সংবাদপত্রে প্রতিফলিত হয় সমকালীন সমাজ। হিন্দু প্যাট্রিয়টও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলো না। হিন্দু প্যাট্রিয়টে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে (১.) উল্লেখযোগ্য সামাজিক পরিবর্তন এবং (২.) সমাজে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে নানা সংবাদ থেকে উঠে আসে "উনিশ শতকের সমাজ চিত্র"।
হিন্দু প্যাট্রিয়টে উনিশ শতকের সমাজ চিত্র |
হিন্দু প্যাট্রিয়টে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে "বাংলার সমাজ চিত্রের" যে বিশেষ দিক গুলি উঠে এসেছিলো, তা খুব সংক্ষেপে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) গ্রাম বাংলার অত্যাচারিত সমাজজীবন
হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা শহর কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলেও, ইংরেজি ভাষার এই পত্রিকায় গ্রাম বাংলার খবরই বেশি থাকতো। উনিশ শতকে বাংলার গ্রামীন সমাজ জমিদার, মহাজন ও নীলকর সাহেবদের দ্বারা কিভাবে অত্যাচারিত ও নিষ্পেষিত হয়েছিলো তার মর্মস্পর্শী চিত্র হিন্দু প্যাট্রিয়ট থেকে উঠে আসে।
(২.) গ্রামীন সমাজে নীলচাষের কুফল
ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে বহু কাপড়ের কল গড়ে উঠলে, কাপড় সাদা ও উজ্জ্বল করে তোলার জন্য নীলের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায়, উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে বাংলায় নীলচাষের সূচনা হলেও, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে তা কৃষকদের কাছে বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে।
বাধ্যতামূলক ও বলপূর্বক নীলচাষের ফলে বাংলার আউশ ও আমন চাষের ক্ষতি হয়। কৃষকের পরিবারে খাদ্যসংকট দেখা যায়। নীল চাষ কৃষকের পক্ষে মোটেই লাভজনক ছিলো না। ফলে নীলচাষ করতে গিয়ে বাংলার কৃষি জমি যেমন অনুর্বর হয়ে পড়ে, তেমনি কৃষকরাও সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। বাংলায় নীল চাষের ভয়াবহ কুফলের দিকটি হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার বিভিন্ন প্রতিবেদন গুলি থেকে জানতে পারা যায়।
(৩.) নীলকরদের অত্যাচার
উনিশ শতকের গ্রাম বাংলায় নীলকরদের দাপাদাপি এবং অত্যাচার বাংলার সমাজ জীবনের এক বাস্তব চিত্র ছিলো। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় "Indigo Districts" নামে পৃথক এক বিভাগে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের সংবাদ গুলি পরিবেশিত হতো।
নীলচাষে অসম্মত কৃষকদের নীলকুঠিতে ধরে এনে অত্যাচার করা হতো। এমনকি সেসময়ে গ্রামের মেয়েরাও নীলকর সাহেবদের অত্যাচার থেকে মুক্ত ছিলেন না। হিন্দু প্যাট্রিয়টে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নীলকর আর্কিবলস হিল কর্তৃক হারামনি নামক একটি মেয়ের শ্লীলতাহানির সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন। এতে নীলকররা হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার ওপর মারাত্মক ভাবে চটে যায় এবং মামলা দায়ের করে।
এককথায়, নীলচাষ ও নীলকরদের বর্বর অত্যাচার সহজ সরল গ্রাম বাংলার সমাজ জীবনকে কিভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল, তারই বাস্তব জীবনের চিত্র হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা থেকে পাওয়া যায়।
(৪.) কৃষক বিদ্রোহের পরিচয়
হিন্দু প্যাট্রিয়ট থেকে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ৩ টি উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহ সম্পর্কে জানতে পারা যায়। এর মধ্যে প্রথমটি ছিলো সাঁওতাল বিদ্রোহ। অপর দুটি ছিলো ১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহ ও নীল বিদ্রোহ। হিন্দু প্যাট্রিয়ট ৩ টি বিদ্রোহকেই সমর্থন করেছিলো।
মনে রাখতে হবে, একমাত্র নীল বিদ্রোহ ব্যতিত অপর দুটি বিদ্রোহকে বাংলার কোন সংবাদপত্রই সমর্থন করে নি। এক্ষেত্রে উক্ত বিদ্রোহ দুটিতে হিন্দু প্যাট্রিয়টের সমর্থন এবং পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেগুলির বিচার বিশ্লেষণ, তৎকালীন বাঙালি সমাজের ভিন্ন ও ব্যতিক্রমী মানসিকতারই পরিচয় বহন করে।
(৫.) সমাজ সংস্কার আন্দোলনের পরিচয়
হিন্দু প্যাট্রিয়ট থেকে উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলন গুলিরও পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু প্যাট্রিয়ট নারীদের বাল্যবিবাহ, পুরুষের বহু বিবাহ, মদ্যপান ইত্যাদি নানা সামাজিক কু প্রথার বিরুদ্ধে সংবাদ পরিবেশন করে।
এছাড়া, নারী শিক্ষা ও বিধবা বিবাহ, ইত্যাদি প্রগতিশীল সমাজ সংস্কার গুলিকে সমর্থন করে। এককথায়, উনিশ শতকে শিক্ষিত বাঙালির উদারনৈতিক সামাজিক মতাদর্শ ও চিন্তাধারার প্রতিফলন হিন্দু প্যাট্রিয়ট থেকে পাওয়া যায়।
(৬.) রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিচয়
সমাজ কল্যানের আদর্শবোধের সঙ্গে রাজনৈতিক চিন্তাধারার এক গভীর সম্পর্ক আছে। হিন্দু প্যাট্রিয়টের চিন্তাধারাও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলো না। এদেশের সামাজিক হিত অহিতের সঙ্গে রাজনৈতিক চিন্তাধারার সম্পর্ক যে খুবই নিবিড়, তা হিন্দু প্যাট্রিয়ট বলিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরেছিলো।
- এক্ষেত্রে হিন্দু প্যাট্রিয়ট এদেশে ব্রিটিশ শাসনের ক্ষতিকর দিক গুলি নিয়ে তীব্র ভাবে সোচ্চার হয়েছিলো।
- ডালহৌসির নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ নীতি, সাঁওতাল বিদ্রোহ ও মহাবিদ্রোহে সরকারের নির্বিচার দমন নীতির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলো।
- এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা নীতির ত্রুটি বিচ্যুতি এবং সমাজে বেকারত্ব বৃদ্ধির জন্য হিন্দু প্যাট্রিয়ট সরকারী নীতির সমালোচনা করেছিলো।
মূল্যায়ন
- এ সময়ে গ্রাম বাংলার সমাজ জমিদার, মহাজন, নীলকর ও নানা পুলিশি অত্যাচারে জর্জরিত ছিলো।
- শহর কলকাতা একাধিক সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত ছিলো।
- বাঙালি মানসিকতা প্রগতিশীল ও রক্ষনশীল নানা দ্বিধা দ্বন্দ্বে বিভক্ত ছিলো।
- ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনী নিজেদের শ্রেনী স্বার্থ রক্ষায় সবথেকে বেশি সচেতন ছিলেন।