আদি ব্রাহ্মসমাজ ও ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ

 ১৮৬৬ খ্রিঃ রামমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ "আদি ব্রাহ্মসমাজ" ও "ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ" এই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো। এর পরেই এই দুটি ব্রাহ্মসমাজ দুটি পরস্পর বিরোধী খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। 

আদি ব্রাহ্মসমাজ ও ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ
আদি ব্রাহ্মসমাজ ও ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ 

আদি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে ভারতবর্ষীয় সমাজের পার্থক্য

আদি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের  মতাদর্শগতদৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যও ছিলো অনেক। যেমন -

  1. আদি ব্রাহ্মসমাজ নিরাকার পরমব্রহ্মের উপাসনা ও ধ্যানের মধ্য দিয়ে "আত্মমুক্তির" আদর্শে বিশ্বাসী ছিলো। কিন্তু ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ আত্মমুক্তির বদলে সমাজ সংস্কার,সমাজ কল্যাণ ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে "সমষ্টির মুক্তির" আদর্শে বিশ্বাসী ছিলো।
  2. আদি ব্রাহ্মসমাজ জাতিভেদ প্রথার অবলুপ্তি, পর্যাপ্ত স্ত্রী স্বাধীনতা, অসবর্ন বিবাহ ইত্যাদির পক্ষপাতী ছিলো না। কিন্তু কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ এর ঠিক বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি পোষন করতো এবং ব্যাপক সংস্কারের পক্ষপাতী ছিলো।
  3. ১৮৬৬ খ্রিঃ চূড়ান্ত বিচ্ছেদের পর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আদি ব্রাহ্মসমাজ হিন্দু ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ভাবধারার দিকে ক্রমশ ঝুঁকে পড়তে থাকে। অন্যদিকে কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ এর ঠিক বিপরীত মুখে যাত্রা করে বেদান্তের রেডিক্যাল সামাজিক ভাবনাকে প্র্যাকটিক্যাল প্রয়োগ করতে গিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে সমাজ সংস্কারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। 

ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ 

১৮৬৬ খ্রিঃ ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই সমাজের তরুন সদস্যরা অপূর্ণ সংস্কার গুলি বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হয়। তারা পর্যন্ত স্ত্রী স্বাধীনতার প্রসারে উদ্যোগী হন। ১৮৬৮ খ্রিঃ কেশবচন্দ্র সেন বাল্যবিবাহ রোধ অসবর্ন বিবাহ আইনসিদ্ধ করবার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। 

তিন আইন পাশ

কেশবচন্দ্রের উদ্যোগের ফলেই ১৮৭২ খ্রিঃ "সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট" বা "তিন আইন" পাশ হয়। "তিন আইন" বা "ব্রাহ্ম বিবাহ আইন" পাশ ছিলো ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের এক বিরাট কৃতিত্ব। 
  • তিন আইনের ফলে বিবাহ ক্ষেত্রে ৩ টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধিত হয়। 
  • এর ফলে বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ হয় এবং অসবর্ন বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়
  • বাল্য বিবাহ রোধ করবার জন্য এই আইনে পাত্র পাত্রীর নুন্যতম বয়স স্থির করে দেওয়া হয়। বলা হয়, বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্রীর বয়স হবে নুন্যতম ১৪ বছর এবং পাত্রের বয়স হবে ১৮ বছর। 

আদি ব্রাহ্মসমাজের বিরোধীতা

ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে যখন তিন আইন পাশ হচ্ছিলো, তখন আদি ব্রাহ্মসমাজ এই আইনটির তীব্র বিরোধিতা করে। এই সময় আইনটির বিরোধিতা করে তারা ২০০০ ব্রাহ্মের স্বাক্ষর সম্বলিত এক আবেদনপত্র সিমলায় বড়োলাটের কাছে পাঠান।

 তবে সুখের কথা, আদি ব্রাহ্মসমাজের সমস্ত বিরোধিতাকে লঙ্ঘন করে আইনটি শেষপর্যন্ত পাশ হয়েই যায়। আসলে আদি ব্রাহ্মসমাজের সদস্যরা নিজেদের ব্রাহ্ম পরিচয় দিলেও, কখনই নিজেদের হিন্দু ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন মনে করতেন না। প্রচলিত হিন্দু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার আতঙ্কেই তারা আইনটির তীব্র বিরোধিতা করেছিলো। 

যাইহোক, তিন আইন পাশের পর ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ স্ত্রী স্বাধীনতা প্রসারের জন্য আরোও উদ্যোগী হন। এক্ষেত্রে তাদের উল্লেখযোগ্য সংস্কারটি ছিলো ব্রাহ্মসমাজে নারীদের অবাধ প্রবেশ এবং পর্দাপ্রথার অবসান ঘটানো। 

নারীদের পর্দা প্রথার অবসান

অবিভক্ত ব্রাহ্মসমাজে কেশবপন্থীদের জন্য মহিলারা ব্রাহ্মসমাজে অংশ গ্রহণের সুযোগ লাভ করলেও, তারা ব্রাহ্মসমাজে সরাসরি অংশ নিতে পারতেন না। তাদের বসতে হতো পর্দা বা চিকের আড়ালে। এমনকি ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেবার জন্য  যখন তারা গাড়ি থেকে নামতেন, তখন ফুটপাতের দুদিকে পর্দা ধরে আড়াল করা হতো। 

ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হবার পর তরুন ও নব্য ব্রাহ্মরা
মহিলাদের এই পর্দাপ্রথার বিরোধিতা করতে থাকেন। এবং এটি করতে গিয়েই ব্রাহ্মসমাজ আবার দ্বন্দ্ব ও বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই প্রসঙ্গ একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। 

১২৭২ বঙ্গাব্দে পর্দা প্রথার বিরোধিতা করে দুর্গামোহন দাসের পরিবারের কয়েকজন মহিলা পর্দার বাইরে বসে পড়লে, ব্রাহ্মসমাজে তুমুল হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। কেশবচন্দ্র নারীদের প্রকাশ্য সভায় অংশগ্রহণের নিন্দা করলে, ব্রাহ্মসমাজের একাংশ তার তীব্র বিরোধিতা করেন। 

একদিন যে কেশবচন্দ্র নিজে ব্রাহ্মসমাজে তার স্ত্রী কে নিয়ে এসে ব্রাহ্মসমাজের দরজা সকল নারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, আজ সেই তিনিই কিনা নারীদের সমাজে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করছেন? এটা দ্বিচারিতা ছাড়া আর কিইবা হতে পারে? এর ফলে একদল তরুন ক্ষুব্ধ ব্রাহ্ম ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ করেন। 

তীব্র সমালোচনা ও বাদানুবাদের পর কেশবচন্দ্র শেষপর্যন্ত ব্রাহ্মসমাজে নারীদের প্রকাশ্য অংশগ্রহণের বিষয়টিকে মেনে নেন। এর ফলে কিছুদিনের মধ্যেই ছেড়ে যাওয়া তরুন ব্রাহ্মরা পুনরায় ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে ফিরে আসে। 

ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ আবার প্রগতিশীল নানা ভাবনা ও সমাজ সংস্কারের চর্চায় ওঠে। 

আদি ব্রাহ্মসমাজ

ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ যখন আপন ছন্দে নানা প্রগতিশীল  ভাবনা ও তর্ক বিতর্কে মশগুল ছিলো, তখন আদি ব্রাহ্মসমাজ এর ঠিক বিপরীত অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিলো। 

হিন্দু ঐতিহ্যের অনুশীলন ও প্রচার

অখন্ড ব্রাহ্মসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর আদি ব্রাহ্মসমাজ ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করে। এই সময় আদি ব্রাহ্মসমাজ হিন্দু ধর্মের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রচার করে একদিকে যেমন জাতিকে পূর্ব গৌরবের অতীতে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানায়, অন্যদিকে তেমনি হিন্দু ধর্ম ও ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার করে মিশনারি ও উগ্র ব্রাহ্মদের আক্রমণ থেকে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করে। 

আদি ব্রাহ্মসমাজের সদস্যরা তাদের বিভিন্ন প্রচার পুস্তিকায় বলেন, হিন্দু ধর্ম সকল ধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কারন - 
  1. কোন ব্যক্তি বিশেষের নামে এর নামকরন হয় নি।
  2. ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে এই ধর্ম কোন মধ্যস্থতাকারীকে মানে না। 
  3. অন্য ধর্মে পুজা বা উপসনা করা হয় পুরস্কার, পুন্য লাভ বা স্বর্গ প্রাপ্তির লোভে। কিন্তু হিন্দুরা ঈশ্বরকে পুজা করে আত্মার আত্মা (পরমাত্মা) হিসাবে।
  4. এই ধর্ম অসাম্প্রদায়িক ও সমন্বয়বাদী। সকলের কল্যানকামী।
  5. এই ধর্ম কাউকে ধর্মান্তরিতও করে না। 
  6. এই ধর্ম এত সহনশীল এবং ভক্তিমূলক যে সম্পূর্ণ ভাবে তা কাল ও বোধ নিরপেক্ষ। 
  7. সর্বোপরি, হিন্দু ধর্ম হলো কর্তব্যবোধে উদ্দীপ্ত একটি জীবন দর্শন এবং সকল জ্ঞানের আদি উৎস। 
বলা বাহুল্য, হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কাছে আদি ব্রাহ্মসমাজের এই আত্মসমর্পণ এবং আত্মনিবেদন নিঃসন্দেহে ব্রাহ্ম আদর্শের বিচ্যুতি ছিলো। কিন্তু আদি ব্রাহ্মসমাজের এই আদর্শহীনতা ও স্খলন সমাজের কোন ক্ষতি করে নি। উল্টে দেশকে শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করেছিলো। 

আদি ব্রাহ্মসমাজের ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অনুশীলন ও  প্রচার উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পর ভারতের জাতীয়তাবোধের জাগরনে অনেকখানি সাহায্য করে। 

এই সময় ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী জাতীয়তাবোধের দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়ে ব্রাহ্ম নবগোপাল মিত্র প্রতিষ্ঠা করেন - হিন্দুমেলা (১৮৬৭)। রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র, নবীন সেন, বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করেন নানা দেশাত্মবোধক সঙ্গীত। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আঁকেন ভারতমাতা ছবি। এখানে মনে রাখতে হবে, জাতীয়তাবোধের এই সমস্ত স্মারক গুলির সবকটির সঙ্গেই হিন্দু ঐতিহ্য ও গৌরবময় অতীতের বিষয়টি জড়িত ছিলো। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে তাই আদি ব্রাহ্মসমাজের অবদানকে কখনই উপেক্ষা করা যায় না। 

শেষকথা

যাইহোক, দেবেন্দ্রনাথের আদি ব্রাহ্মসমাজ যখন হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দুর্বার স্রোতে একটু একটু করে বিলিন হয়ে যেতে শুরু করেছিলো, তখন তার অপর পাড়ে তখনও পূর্ন অস্তিত্ব নিয়ে টিকে ছিলো ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ। নবীন স্রোতের ঢেউয়ে তার বিলিন হয়ে যাওয়ার সময় তখনও আসে নি। কিন্তু সেই সময় খুব দূরেও ছিলো না। 

 গঙ্গার অপর পাড়ে  দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের যে অস্পষ্ট শঙ্খধ্বনী শোনা যাচ্ছিলো, তাই যেন জানান দিচ্ছিলো কালের দুর্বার স্রোতে তারও বিলীন হবার সময় আসন্ন। তীরে এসে টেনে নিয়ে যাবার জোয়ারের জলের মুহুর্মুহু আকর্ষন ইতিমধ্যেই দক্ষিণেশ্বরে মন্দিরে শুরু হয়ে গিয়েছিলো... । 

চলবে.... 

পঞ্চম পর্ব - "নববিধান ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ"। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post