উনিশ শতকে কলকাতার বাইরে যেসকল সংবাদপত্র গুলি প্রকাশিত হতো তার মধ্যে অন্যতম সফল ও জনপ্রিয় পত্রিকা ছিলো - "গ্রামবার্তা প্রকাশিকা" পত্রিকা।
|
গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা
|
প্রকাশকাল
বামাবোধিনী পত্রিকা যে বছর প্রকাশিত হয়েছিলো, সেই বছরটিতেই অর্থাৎ ১৮৬৩ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে "গ্রামবার্তা প্রকাশিকা" প্রকাশিত হয়।১৮৬৩ থেকে ১৮৮৪ খ্রিঃ পর্যন্ত, প্রায় ২২ বছর এই পত্রিকা টিকে ছিলো।
সম্পাদক
গ্রামবার্তা প্রকাশিকার সম্পাদক ছিলেন হরিনাথ মজুমদার। তিনি "কাঙাল হরিনাথ" ও "ফিকির চাঁদ বাউল" নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। আজীবন দারিদ্রতার জন্যই তাকে" "কাঙাল হরিনাথ" নামে ডাকা হতো। অন্যদিকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি বাউল সঙ্গীতের পথিকৃৎ ছিলেন বলে তাকে ফিকির চাঁদ বাউল বলেও ডাকা হতো।
কাঙাল হরিনাথ ছিলেন যথার্থ অর্থেই বাংলার" গ্রামীন সাংবাদিকতার জনক"।
সদর কার্যালয়
গ্রামবার্তা প্রকাশিকা বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি গ্রামের মথুরানাথ প্রেস থেকে প্রকাশিত হতো।
তবে প্রথমদিকে নয় বছর পত্রিকাটি কলকাতার "গিরিশ বিদ্যারত্ন প্রেস" থেকেই ছেপে বেরতো।
পত্রিকার ধরন
"বার্তা" শব্দটির অর্থ হলো সংবাদ বা খবর। "গ্রামবার্তা" কথাটির অর্থ হলো গ্রামের সংবাদ। সুতরাং গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার নাম থেকেই বোঝা যায়, এই পত্রিকা গ্রামীন সমাজের নানা সংবাদ পরিবেশন করতো।
সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞান বিষয়ক নানা লেখাপত্রের পাশাপাশি এই পত্রিকায় গ্রামীন সমাজের নানা সমস্যা, কৃষকদের ওপর জমিদার, নীলকর ও পুলিশি নির্যাতনের নানা সংবাদও পরিবেশিত হতো।
গ্রামবার্তা প্রকাশিকা প্রথম দিকে ছিলো একটি মাসিক পত্রিকা।পরে ১৮৬৪ খ্রিঃ এটি পাক্ষিক এবং ১৮৭১ খ্রিঃ সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
গ্রামবার্তা প্রকাশিকার মূল্য বা দাম
গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকাটি যখন সাপ্তাহিক ছিলো, তখন এর দাম ছিলো মাত্র পাঁচ আনা।
গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার উদ্দেশ্য
গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ছিলো ৪ টি -
- গ্রামীণ সমাজের নির্যাতিত মানুষদের কথা ও সংবাদ তুলে ধরা,
- গ্রামসমাজের ওপর জমিদার, মহাজন, নীলকর এবং পুলিশি অত্যাচারের স্বরূপ উন্মোচন করা,
- গ্রামোন্নয়ন, গ্রামজীবনের সমস্যা ও সংস্কৃতির নানা দিক গুলিকে তুলে ধরা,
- গ্রামসমাজ সম্পর্কে নির্লিপ্ত শহুরে শ্রেনীকে গ্রামীন সমাজ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা।
গ্রামবার্তা প্রকাশিকার গুরুত্ব
গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও মূল্য ছিলো অপরিসীম। সংক্ষেপে এর গুরুত্বের প্রধান দিক গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) গ্রামীন সমাজের মুখপত্র
গ্রামবার্তা প্রকাশিকা ছিলো গ্রামীন জনগনের আশা আকাঙ্খার প্রতীক ও মুখপত্র। কারন উনিশ শতকের অধিকাংশ শহরের পত্র পত্রিকা গুলিতে গ্রামের মানুষ ছিলেন উপেক্ষিত। অথচ সমাজের সবথেকে বেশি সংখ্যক মানুষ গ্রামেই বসবাস করেন। উনিশ শতকের সমাজ ব্যবস্থায় সবথেকে বেশি নির্যাতিত ও অত্যাচারিত ছিলো গ্রামীন সমাজ।
তাই গ্রামীন সমাজের প্রকৃত সংবাদ পরিবেশন ও স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই "গ্রামবার্তা প্রকাশিকা" প্রকাশিত হয়েছিলো। গ্রামবার্তা প্রকাশিকা কিছুটা হলেও, শহুরে শিক্ষিত শ্রেনী ও সরকারের কাছে গ্রামীন সমাজের মূল সমস্যা গুলির গুরুত্ব উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছিলো।
(২.) জমিদারদের শোষন ও অত্যাচার
গ্রামীন সমাজে জমিদারদের শোষন ও নিপীড়নের নানা সংবাদ গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নির্ভিক ভাবে প্রকাশ করতো। শিলাইদহে বিখ্যাত ঠাকুর বাড়ির জমিদারদের প্রজাপীড়নের খবরও নির্ভিক ভাবে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা প্রকাশ করেছিলো। এইজন্য ঠাকুর পরিবারের লাঠিয়াল বাহিনী বেশ কয়েকবার কাঙাল হরিনাথকে আক্রমনও করেছিলো।
তবে এই প্রতিহিংসা ও আক্রমণ সত্ত্বেও, কাঙাল হরিনাথ কখনোই আদর্শচ্যুত হন নি। পাবনার কৃষক বিদ্রোহের সময় কলকাতার সমস্ত পত্রিকা জমিদারদের পক্ষ অবলম্বন করলেও, একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলো গ্রামবার্তা প্রকাশিকা। পাবনা বিদ্রোহে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা প্রজাদের পক্ষ অবলম্বন করে এবং জমিদারদের প্রজাপীড়নের তীব্র সমালোচনা করে।
(৩.) মহাজনদের শোষন
গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় গ্রামীন সমাজে মহাজনদের নানা শোষন ও অত্যাচারের সংবাদও প্রকাশিত হতো। মহাজনরা কিভাবে চড়া সুদে কৃষকদের ঋন দিয়ে তাদের কৃতদাসে পরিনত করে এবং কৃষকদের জমিগুলি আত্মসাৎ করে তার নানা সংবাদ এই পত্রিকা তুলে ধরতো।
(৪.) নীলকরদের অত্যাচার
জমিদার, মহাজনদের পাশাপাশি গ্রামীন সমাজে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের নানা সংবাদও গ্রামবার্তা প্রকাশিকা প্রকাশ করতো।
মনে রাখতে হবে, ১৮৬০ খ্রিঃ বাংলাদেশে নীল বিদ্রোহের সূচনা হলেও, এই বিদ্রোহের পর একেবারেই হঠাৎ করে বাংলাদেশের নীলচাষের অবসান হয়ে যায় নি। নীলকরদের অত্যাচার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল গুলিতে তখনও চলতো।১৮৬৩ খ্রিঃ প্রকাশিত গ্রামবার্তায় নীলকরদের অত্যাচারের সেইসব খবর গুলি প্রকাশিত হতো।
(৫.) পুলিশি অত্যাচার
গ্রামীন সমাজে পুলিশি নির্যাতন, থানায় অসহায় দরিদ্র মানুষদের প্রতিকার না পাওয়া, এবং ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটদের অত্যাচারের নানা সংবাদ গ্রামবার্তা প্রকাশিকা তুলে ধরতো।
একবার মিঃ হামফ্রি নামে পাবনার এক ম্যাজিস্ট্রেট গ্রাম পরিদর্শনে এসে এক দরিদ্র বিধবার দুগ্ধবতী গাভী অপহরন করলে হরিনাথ "গরু চোর ম্যাজিস্ট্রেট" শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। ম্যাজিস্ট্রেট হরিনাথ কে শাস্তি দেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
(৬.) সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা
গ্রামীন সমাজের শোষন ও অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি এই পত্রিকায় সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ও গ্রামীন সংস্কৃতি নিয়েও আলোচনা করা হতো।
লালন ফকিরের বাউল গান গুলি গ্রামবার্তা প্রকাশিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো। সাহিত্য পত্র হিসাবেও এই পত্রিকা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। জলধর সেন, মীর মুশারফ হোসেনের মতো লেখকরা গ্রামবার্তা প্রকাশিকাতে লেখনীর মধ্য দিয়েই তাদের লেখক জীবনের সূত্রপাত করেছিলেন। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয় কুমার মৈত্র, প্রমুখ ব্যক্তিদের নানা লেখাপত্রও এই পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।
(৭.) গ্রামীন সমাজের উন্নয়ন সম্পর্কে মতামত
গ্রামবার্তা প্রকাশিকা গ্রামীন সমাজের নানা সমস্যা ও গ্রামীন উন্নয়ন সম্পর্কেও তার মতামত তুলে ধরতো।
প্রজাদের প্রতি জমিদারদের কর্তব্য, গ্রামে নদী ও জল নিকাশী ব্যবস্থার সংস্কার, জলকষ্ট নিবারন, ডাক ও পুলিশি বিভাগের সংস্কার, গ্রামাঞ্চলে ডাক মারফৎ মানি অর্ডারের ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি সম্পর্কে নানা প্রবন্ধ গ্রামবার্তায় প্রকাশিত হতো।
(৮.) নারী সমাজের উন্নয়নের কথা
গ্রাম সমাজের শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেনী গুলির কথা গ্রামবার্তা প্রকাশিকা তুলে ধরতো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই পত্রিকায় নারী সমাজের কথাও স্থান লাভ করেছিলো। কারন সামাজিক কুসংস্কার ও নিপীড়নের সবচেয়ে বেশি শিকার হতেন গ্রামের মেয়েরা।
গ্রামবার্তা প্রকাশিকা তাই নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছিলো। পুরুষের বহু বিবাহ প্রথার বিরোধিতা করেছিলো।
মূল্যায়ন
ঔপনিবেশিক আমলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে সবথেকে বেশি শোষিত ও অত্যাচারিত ছিলো বাংলার গ্রামীন সমাজ। গ্রামবার্তা প্রকাশিকা থেকে আমরা সেই অত্যাচারিত সমাজের বাস্তব অবস্থা, গ্রামজীবনের বহুবিধ সমস্যা এবং গ্রামীন জনজীবনের প্রতি সরকার ও শহুরে শিক্ষিত শ্রেনীর নির্লিপ্ততার কথা জানতে পারি।
গ্রামবার্তা প্রকাশিকা মাত্র ২২ বছর টিকে থাকতে পেরেছিলো। সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই পত্রিকা শেষপর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। তৎকালীন সময়ের কেউই এই পত্রিকার পাশে এসে দাঁড়ায় নি। কেননা গ্রামবার্তা জমিদার, মহাজন, নীলকর, সরকারি আধিকারিক, পুলিশ, সুবিধাবাদী শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী কারও স্বার্থ পূরন করতে পারে নি। বরং তাদের সত্যিকারের মুখোসের উন্মোচন করে দিয়েছিলো এই পত্রিকা।
এই কারনে এদের সকলের কাছেই শত্রুতে পরিনত হন কাঙাল হরিনাথ। শাসকের ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত প্রভাবশালী শ্রেনীর বিরুদ্ধে কখনই অসম যুদ্ধ চালিয়ে জয়লাভ করা যায় না। গ্রামবার্তা প্রকাশিকাও পারে নি। কিন্তু একেবারেই যে সে ব্যর্থ হয়েছিলো, তাও নয়।
গ্রামবার্তা প্রকাশিকার নির্ভিক সাংবাদিকতার জন্য সমকালীন সময়ে গ্রামীন মানুষদের ওপর জমিদার, মহাজনদের শোষন কিছুটা হলেও কমেছিলো। পাশাপাশি গ্রাম সমাজের নির্যাতিত মানুষদের মধ্যে শ্রেনী সচেতনতা গড়ে তুলতেও কিছুটা সাহায্য করেছিলো এই পত্রিকা।