নীল বিদ্রোহে হিন্দু প্যাট্রিয়টের ভূমিকা ও অবদান

 উনিশ শতকে প্রকাশিত সংবাদপত্র গুলি একাধিক কারনে ইতিহাসে স্মরণীয় হলেও, "হিন্দু প্যাট্রিয়ট" শুধুমাত্র একটি অবদানের কারনেই অমরত্ব লাভ করে এবং ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়, তা হলো নীল বিদ্রোহকে সমর্থন এবং নীল চাষের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গঠন

উনিশ শতকে প্রকাশিত পত্র পত্রিকা গুলির মধ্যে হিন্দু প্যাট্রিয়টই একমাত্র বলিষ্ঠ ভাবে বাংলায় নীল চাষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং নীল বিদ্রোহের স্বপক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

নীল বিদ্রোহে হিন্দু প্যাট্রিয়টের অবদান ও ভূমিকা
নীল বিদ্রোহে হিন্দু প্যাট্রিয়টের অবদান ও ভূমিকা

সংক্ষেপে নীল বিদ্রোহে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার ঐতিহাসিক ভূমিকার দিকগুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি - 

  1.  নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভারতীয় সংবাদপত্র গুলির মধ্যে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাই প্রথম "ব্যাপকভাবে" সোচ্চার হয় এবং ধারাবাহিক ভাবে খবর পরিবেশন করে বিষয়টির গুরুত্ব দেশবাসী ও সরকারের সামনে তুলে ধরে। 
  2. হিন্দু প্যাট্রিয়ট ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হওয়ায় খুব সহজেই নীলকর সাহেবদের বর্ববরচিত অত্যাচারের সংবাদ গুলি ইওরোপীয় মহলে প্রচারিত হয় এবং বাংলায় নীলচাষের বিপক্ষে তাদের মধ্যে জনমত গঠিত হয়। 
  3. এছাড়া, বাংলায় নীলচাষে বিপর্যস্ত কৃষকদের ভয়াবহ অবস্থার কথা ইংরেজ সরকার হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রতিবেদন গুলি থেকেই জানতে পারে। "নীল কমিশন গঠনে" হিন্দু প্যাট্রিয়টের প্রতিবেদন গুলি এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। 
  4. ১৮৬০ খ্রিঃ হরিশচন্দ্র মুখার্জি নীলকরদের অত্যাচারের সংবাদ গুলি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করবার জন্য হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় "Indigo Districts" বা "নীল জেলা" নামে একটি নতুন বিভাগ খোলেন। 
  5. নীলচাষে ক্ষতিগ্রস্ত এবং নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে বিপর্যস্ত কৃষকদের দুরবস্থার সংবাদ পরিবেশনের জন্য হরিশচন্দ্র বাংলাদেশের গ্রাম গুলিতে সাংবাদিক নিয়োগ করেন। এক্ষেত্রে তার প্রধান সংবাদদাতা ছিলেন শিশির কুমার ঘোষ। 
  6. শিশির কুমার ঘোষ এম. এল. এল নামে নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী গুলি হিন্দু প্যাট্রিয়টে লিখে পাঠাতেন। এমনকি নীলবিদ্রোহে গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সংগঠিত করে তোলার ক্ষেত্রেও শিশির কুমার ঘোষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 
  7. হিন্দু প্যাট্রিয়টে প্রকাশিত নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের সংবাদ গুলি পড়ে সরকার ও ইওরোপীয় মহলে নীলচাষের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে। 
হিন্দু প্যাট্রিয়টের দেখাদেখি বাংলার অন্যান্য সংবাদপত্র গুলিও নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। ফলে নীল চাষের বিরুদ্ধে শিক্ষিত শ্রেনীর মধ্যেও সচেতনতা ও জনমত গঠিত হতে থাকে। 

 কলকাতার ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেনী ও বাঙালি জমিদারগন হিন্দু প্যাট্রিয়টের প্রতিবেদন পড়েই নীলচাষের ক্ষতিকারক দিক গুলি সম্পর্কে সোচ্চার হন।

 মনে রাখতে হবে, এদেশে যখন নীল চাষের প্রথম সূত্রপাত হয়, তখন তাকে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনী ও বহু বাঙালি জমিদার সমর্থন করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো অনেক ব্যক্তিই এদেশে প্রথমদিকে নীলচাষকে সমর্থন করেছিলেন। তাদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা যে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো, তাকে কোনমতেই অস্বীকার করা যায় না। 

মূল্যায়ন 

সবশেষে বলা যায়, হরিশচন্দ্র মুখার্জি হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় নীলচাষে বিপর্যস্ত কৃষকদের কথাই শুধু তুলে ধরেন নি। নীল বিদ্রোহে চাষীদের নানা পরামর্শ ও অর্থিক সহায়তার জন্য হিন্দু প্যাট্রিয়টের সদর দপ্তর কৃষকদের কাছে উন্মুক্ত করে দেন। ১৮৫৯ - ৬০ খ্রিঃ বাংলায় নীল বিদ্রোহ শুরু হলে, হরিশচন্দ্র কৃষকদের বিদ্রোহকে ন্যায় সঙ্গত বলে উল্লেখ করে লেখেন - "বঙ্গদেশ তার কৃষকদের সম্বন্ধে নিশ্চয়ই গর্ববোধ করতে পারে"। 

হরিশচন্দ্র উপলব্ধি করেন, সমাজের শতকরা ৯০ ভাগ কৃষকই হলো জাতীর একটি প্রধান অংশ। এই অংশের কল্যানের স্বার্থে তাই তিনি সর্বস্ব পণ করে শেষ জীবনে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। 

নীলকর আর্কিবলস হিল কর্তৃক হারামনির শ্লীলতাহানির ঘটনার খবর হরিশচন্দ্র হিন্দু প্যাট্রিয়টে প্রকাশ করায় হিল হরিশচন্দ্র ও হিন্দু প্যাট্রিয়টের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।  ইংরেজ জমিদার ও অন্যান্য নীলকররাও হরিশচন্দ্রের প্রবল শত্রুতে পরিনত হন। হিলের মামলায় হরিশচন্দ্র তীব্র অর্থকষ্টে ভুগে ১৮৬১ খ্রিঃ মারা যান। এত দুঃখ, দুর্দশার মধ্যেও হরিশচন্দ্র কখনোই তার নির্ভিক সাহসিকতা ও আদর্শবোধ থেকে বিচ্যুত হন নি। 

মূল্যায়নে তাই নীল বিদ্রোহে হরিশচন্দ্র মুখার্জি এবং হিন্দু প্যাট্রিয়টের কৃতিত্বের দিককে স্মরন করে পরিশেষে আমরা বলতে পারি - 
"হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় নীল বিদ্রোহ ও নীলচাষীদের স্বপক্ষে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় যে বীরত্বপূর্ন আত্মত্যাগের নজির সৃষ্টি করে যান, তার কৃতিত্ব জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বীর সেনানীদের চেয়ে কোন অংশে কম ছিলো না।" 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post