮৭২ - ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে ব্রহ্ম বিবাহ আইন বা তিন আইন পাশ হয়। 
  • ১৮৭৮ - ব্রাহ্ম সমাজে দ্বিতীয় পর্বের ভাঙ্গন দেখা যায়। ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ভেঙ্গে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। 
  • ১৮৮০ - কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ নববিধান নামে পরিচিত হয়। 

চলবে..... 

ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব - "ব্রাহ্মসমাজের অবদান ও গুরুত্ব"। 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post