কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যা

 ভারতে ইংরেজ শাসনকালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিলো - কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠা। এদেশে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার প্রকৃত সূচনা এবং বিকাশ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মধ্য দিয়েই ঘটেছিলো।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিদ্যা
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যা

ভারতের আদি চিকিৎসা ব্যবস্থা 

প্রাচীনকাল থেকে এদেশে ইংরেজদের আগমনের সময়কাল পর্যন্ত ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিলো মূলত কবিরাজিআয়ুর্বেদ চিকিৎসা। অনেক ক্ষেত্রেই এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগ নির্নয় করতে এবং রোগ নিবারন করতে অনেক সময় লেগে যেতো। 

১৭০৭ খ্রিঃ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার সামরিক বাহিনীর চিকিৎসার জন্য একটি ছোট আকারের হাসপাতাল তৈরি করেছিলো। পরে কলকাতার বাসিন্দাদের ছোটো খাটো চিকিৎসার জন্য নেটিভ হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল এবং কলকাতার ইংরেজ সাহেবদের জন্য জেনারেল হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়। 

কিন্তু ইতিমধ্যে কলকাতা শহরের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে নেটিভ হসপিটালের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে নেটিভ হসপিটালের বিকল্প একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন পড়লো। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল এর ফলেই গড়ে উঠেছিলো। 

প্রেক্ষাপট ও কলেজ প্রতিষ্ঠা 

  1. কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার আগে নেটিভ মেডিক্যাল স্কুল, কলকাতা সংস্কৃত কলেজ এবং কলকাতা মাদ্রাসায় পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পড়ানো হলেও, তার মান ঠিক ছিলো না। সেখানে শুধুমাত্র থিওরি ক্লাস করানো হতো। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করানোর কোন পরিকাঠামো সেখানে ছিলো না। 
  2. ইতিমধ্যে কলকাতায় জনস্বাস্থ্যের হাল যথেষ্ট খারাপ হতে থাকে। কলকাতার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ,খাটা পায় খানা,অপরিস্কার নালা নর্দমা, ইত্যাদির কারনে প্রতি বছর অজানা জ্বর ও আমাশয়ে বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছিলো। ফলে নেটিভ হসপিটালের ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়ছিলো। এমতাবস্থায়, নেটিভ হসপিটালের গর্ভনররা সরকারকে কলকাতায় একটি "ফিভার হসপিটাল" তৈরির প্রস্তাব দেন।
  3. এই প্রেক্ষাপটে সি. জে. গ্রান্টের নেতৃত্বে বেন্টিঙ্ক ১৮৩৩ খ্রিঃ একটি "মেডিক্যাল কমিশন" গঠন করেন। এই কমিশন ১৮৩৪ খ্রিঃ ২০ অক্টোবর তার রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্ট ও সুপারিশের ভিত্তিতে নেটিভ স্কুল, সংস্কৃত কলেজ এবং কলকাতা মাদ্রাসায় চিকিৎসা বিদ্যাচর্চা বন্ধ করে দিয়ে বেন্টিঙ্ক "কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ" প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষনা করেন।
এই ঘোষনার ফলে ১৮৩৫ খ্রিঃ ২৮ জানুয়ারি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

উদ্দেশ্য

৪ টি মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। যথা -
  1. বিলেত থেকে বহু অর্থ ব্যয়ে ডাক্তার না এনে এদেশেই পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার প্রচলন করা।
  2. জাতি, ধর্ম - বর্ন নির্বিশেষে ভারতীয় যুবকদের আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় দক্ষ করে তোলা।
  3. দেশের বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্র গুলিতে দক্ষ ডাক্তার ও নার্সের যোগান দেওয়া।
  4. জনস্বাস্থ্যের উন্নতি বিধান ও নেটিভদের যথার্থ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

শিক্ষকমন্ডলী

  • মেডিক্যাল কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ বা সুপারিটেন্ডেন ছিলেন মাউন্টফোর্ড জোসেফ ব্রামলি
  • ব্রামলি ছাড়াও ডঃ হ্যারি গুডিভ, দুজন সাহেব শিক্ষক এবং আরো দুজন দেশীয়  চিকিৎসক শিক্ষক মধুসূদন গুপ্ত এবং নবকৃষ্ণ গুপ্ত কে নিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের যাত্রা শুরু হয়।
  • ১৮৩৭ - ৩৮ খ্রিঃ কলেজের শিক্ষকদের সংখ্যা আরোও বৃদ্ধি করা হয়েছিলো। 

পঠনপাঠন ও ছাত্রভর্তি

  1. প্রাথমিকভাবে একটি প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়।
  2. ১৯৩৫ খ্রিঃ ২০ ফেব্রুয়ারি কলেজের পঠনপাঠন শুরু হয়।
  3. ১০০ জন ছাত্রের মধ্যে ৪৯ জন ছাত্রকে "ফাউন্ডেশন" ছাত্র হিসাবে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি নিয়ে ক্লাস শুরু করা হয়।
  4. প্রথম দিকে কলেজের নিজস্ব কোন ভবন না থাকায় ক্লাস হয়েছিলো হিন্দু কলেজে, কখনোবা হেয়ার স্কুল বা স্কটিশ চার্চ কলেজে।
  5. চিকিৎসা বিদ্যা শিক্ষায় উৎসাহিত করার জন্য কলেজের প্রতিটি ছাত্রকে ৭ টাকা করে বৃত্তি দেওয়া হয়েছিলো।
  6. চার বছর থেকে ছয় বছরের মধ্যে পড়া শেষ করে তারা "নেটিভ ডক্টর" নামে পরিচিত হতেন। তাদের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসাবে নিযুক্ত করা হতো।
  7. জনসেবায় নিযুক্ত হওয়ার পর তাদের বেতন দেওয়া হতো মাসে ৩০ টাকা। পরে তা বেড়ে করা হয়েছিলো - ৪০ - ৫০ টাকা।

পাঠ্যক্রম

  1. কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম দিকে ভেষজ, অঙ্গব্যবচ্ছেদ বিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা, বিভিন্ন রকম ঔষুধের নাম ও গুনগুন ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো।
  2. ১৮৪৫ খ্রিঃ পর থেকে কলেজের পাঠ্যক্রমকে আধুনিক ও যুগপযোগী করে তোলার জন্য ইংল্যান্ডের "রয়েল কলেজ অব সার্জেন" এর পাঠ্যক্রম এখানে অনুসরণ করা হতে থাকে।
  3. এছাড়া, ১৮৪৫ খ্রিঃ থেকেই চিকিৎসা বিদ্যার মেধাবী ছাত্রদের উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষন দানের জন্য ইংল্যান্ডে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

কলেজ ও হাসপাতালের ভবন নির্মাণ

  1. ১৮৩৫ খ্রিঃ জুন মাসে বর্তমান মেডিক্যাল কলেজের কাছে রামকমল সেনের একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে প্রাথমিক ভাবে মেডিক্যাল কলেজের ক্লাস শুরু হয়।
  2. পরে দেশী বিদেশী বিভিন্ন ব্যক্তিদের সহায়তায় মেডিক্যাল কলেজের ভবন ও প্র্যাকটিক্যাল অনুশীলনের জন্য হাসপাতাল তৈরি হয়। 
  3. কলেজের হাসপাতালের জন্য জমিদান করেন ধনী ব্যবসায়ী মতিলাল শীল
  4. ১৮৩৮ খ্রিঃ মেডিক্যাল কলেজের ২০ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল ভবনের উদ্বোধন করা হয়।
  5. এর দুবছর পরে ১০০ শয্যার একটি বৃহৎ ভবন নির্মাণ করা হয়।

আর্থিক সাহায্য

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং কলেজের উৎকর্ষ সাধনে বহু দেশী বিদেশী ব্যক্তি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - ডেভিড হেয়ার, মতিলাল শীল, রামকমল সেন, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়, মথুরানাথ মল্লিক প্রমুখ।

প্রথম শবব্যবচ্ছেদ

পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার অন্যতম অঙ্গ ছিলো শব ব্যবচ্ছেদ। ১৮৩৬ খ্রিঃ মধুসূদন গুপ্ত কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম শবব্যবচ্ছেদ করে এক যুগান্তকারী নজির সৃষ্টি করেন। তাকে এই কাজে সাহায্য করেন, উমাচরন শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত এবং নবীনচন্দ্র দে

কলেজের মানোন্নয়ন

১৮৪৫ খ্রিঃ পর থেকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ব্যপক মানোন্নয়ন ঘটানো হয়।
  1. ১৮৪৫ খ্রিঃ ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ অব সার্জেনের পাঠ্যক্রম অনুযায়ী কলেজের সিলেবাসের সংস্কার করা হয়।
  2. ১৯৪৫ খ্রিঃ চিকিৎসা বিদ্যায় উচ্চশিক্ষার জন্য ৪ জন ছাত্রকে ইংল্যান্ডে প্রেরন করা হয়। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - ভোলানাথ বসু, গোপাল চন্দ্র শীল, দ্বারকানাথ বসু, সূর্যকুমার চক্রবর্তী। এরাই ছিলেন ভারতের প্রথম বিলেত ফেরত ডাক্তার। 
  3. ১৮৪৬ খ্রিঃ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ অব সার্জেন এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্বীকৃতি লাভ করে।
  4. ১৮৫০ খ্রিঃ চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে ৮ টি চেয়ার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
  5. শিক্ষকদের সংখ্যাও বহুগুন বৃদ্ধি করা হয়। 
  6. চিকিৎসা বিদ্যার পাঠ্যক্রমের মেয়াদ করা হয় ৫ বছর।
  7. ১৮৫২ খ্রিঃ মেডিক্যাল কলেজের নতুন ভবনের নির্মান করা হয়।
  8. ১৮৫৭ খ্রিঃ মেডিক্যাল কলেজ সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়।

অবদান

ভারতে পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিদ্যার বিকাশে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এক বিরাট ঐতিহাসিক অবদানের সাক্ষ্য রাখে।
  1. ভারতে ব্রিটিশ শাসনের জনস্বাস্থ্য নীতি ও সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রকৃত সূচনা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই ঘটে।
  2.  পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিদ্যার যথার্থ সূত্রপাতপ্রসারও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ঘটে।
  3. এই কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে ১৮৫৮ খ্রিঃ মধ্যে ভারতের প্রায় ৫০০ ছাত্র পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে।
  4. এই সমস্ত ছাত্রদের ডাক্তার হিসাবে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল গুলিতে নিযুক্ত করা হয়। 
  5. কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই সরকার মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠা করে।
  6. কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে ঔপনিবেশিক আমলে জনস্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটে। অনেক ভারতীয় পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার সুযোগ লাভ করে। ক্রমে মহামারি ও বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে সচেতনা সৃষ্টি হয়।
এইভাবেই দেখা যায়, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের হাত ধরে ধীরে ধীরে এদেশে পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিদ্যায় বিকাশ ঘটতে শুরু করে। ইংরেজরা ভারত ত্যাগের আগে দেশের প্রতিটি প্রান্তেই ইওরোপীয় চিকিৎসা পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে এবং এই চিকিৎসা বিদ্যাই সবথেকে উত্তম ও গ্রহনযোগ্য চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসাবে সারা দেশে স্বীকৃতি লাভ করে। পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিদ্যার চাপে কালক্রমে ভারতীয় আয়ুর্বেদকবিরাজি চিকিৎসা বিদ্যার ইতি ঘটে। 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post