বঙ্গদর্শন পত্রিকা

 উনিশ শতকে বাংলায় প্রকাশিত পত্রিকা গুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় পত্রিকা ছিলো "বঙ্গদর্শন"।

বঙ্গদর্শন পত্রিকা
বঙ্গদর্শন পত্রিকা 

প্রকাশকাল

১৮৭২ খ্রিঃ ১২ এপ্রিল, কলকাতার ভবানীপুরের পিপুলপাতি লেনের প্রেস থেকে "বঙ্গদর্শন" প্রথম প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ফলেই এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিলো। এর মুদ্রাকর এবং প্রকাশক ছিলেন ব্রজমাধব বসু

পত্রিকার ধরন ও বিষয়বস্তু

বঙ্গদর্শন ছিলো একটি মাসিক সাহিত্যধর্মী পত্রিকা। এতে বাংলা সাহিত্য, প্রবন্ধ, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, সঙ্গীত, কৃষিতত্ত্ব, সমাজ নীতি, ভাষাচর্চা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হতো। এছাড়া, উনিশ শতকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য সাহিত্য গ্রন্থ গুলিরও সমালোচনা মূলক নানা লেখাপত্র বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হতো।

সম্পাদক

"বঙ্গদর্শন" পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ৪ জন সম্পাদক। 

  • বঙ্গদর্শনের প্রথম সম্পাদক ছিলেন - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
  • কিছু সময় বিরতির পর দ্বিতীয় পর্যায়ের বঙ্গদর্শন পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পর্বে বঙ্গদর্শনের সম্পাদক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। 
  • তৃতীয় পর্যায়ের বঙ্গদর্শনের সম্পাদক ছিলেন শ্রীশচন্দ্র মজুমদার
  • চতুর্থ পর্যায়ে বঙ্গদর্শনের সম্পাদনা করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, বঙ্গদর্শন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত প্রথম তিন জন সম্পাদকই ছিলেন সরকারি দপ্তরের উচ্চপদস্থ চাকুরে। বঙ্কিমচন্দ্র এবং সঞ্জীবচন্দ্র ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। শ্রীশচন্দ্র মজুমদার ছিলেন দুমকার সাব ডেপুটি। 

পত্রিকার মূল্য বা দাম 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সময়ে প্রথম তিন বছরে বঙ্গদর্শনের মূল্য ছিলো বার্ষিক সাড়ে তিন টাকা। কিন্তু ডাকযোগে নিতে হলে দিতে হতো চার টাকা। 

বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনার শেষের বছরটিতে পত্রিকার দাম কিছুটা কমে হয়েছিলো যথাক্রমে তিন টাকাসাড়ে তিন টাকা। সঞ্জীবচন্দ্রের সময়ে বঙ্গদর্শনের দাম বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪ টাকা। 

বঙ্গদর্শন প্রকাশের পশ্চাৎপট 

আমরা আগেই আলোচনা করলাম বঙ্কিমচন্দ্র সরকারি অফিসের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকুরি করায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাকে সরকারি কাজের মধ্যেই বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকতে হতো। এমতাবস্থায় প্রশ্ন জাগে, বঙ্গীমচন্দ্র হঠাৎ করে বঙ্গদর্শনের মতো একটি পত্রিকা কেন প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন? আরোও সহজ ভাষায় বললে, বঙ্গদর্শন প্রকাশের পশ্চাৎপট কি ছিলো

মাথায় রাখতে হবে, বঙ্গদর্শন পত্রিকা প্রকাশ করবার আগেই বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্য রচনার কাজ শুরু করেছিলেন। এই সময় ইন্ডিয়ান ফিল্ড পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রকাশ করেন তার প্রথম উপন্যাস "রাজমোহনস ওয়াইফ" । এছাড়া, ক্যালকাটা রিভিউ, স্টেটসম্যান, সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাতে বঙ্কিমের নানা লেখা প্রকাশিত হয়। বঙ্গদর্শন আত্মপ্রকাশের আগেই বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুন্ডলা ইত্যাদি বাংলা উপন্যাস গুলি প্রকাশিত হয়। 

এই সময় বাংলা সাহিত্য চর্চা করতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বুঝতে পারেন, একশ্রেনীর শিক্ষিত বাঙালিদের কাছে বাংলা ভাষার অবস্থান ও কদর খুবই হীন। অনেক শিক্ষিত বাঙালি সেসময় বাংলা ভাষা চর্চা বা বাংলায় সাহিত্য রচনাকে খুব একটা গৌরবের বলে মনে করতেন না। 

ইতিমধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৬৯ খ্রিঃ শেষের দিকে বহরমপুরে বদলি হয়ে চলে আসেন। বহরমপুরে এসে বঙ্কিমচন্দ্র একটি সাহিত্যিক পরিমন্ডলের সান্নিধ্য লাভ করেন। এইসময় তিনি গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসেন। এদের সকলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করবার পর বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্য চর্চার জন্য একটি উপযোগী পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করেন। 

বঙ্গদর্শন প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য 

অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য ও তাগিদের দিক ছিলো ৩ টি
  1. মাতৃভাষার উন্নতি বিধান করা, 
  2. বাংলা ভাষাকে একটি গ্রহনযোগ্য, সাহিত্য উপযোগী শিক্ষিত শ্রেনীর ভাষা করে তোলা, 
  3. সাহিত্যের মাধ্যমে "দেশ ও জাতির" কল্যান সাধন করা। 

বঙ্গদর্শন প্রকাশনার বিভিন্ন দিক

বঙ্গদর্শন ৪ টি পর্যায়ে প্রকাশিত হয়েছিলো। বঙ্গদর্শন পত্রিকা প্রকাশের প্রথম বিজ্ঞাপন ১৮৭২ খ্রিঃ "এডুকেশন গেজেট" এবং "বার্ত্তাবহ" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 

প্রথম পর্যায় - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 

প্রথম পর্যায়ে (১৮৭২ - ১৮৭৬) বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন প্রকাশিত হয়।এই পর্বে ৪ বছরে ৪৮ মাসে বঙ্গদর্শনের মোট ৪৮ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ  তার সময়ে নিয়মিত ভাবে বঙ্গদর্শন প্রকাশিত হতো। এর পর ১৮৭৬ খ্রিঃ মার্চের শেষের দিকে বঙ্কিমচন্দ্র হঠাৎ করেই বঙ্গদর্শনের প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। 

বঙ্গদর্শনের প্রকাশনা বন্ধের পিছনে অবশ্য একাধিক কারন ছিলো। যেমন - 
  1. বয়স বৃদ্ধি ও শারীরিক অসুস্থতা জনিত কারনে পত্রিকা সম্পাদনায় বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে উৎসাহের অভাব। 
  2. বঙ্গদর্শনের প্রতি বিরুপ সমালোচনা। এইসময় কয়েকটি বড়ো পত্রিকা বঙ্গদর্শনকে ব্যঙ্গ করে "ব্যাঙ্গদর্শন" বলে উপহাস করতো। 
  3. পত্রিকা সম্পাদনায় বঙ্কিমকে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। শেষের দিকে এই পরিশ্রম তিনি আর নিতে পারছিলেন না। 
  4. জনপ্রিয়তা লাভ করবার পর বঙ্গদর্শনের লেখকরা উচ্চমূল্যের দক্ষিনা দাবি করতে থাকেন, যা বঙ্কিমের পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিলো না। 
  5. সবচেয়ে বড়ো কথা, বঙ্কিম যখন বঙ্গদর্শন প্রকাশ করেন, তখন উৎকৃষ্ট মানের কোন সাহিত্য উপযোগী পত্রিকা ছিলো না। কিন্তু ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি সাহিত্যধর্মী পত্রিকা প্রকাশিত হলে বঙ্গদর্শন প্রকাশের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। 
দ্বিতীয় পর্যায় - সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 

দ্বিতীয় পর্যায়ে বঙ্গদর্শন বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ১৮৭৭ খ্রিঃ প্রকাশিত হয়।
  • ১৮৭৬ খ্রিঃ জুলাই মাসে নবীনচন্দ্র সেন কাঁটালপাড়ায় বঙ্কিমের বাড়িতে গিয়ে তাকে পুনরায় বঙ্গদর্শন প্রকাশের ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। 
  • অবশেষে ১৮৭৭ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে সঞ্জীবচন্দ্রের বঙ্গদর্শন প্রেস থেকে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনাতেই দ্বিতীয় পর্যায়ের বঙ্গদর্শন প্রকাশিত হয়। এই সময় বঙ্কিমচন্দ্র অন্তরালে থেকে বঙ্গদর্শন সম্পাদনা করতেন বলে অনেক বঙ্কিম গবেষক মনে করে থাকেন।
  • সঞ্জীবচন্দ্রের সম্পাদনাতে প্রথম দুবছর বঙ্গদর্শন ভালো ভাবেই চলেছিলো। কিন্তু পরে কর্মসূত্রে তিনি বর্ধমান থেকে যশোরে বদলি হয়ে গেলে বঙ্গদর্শনের প্রকাশ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। 
  • এই সময় ছাপার কালি ও কাগজের অবনতি ঘটে। ছাপার ভুল ভ্রান্তি অনেক থেকে যায়। এছাড়া, সঞ্জীবচন্দ্রের পিতৃবিয়োগ, কর্মত্যাগ, ঋনগ্রস্থ হওয়া, ইত্যাদি নানা কারনে বঙ্গদর্শনের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। 
তৃতীয় পর্যায় - শ্রীশচন্দ্র মজুমদার

তৃতীয় পর্যায়ে শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন ১৮৮৩ খ্রিঃ প্রকাশিত হয়। এই পর্বে বঙ্গদর্শনের মাত্র ৪ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই সময় বঙ্গদর্শনে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস প্রকাশিত হলেও, কোন প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় নি। 

তৃতীয় পর্যায়ে বঙ্গদর্শনে প্রবন্ধ ও রম্যরচনা গুলি ভাড়ামির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এই সময় বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত "পশুপতি সম্বাদ" প্রবন্ধটি পড়ে বঙ্কিমচন্দ্র এতটাই চটে যান যে, ১৮৮৪ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে নিজের সত্ত্বাধিকার বলে বঙ্গদর্শনের প্রকাশনা চিরতরে বন্ধ করে দেন। 

চতুর্থ পর্যায় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর পর ১৯০১ খ্রিঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নবপর্যায়ে বঙ্গদর্শন প্রকাশ করেন। বঙ্গদর্শনের বাল্য স্মৃতির টানেই রবীন্দ্রনাথ বঙ্গদর্শন প্রকাশ করেন এবং বঙ্গদর্শনকে তার নিজের মতো করে সাজিয়ে নেন। রবীন্দ্র পর্বে বঙ্গদর্শন প্রায় ৫ বছর চলেছিলো। পরে জনপ্রিয়তা কমে গেলে এটি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। 

বঙ্গদর্শন পত্রিকার বৈশিষ্ট্য 

বঙ্গদর্শন পত্রিকার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দিক ছিলো, যা পত্রিকাটিকে এনে দিয়েছিলো কিছু অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য। যেমন - 
  1. বঙ্গদর্শন ছিলো বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম পেশাদারি পত্রিকা। ভাষা, শব্দচয়ন, বিষয় বৈচিত্র্য, মুদ্রন পরিপাট্য সব দিক থেকেই পত্রিকাটি তার রুচি, নিষ্ঠা ও শালীনতার পরিচয় দিয়েছিলো। 
  2. এটি ছিলো বাংলা ভাষার প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য পত্রিকা। 
  3. বিপরীত ও ভিন্ন মতের প্রকাশ (সম্পাদকের বিরোধী মত) এর অপর উল্লেখযোগ্য দিক ছিলো। 
  4. অন্য কোন সংবাদপত্রের কখনই সমালোচনা করতো না বঙ্গদর্শন। 
  5. বঙ্গদর্শনের অধিকাংশ লেখা সম্পাদককেই লিখতে হতো। পত্রিকার ধার ও ভার তাই অনেকাংশে সম্পাদকের ওপরেই নির্ভরশীল ছিলো
  6. লেখকের নাম বঙ্গদর্শনে কখনই প্রকাশিত হতো না। 
  7. বঙ্কিম পরবর্তী পর্ব গুলিতে বঙ্গদর্শনের অনিয়মিত প্রকাশ এর আরেক বৈশিষ্ট্য ছিলো।

বঙ্গদর্শনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শন পত্রিকার একাধিক ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক ছিলো - 
  1. বঙ্গদর্শন ছিলো বাংলা ভাষার প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য পত্রিকা। 
  2. বঙ্কিম সম্পাদিত বঙ্গদর্শন সাময়িকপত্রের ইতিহাসে এক নতুন স্বাদ বহন করে নিয়ে আসে। 
  3. এই পত্রিকার মাধ্যমেই বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম গোষ্ঠী বিভক্ত বাংলার লেখক কুলকে ঐক্যবদ্ধ করেন। 
  4. এই পত্রিকার মধ্য দিয়েই বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্য রচনার গতিপথ ও তার মুখ্য উদ্দেশ্যটি নির্দিষ্ট করে দেন। 
  5. বঙ্গদর্শনের মাধ্যমে বঙ্কিম বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চাকে শিক্ষিত শ্রেনীর কাছে গ্রহণযোগ্য ও আদরনীয় করে তোলেন। 
  6. সবচেয়ে বড়ো কথা, বঙ্গদর্শনের প্রকাশ না ঘটলে সাহিত্যিক বঙ্কিমকে হয়তো আমরা সেভাবে প্রস্ফুটিত হতে দেখতাম না। কেননা বঙ্কিমচন্দ্রের বেশিরভাগ উপন্যাসের প্রকাশ বঙ্গদর্শন পত্রিকার মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো - বিষবৃক্ষ, ইন্দিরা, চন্দ্রশেখর, রজনী, কৃষ্ণকান্তের উইল, রাজসিংহ,আনন্দমঠ,রাধারানী ইত্যাদি।

ইতিহাসের উপাদান হিসাবে বঙ্গদর্শন পত্রিকার ঐতিহাসিক মূল্য কতখানি? 

উনিশ শতকের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে বঙ্গদর্শন পত্রিকার ঐতিহাসিক অবদান ছিলো অপরিসীম। সংক্ষেপে বঙ্গদর্শনের প্রধান ঐতিহাসিক অবদানের দিক গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি - 

(১.) বাঙালির মনীষার প্রতিফলন

বঙ্গদর্শন ছিলো বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যধর্মী পত্রিকা। উনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালির আধুনিক চিন্তা,মনন ও মনীষার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো বঙ্গদর্শন পত্রিকার মধ্য দিয়ে। 

উনিশ শতকে তাই বাংলা ভাষাচর্চা, সাহিত্য রচনা, দর্শন চর্চা, বিজ্ঞান মনস্কতা প্রভৃতি বাঙালি মনীষার অনুসন্ধান পেতে হলে এবং বিবর্তনের ইতিহাস জানতে গেলে বঙ্গদর্শনের গুরুত্বকে কোন মতেই উপেক্ষা করা যায় না। 

(২.) সমকালীন সময়ের তথ্য 

বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ গুলি থেকে উনিশ শতকে কৃষক সমস্যা, ইংরেজদের অত্যাচার, অপশাসন, কলকাতার বাবু কালচার, ইত্যাদি বিভিন্ন দিক গুলি সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তা সেই সময়ের সামাজিক ইতিহাস রচনায় প্রভূত ভাবে সাহায্য করে থাকে। 

(৩.) সংবাদ পত্রের ইতিহাস 

উনিশ শতকের সংবাদপত্রের বিকাশ ও বিবর্তন ধারারই একটি পার্ট ছিলো বঙ্কিমচন্দ্রের "বঙ্গদর্শন" । বঙ্গদর্শনের বিকাশ ও ক্রমবিবর্তনের ধারাভাষ্য তাই আমাদের উনিশ শতকের সংবাদপত্রের বিকাশ ও বিবর্তনের ধারাটিকে জানতে ও বুঝতে অনেকখানি সাহায্য করে থাকে।

প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন, বঙ্গদর্শনই ছিলো বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম পেশাদারি পত্রিকা। কাগজ, মুদ্রন শৈলী, কালি ও সম্পাদনার নির্দিষ্ট নিয়মনীতি (অপর পত্রিকাকে সমালোচনা না করা) সম্বল করে বঙ্গদর্শন সংবাদপত্র প্রকাশের জগতে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলো, তা সংবাদপত্রের ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলো। 

(৪.) জাতীয়তাবাদের বিকাশ

বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। উনিশ শতকে বাংলা ভাষা চর্চার প্রতি শিক্ষিত বাঙালির যে উন্নাসিক ও হীন মানসিকতা ছিলো, বঙ্গদর্শন সেই হীনমন্যতা কাটিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষা চর্চাকে গৌরব ও আত্মমর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। 

বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত আনন্দমঠ, রাজসিংহ, চন্দ্রশেখর প্রভৃতি উপন্যাস গুলি বাঙালিদের হতাশা ও হীনমন্যতা কাটিয়ে দিয়ে তাদের দেশাত্মবোধের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তোলে। বিখ্যাত স্বদেশমূলক গান "বন্দেমাতারম" বঙ্গদর্শন পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়।

(৫.) সামাজিক ইতিহাসের তথ্য 

বঙ্গদর্শন থেকে উনিশ শতকে শিক্ষিত সমাজের রুচি, সংস্কৃতি, সমাজ ভাবনা, সামাজিক নৈতিকতা এবং জ্ঞানচর্চার বহুমুখীনতার দিক গুলি সম্পর্কে জানতে পারা যায়। এই সব তথ্য সামাজিক ইতিহাস রচনায় ঐতিহাসিককে অনেকখানি সাহায্য করে থাকে।

মূল্যায়ন 

সবশেষে মনে রাখতে হবে, বঙ্গদর্শন কিন্তু কোন সংবাদপত্র ছিলো না। এটি ছিলো উনিশ শতকের একটি "সাহিত্যিক সাময়িকপত্র" । এটি থেকে তাই উনিশ শতকে চলমান ঘটনাবলী সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও, এই পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালির রুচি, সংস্কৃতি, মনস্তত্ত্ব, বৌদ্ধিক চিন্তাধারা ও মনীষার পরিচয় পাওয়া যায়। এর সবচেয়ে বড়ো ঐতিহাসিক মূল্য এখানেই।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post