১৮৬৩ খ্রিঃ যখন বামাবোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হয়, তখন বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিলো মাত্র ৩৫ টি, এবং এগুলিতে ছাত্রী সংখ্যা ছিলো মাত্র ১,১৮৩ জন। এই তথ্য পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, ভারতে নারী শিক্ষার অগ্রগতি সেভাবে ঘটে নি।
নারী শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যালয় না থাকা, বা প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার থেকেও সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধকতা ছিলো সমাজের রক্ষনশীল মানসিকতা। পুরুষ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা লাভ করা অথবা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের সামাজিক স্বীকৃতি বা নারী স্বাধীনতা তখনও সমাজের সর্বত্র আসে নি।
এই প্রেক্ষাপটে দাড়িয়েই বাংলায় নারী শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্য নিয়ে ১৮৬৩ খ্রিঃ বামাবোধিনী সভার মুখপত্র হিসাবে বামাবোধিনী পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে।
নারী শিক্ষা প্রসারে বামাবোধিনী পত্রিকার ভূমিকা |
নারী শিক্ষা ও বামাবোধিনী
যাইহোক, এদেশে নারী শিক্ষার বিস্তারে বামাবোধিনী পত্রিকার প্রধান অবদান ও ভূমিকার দিকগুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) গৃহশিক্ষকের ভূমিকা
বামাবোধিনী পত্রিকা নারী শিক্ষার প্রসারে গৃহশিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো শিক্ষাকে সমস্ত নারীকুলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা এবং পারিবারিক রক্ষনশীলতার আবর্তে নারী শিক্ষাকে রূপায়িত করার একমাত্র বিকল্প পথ ছিলো অন্তঃপুর শিক্ষা। যেখানে বাড়িতে থেকেই পত্রিকার মধ্য দিয়ে মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ লাভ করবে। বামাবোধিনী এই কাজটি করেছিলো।
(২.) অন্তঃপুর শিক্ষার পাঠ্যক্রম
মেয়েরা যাতে বাড়িতে থেকেই শিক্ষা লাভ করতে পারে, সেজন্য বামাবোধিনী পত্রিকা পাঁচ বছরের অন্তঃপুর স্ত্রী শিক্ষার একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করে।
প্রথম বছর থেকে পঞ্চম বছর পর্যন্ত নারীরা ধারাবাহিক ভাবে কি কি বিষয় পড়বে, বামাবোধিনী পত্রিকা তার একটি পাঠ্যক্রম ও এর উপযোগী পুস্তকের তালিকা প্রকাশ করে। পরীক্ষা গ্রহন এবং তাতে সাফল্য লাভকারীদের উৎকৃষ্ট মানের উত্তরপত্র গুলি বামাবোধিনী পত্রিকা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতো।
(৩.) নারী শিক্ষার আয়োজন
নারী শিক্ষার জন্য বামাবোধিনী পত্রিকায় এক ব্যপক আয়োজন করা হয়। পত্রিকায় ভাষাজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, জীবনচরিত, ইত্যাদি বিষয়ে নারী শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। তবে নারীদের মধ্যে শিক্ষা যাতে পুঁথিগত স্তরেই আবদ্ধ না থাকে, সে বিষয়েও বামাবোধিনী পত্রিকা গোষ্ঠীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিলো।
এই জন্য প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি বামাবোধিনীতে নারীদের নানা ব্যবহারিক শিক্ষাও দেওয়া হতো। যার মধ্যে অন্যতম ছিলো - গৃহপরিচর্যা, স্বাস্থ্য শিক্ষা, শিশু প্রতিপালন ও ধাত্রীবিদ্যা, ঘরোয়া চিকিৎসা বিদ্যা ইত্যাদি।
(৪.) নারী শিক্ষা সম্পর্কে জনমত গঠন
বামাবোধিনী পত্রিকার সময়কালেও নারী শিক্ষা সম্পর্কে নানা কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারনা সমাজে প্রচলিত ছিলো। এসময় প্রচার করা হতো, মেয়েরা লেখাপড়া করলে অল্প বয়সে বিধবা হবে। কিছু পুরুষও আশঙ্কা করতেন, মেয়েরা লেখাপড়া শিখে অধিকার সচেতন হয়ে পড়লে দুর্বিনীত হয়ে উঠতে পারে।
বামাবোধিনী পত্রিকা নারী শিক্ষা সম্পর্কে সমাজের সমস্ত সংশয় দূর করে সমাজে স্ত্রী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব তুলে ধরে। এ সম্পর্কে বামাবোধিনী পত্রিকায় লেখা হয়, সন্তানকে যথার্থভাবে গড়ে তুলতে হলে মায়ের শিক্ষার প্রয়োজন। মা যদি পুত্র কন্যাকে বিদ্যানুরাগী দেখতে চান, তবে তাকেও শিক্ষিত হতে হবে। কারন মায়ের শিক্ষা ও আচরনের ছাপ সন্তানদের ওপর এসে পড়ে।
(৫.) নারী স্বাধীনতা ও সচেতনতার প্রচার
বামাবোধিনী পত্রিকা নারীদের মর্যাদা ও অধিকারবোধ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। এইজন্য মেয়েরা শিক্ষিত হলে কোন কোন দিকে সুবিধা লাভ করতে পারে, সে সম্পর্কে বামাবোধিনীতে প্রায়ই নানা প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো।
বামাবোধিনীতে লেখা হয়, পুরুষরা দীর্ঘকাল নারীদের অল্প বুদ্ধি বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসেছে। একমাত্র শিক্ষা অর্জনের মধ্য দিয়েই নারী তার স্বক্ষমতার প্রমান দিতে পারে। এছাড়াও বামাবোধিনীতে লেখা হয়, মেয়েরা লেখাপড়া করলে অর্থোপার্জন করে নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারবে। অন্যদিকে এর ফলে সন্তানকে শিক্ষা দেবার জন্য অতিরিক্ত অর্থও খরচ করতে হবে না, নারী নিজেই সন্তানকে শিক্ষার পাঠ দিতে পারবে।
বলা বাহুল্য, বামাবোধিনীতে প্রকাশিত এই সমস্ত লেখা নারীদের মধ্যে শ্রেনী সচেতনতা সৃষ্টি করেছিলো এবং তাদের অধিকার বোধে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল।
(৬.) সামাজিক কু সংস্কার সম্পর্কে সচেতন করা
বামাবোধিনী নারীর বাল্য বিবাহ, অসম বিবাহ ইত্যাদি বিষয়েও নারীদের সচেতন করে তুলেছিলো। এই পত্রিকায় বাল্য বিবাহের কুফল হিসাবে ক্ষীনবল ও অল্পায়ু সন্তানের জন্ম, মায়ের স্বাস্থ্যের অবনতি, বিদ্যাশিক্ষায় বাধা ইত্যাদির কথা তুলে ধরা হয়। এছাড়া অসম বিবাহে স্বামী স্ত্রীর মানসিক তারতম্যের প্রভাবের দিক গুলিকেও তুলে ধরা হয়।
বামাবোধিনী পত্রিকার এই সমস্ত শিক্ষা নারীদের প্রচলিত সমাজের কুসংস্কার গুলি সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
(৭.) নারীদের উৎসাহিত করা
বামাবোধিনী পত্রিকা উনিশ শতকে অন্তপুরের খাঁচায় বন্দী নারী সমাজের হীনমন্যতা কাটিয়ে তুলতেও অনেকখানি সাহায্য করে। এই পত্রিকায় দেশ বিদেশের মেয়েদের নানা সাফল্য ও কৃতিত্বের সংবাদ গুলি পরিবেশন করা হতো। এছাড়া, নারীদের আঁকা ছবি, গল্প, কবিতা এতে প্রকাশিত হতো। এগুলি নারীদের উৎসাহিত করে নারী জাগরনের পথকে প্রশস্ত করেছিলো।
মূল্যায়ন
এইভাবে দেখা যায়, উনিশ শতকে নারী শিক্ষার বিস্তারে বামাবোধিনী পত্রিকা এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। নারী শিক্ষার বিস্তারের পাশাপাশি বামাবোধিনী পত্রিকা সমাজে নারী শিক্ষার উপযোগিতা এবং সমকালীন সময়ে নারী শিক্ষার কাঙ্খিত পরিবেশের ওপরেও গুরুত্ব আরোপ করেছিলো।
বামাবোধিনীতে মেয়েদের শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষিকা তৈরির কথা বলা হয়, যা ইতিপূর্বে কেউই সেভাবে গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করেন নি। পুরুষ শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণে নারী যেমন স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে না। তেমনই নারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রীক অনেক শিক্ষাও পুরুষ দিতে পারেন না। এই কারনে বামাবোধিনী পত্রিকা তার প্রবন্ধাবলীতে নারী শিক্ষিকার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে।
বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা গুলি পরবর্তীকালে "নারীশিক্ষা" নামে দুই খন্ডের একটি পুস্তকে ছেপে প্রকাশিত হয়। এই সংকলিত পুস্তকটি পরবর্তীকালে নারী শিক্ষায় বিশেষ অবদান রাখে।
সীমাবদ্ধতা
তবে মনে রাখতে হবে, বামাবোধিনী "পত্রিকার মধ্য দিয়ে" নারী শিক্ষার যে ব্যপক আয়োজন করেছিলো, তার সম্পূর্ণ সুযোগ নারীরা লাভ করতে নি। অন্তঃপুর শিক্ষার ৫ বছরের পাঠ্যক্রম অসম্পূর্ণ রেখেই সাংসারিক চাপে অনেকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতেন। অনেক মেয়েদের শিক্ষা লাভ সম্পূর্ন হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। এই সব কারনে নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য খুব একটা সফলতা লাভ করতে পারে নি।
এই কারনে বামাবোধিনী পত্রিকা বারংবার তার অন্তঃপুর শিক্ষার পাঠ্যক্রমকে পরিবর্তন করেছিলো। তাকে আরোও একটু সহজ ও সরল করে তোলার চেষ্টা করেছিলো।
তবে এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, উনিশ শতকে বামাবোধিনী পত্রিকা নারী শিক্ষার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলো, তাকে সম্পূর্ণ নিস্ফল বা ব্যর্থ কখনোই বলা যাবে না। বামাবোধিনী নারী সমাজ এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ উভয়ের কাছেই নারী শিক্ষার উপযোগীতা ও প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছিলো। নারীদের মধ্যে শ্রেনী সচেতনতার জাগরন ঘটাতে পেরেছিলো। এগুলিই ছিলো এর সবচেয়ে বড়ো অবদানের দিক।