বামাবোধিনী পত্রিকা

 উনিশ শতককে প্রকাশিত নারী কেন্দ্রীক পত্রিকা গুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পত্রিকা ছিলো - "বামাবোধিনী পত্রিকা"।

বামাবোধিনী পত্রিকা
বামাবোধিনী পত্রিকা 

প্রকাশকাল

১৮৬৩ খ্রিঃ  আগস্ট মাসে ব্রাহ্ম সমাজের বামাবোধিনী সভার মুখপত্র হিসাবে "বামাবোধিনী পত্রিকা"প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৮৬৩ থেকে ১৯২২ খ্রিঃ পর্যন্ত টানা প্রায় ৬০ বছর এই পত্রিকা চলেছিলো। এত দীর্ঘ সময় ধরে এই পত্রিকাটির টিকে থাকা থেকেই বোঝা যায়, সমকালীন সময়ে পত্রিকাটি কতটা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো।

সদর কার্যালয়

বামাবোধিনী পত্রিকার সদর কার্যালয় ছিলো - ১৬ নং রঘুনাথ স্ট্রিট, শিমুলিয়া, কলকাতা। এখান থেকেই বামাবোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হতো।

বামাবোধিনী পত্রিকার সম্পাদক

বামাবোধিনী পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন - ব্রাহ্ম উমেশচন্দ্র দত্ত। তার হাত ধরেই প্রথম এই পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো। দীর্ঘ প্রায় ৪৪ বছর উমেশচন্দ্র বামাবোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

উমেশচন্দ্রের পরবর্তী কালে বামাবোধিনী পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন সুকুমার দত্ত, তারাকুমার কবিরত্ন, সূর্যকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তি।

বামাবোধিনী পত্রিকার সর্বশেষ সম্পাদক ছিলেন - আনন্দকুমার দত্ত

পত্রিকার ধরন

বামাবোধিনী ছিলো বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একটি মাসিক শিক্ষা মূলক পত্রিকা

"বামা" শব্দটির অর্থ হলো নারী। এবং "বোধিনী" শব্দটির অর্থ ছিলো বন্দনা, প্রশংসা বা প্রশস্তি। অর্থাৎ পত্রিকার নামকরন থেকেই বোঝা যায়, বামাবোধিনী ছিলো একটি নারী কেন্দ্রীক বা নারী বিষয়ক পত্রিকা

পত্রিকার মূল্য বা দাম

বামাবোধিনী পত্রিকার প্রথম দিকে মূল্য ছিলো এক আনা। পরবর্তীকালে অবশ্য এর দাম কিছুটা বাড়িয়ে করা হয়েছিলো এক আনা দু পয়সা এবং দু আনা ও চার আনা। 

আলোচ্য বিষয়বস্তু

বামাবোধিনী যেহেতু একটি নারীদের জন্য প্রকাশিত পত্রিকা ছিলো, তাই এই পত্রিকায় নারীকেন্দ্রীক নানা বিষয় আলোচনা করা হতো। পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ছিলো নারীদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো। 

এই জন্য এই পত্রিকায় - 

  1. ধর্ম, 
  2. নীতি শাস্ত্র, 
  3. বিজ্ঞান, 
  4. ইতিহাস, 
  5. ঘরোয়া চিকিৎসা ও ঔষুধ পত্র, 
  6. শিশু পরিচর্যা, 
  7. স্বাস্থ্য শিক্ষা, 
  8. ভাষা শিক্ষা, 
ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হতো। এছাড়া, মেয়েদের অর্থনৈতিক দিকে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য বিভিন্ন রকমের হাতের কাজ, কারু ও চারু শিল্পের শিক্ষাও এই পত্রিকার মাধ্যমে দেওয়া হতো। 

মেয়েদের সাহিত্য ও কবিতা রচনায় উৎসাহিত করবার জন্য তাদের সৃষ্টিশীল বিভিন্ন স্মারক গুলির বিবরন বামাবোধিনী পত্রিকা তুলে ধরতো। এমনকি নারীদের উৎসাহিত করে তোলার জন্য বিশেষ খ্যাতি সম্পন্ন নারীদের কৃতিত্বের দিক গুলিকে নিয়েও এই পত্রিকা আলোচনা করতো।

বামাবোধিনী পত্রিকার উদ্দেশ্য 

বামাবোধিনী পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত আকারে তুলে ধরতে পারি - 

  1. বামাবোধিনী পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ছিলো নারী শিক্ষার বিস্তার ঘটানো এবং নারীদের শিক্ষিত করে তোলা।
  2. বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার সম্পর্কে নারীদের সচেতন করে তোলা।
  3. নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করে তাদের অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের ক্ষেত্রে যোগ্য করে তোলা। 
  4. নারীদের যেকোন গৌরবোজ্বল কাজের সংবাদ প্রকাশ করে তাদের উৎসাহিত করে তোলা। 
  5. নারী জাতির সর্বাঙ্গিন উন্নতি সাধন করা। 

বামাবোধিনী পত্রিকার বৈশিষ্ট্য 

  1. ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে প্রকাশিত বামাবোধিনী পত্রিকা ছিলো একটি নারী কেন্দ্রীক পত্রিকা।
  2. উনিশ শতকের নারী কেন্দ্রীক পত্রিকা গুলির মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় পত্রিকা ছিলো বামাবোধিনী পত্রিকা।
  3. প্রথম দিকে এই পত্রিকার পুরুষরা যাবতীয় লেখা গুলি লিখতেন। শেষের দিকে অবশ্য নারীরা বামাবোধিনীতে লিখতে এগিয়ে এসেছিলেন। 
  4. বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই পত্রিকায় লেখকদের নাম প্রকাশিত হতো না। যেহেতু বেশিরভাগ লেখা পুরুষরা লিখতেন, তাই অনেকে ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। 
  5. বামাবোধিনী পত্রিকার অধিকাংশ লেখিকাই অবশ্য ছিলেন অনামা গৃহবধূ। 
  6. উল্লেখযোগ্য নারী লেখিকাদের মধ্যে ছিলেন - লাবন্যপ্রভা বসু, স্বর্নপ্রভা বসু (জগদীশ চন্দ্র বসুর বোন), শৈল্যবায়া জায়া। 
  7. নারী মুক্তি, নারী প্রগতি ও নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে বামাবোধিনী পত্রিকা চরমপন্থার বদলে মধ্যপন্থার নীতি নিয়েছিলো। 
  8. এর মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিলো - নারীদের সুগৃহিনী, আদর্শ পত্নী ও সুমাতা হতে উৎসাহিত করে তোলা। 

বামাবোধিনী পত্রিকার গুরুত্ব 

ভারতে নারী মুক্তি ও নারী জাগরনের ক্ষেত্রে বামাবোধিনী পত্রিকা এক বিরাট ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। সংক্ষেপে এর গুরুত্বের প্রধান দিক গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি - 
  1. বিংশ শতাব্দীতে শিক্ষা, সাহিত্য, ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে যে কয়জন বিশেষ কৃতিত্ব সম্পন্না নারীর উপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করি, তার পশ্চাৎপট রচনায় বামাবোধিনী পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
  2. উনিশ শতকে সামাজিক রক্ষনশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার কারনে নারী শিক্ষা ছিলো খুবই সীমাবদ্ধ।এই প্রতিকূল পরিমন্ডলের মধ্যেও "বামাবোধিনী" তার পত্রিকার মাধ্যমে নারী শিক্ষাকে গৃহস্তের অভ্যন্তরে পৌঁছে দেয়। ফলে আপামর নারী সমাজ শিক্ষার সুযোগ লাভ করে। 
  3.  নারী শিক্ষার জন্য উমেশচন্দ্র বামাবোধিনী পত্রিকায় এক ব্যাপক আয়োজন করেন। ইতিহাস, ভূগোল, ভাষা শিক্ষা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, গৃহ পরিচর্যা, শিশু প্রতিপালন, বিজ্ঞান শিক্ষা, ইত্যাদি সর্বাঙ্গিন শিক্ষার মধ্য দিয়ে নারী সমাজকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য আয়োজন এই পত্রিকায় করে তোলা হয়। 
  4. নারী শিক্ষার পাশাপাশি সমাজে নারীদের বাল্য বিবাহ ও তার কুফল, অসম বিবাহ, ইত্যাদি নানা বিষয়েও বামাবোধিনী পত্রিকা নারীদের সচেতন করে তোলে।
এইভাবে দেখা যায়, উনিশ শতকে প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা ও  রক্ষনশীলতাকে অতিক্রম করে বামাবোধিনী পত্রিকা নারী শিক্ষার প্রসারে নারী সমাজের কাছে গৃহশিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। এই পত্রিকার সবচেয়ে বড়ো ঐতিহাসিক অবদান ও মূল্য এখানেই। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post