দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ

রামমোহন রায় যে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন, তা তার বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুরের অর্থসাহায্যে কোনরকমে টিকে ছিলো। দ্বারকানাথ ঠাকুরের পর ব্রাহ্মসমাজের হাল ধরেন তার পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

১৮৪৩ খ্রিঃ প্রায় ২৬ বছর বয়সে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন। তার ব্রাহ্মসমাজে যোগদানের পরেই ব্রাহ্ম আন্দোলনে এক নতুন গতিবেগের সঞ্চার হয়।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ 

তত্ত্ববোধিনী সভা ও ব্রাহ্মসমাজের সমন্বয় 

ব্রাহ্ম সমাজে যোগদানের আগেই অবশ্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৩৯ খ্রিঃ "তত্ত্ববোধিনী সভা" প্রতিষ্ঠা করেছিলেন১৮৪৩ খ্রিঃ ব্রাহ্মসমাজে যোগদানের পরে তিনি তত্ত্ববোধিনী সভাকে ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে মিশিয়ে দেন। ঠিক হয় তত্ত্ববোধিনী সভার নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এই উদ্দেশ্য পূরনের জন্য ১৮৪৩ খ্রিঃ তত্ত্ববোধিনী সভার  মুখপত্র "তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা" র প্রকাশ করা হয়। এর সম্পাদক নিযুক্ত হন অক্ষয় কুমার দত্ত। 

উপনিষদের চর্চা ও তার বানী প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৮৩৯ খ্রিঃ ৬ অক্টোবর, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ীর একটি ছোট্ট ঘরে দশজন আত্মীয় ও বন্ধুদের নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমে "তত্ত্বরঞ্জিনী সভা" প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে এই সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ সভার আচার্য পদ গ্রহণ করার পর এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন "তত্ত্ববোধিনী সভা"।

ব্রাহ্ম সমাজে দেবেন্দ্রনাথের অবদান

ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাসে দেবেন্দ্রনাথ পর্ব মূলত দুটি কারনে গুরুত্বপূর্ণ - 

  • এক, তার সময় থেকেই "ব্রাহ্ম" একটি পৃথক ধর্ম হিসাবে এবং" ব্রাহ্মসমাজ" একটি পৃথক সম্প্রদায় হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। 
  • দুই, হিন্দু ধর্মের সঙ্গে ব্রাহ্ম ধর্মের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ তার সময়কালেই ঘটে। 
বলা বাহুল্য, রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যে নতুন ধর্মভাবনার সৃষ্টি করেছিলেন, দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়ে সেই ধর্ম ভাবনাকেই "প্র্যাকটিক্যাল রূপ" দিয়ে একটি স্বতন্ত্র ধর্মে পরিনত করেন। 

ব্রাহ্ম সমাজের নিয়মের পরিবর্তন 

ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধিক নিয়ম কানুন প্রচলন করেন - 
  1. রামমোহনের সময় ব্রাহ্মসমাজের সদস্যপদ বাধ্যতামূলক ছিলো না। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজে বাধ্যতামূলক সদস্যপদের প্রচলন করেন। 
  2. ঠিক হয় যারা পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে একেশ্বরবাদকে মেনে নেওয়ার প্রতিজ্ঞা পত্রে স্বাক্ষর করবেন, তারাই ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হতে পারবেন। 
  3. এই নিয়ম অনুযায়ী ১৮৪৩ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয় কুমার দত্ত সহ ২১ জন ব্রাহ্ম প্রতিজ্ঞা পত্রে স্বাক্ষর করেন এবং পরে আরোও ৫০০ জন ব্রাহ্ম প্রতিজ্ঞা পত্রে স্বাক্ষর করে ব্রাহ্ম সমাজের অন্তর্ভুক্ত হন। 
  4. দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজকে পরিপূর্ণ অর্থে একটি ধর্মের রূপ দেবার জন্য - 
    • নানা আচার, নিয়ম ও অনুষ্ঠান প্রচলন করেন। 
    • দীক্ষা দান প্রথা প্রচলন করেন। 
    • সদস্যদের নিয়মিত চাঁদা ধার্য করেন। 
    • ব্রাহ্ম মত প্রচারের জন্য ধর্মপ্রচারক নিয়োগ করেন। 
১৮৪৪ খ্রিঃ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয় কুমার দত্ত সহ অন্যান্য ব্রাহ্মরা রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্ম মতে দীক্ষা নেন। যদিও তখনও পর্যন্ত ব্রাহ্ম ধর্ম হিন্দু ধর্মের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত ছিলো। দুই ধর্মের বিচ্ছেদ তখনও ঘটে নি। 
  

হিন্দু ধর্মের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয় কুমার দত্ত ও তার কিছু অনুগামী "বেদের অভ্রান্ততা" নিয়ে ব্রাহ্মসমাজে প্রশ্ন তোলেন। বেদ ঈশ্বর রচনা করেছেন বলে তারা বিশ্বাস করতেন না। দেবেন্দ্রনাথ প্রথম দিকে এই বিষয়টি মেনে না নিলেও, পরে অনুগামীদের চাপে বেদ সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য অনুসন্ধানের জন্য ১৮৪৫ - ৪৬ খ্রিঃ মধ্যে তার চারজন ছাত্রকে কাশীতে পাঠান। 

তারা ফিরে আসবার পর দেবেন্দ্রনাথের প্রচলিত বিশ্বাসের পরিবর্তন হয় এবং তিনি ঘোষনা করেন বেদ অপৌরুষেয় বা অভ্রান্ত নয়। এর ফলে বেদের অভ্রান্ততা অস্বীকার করে ব্রাহ্ম সমাজ হিন্দু ধর্ম থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং স্বতন্ত্র একটি ধর্ম হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। 

অনুগামীদের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের বিরোধ 

ব্রাহ্ম সমাজে যোগদানের প্রথম পর্বে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাধারা ছিলো অনেক বেশি সহজ সরল ও রেডিক্যাল। তিনি যেমন বেদের অপৌরুষেয়তাকে অস্বীকার করেন, তেমনি জাতিভেদ প্রথা ও উপনয়ন প্রথাকেও অস্বীকার করেন। তিনি এতটাই রেডিক্যাল ছিলেন যে, ১৮৪৬ খ্রিঃ ১ আগস্ট লন্ডনে যখন দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যু হয়, তখন সম্পূর্ণ পৌত্তলিকতা বর্জন করে ব্রাহ্ম মতে পিতৃশ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেন। 

দেবেন্দ্রনাথ তার রেডিক্যাল চিন্তা ভাবনা ব্রাহ্মসমাজেও প্রচলিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এটি নিয়ে তখন অক্ষয় কুমার দত্ত, রাখালদাস হালদার, রাজনারায়ন বসু, প্রমুখ ব্রাহ্ম দের সঙ্গে তাঁর বিরোধ উপস্থিত হয়। ঐ সমস্ত ব্রাহ্মরা বলেন, উপনয়ন বা জাতিভেদ প্রথা ত্যাগ করবার উপযুক্ত সময় এখনও আসে নি। 

দেবেন্দ্রনাথের হিমালয় যাত্রা 

যাইহোক, তীব্র বাদানুবাদ ও সাংসারিক নানা অশান্তির জন্য এর পর দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজ থেকে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নেন। এবং মনের শান্তির জন্য কিছুদিনের জন্য সংসার ত্যাগ করে হিমালয় যাত্রা করেন। 

১৮৫৮ খ্রিঃ ১৫ ই নভেম্বর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিমালয় থেকে কলকাতায় ফিরে এসে জানতে পারেন কেশবচন্দ্র সেন নামে এক তরুন ব্রাহ্ম ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা নিয়েছেন। কেশব চন্দ্রের তখন বয়স ছিলো ১৯, আর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ছিলো ৪০। ১৮৫৭ খ্রিঃ কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়েই ব্রাহ্মসমাজের পুরো রাশ নিজের হাতে নিয়ে নেন। 

এর ফলে ব্রাহ্মসমাজে দেবেন্দ্রনাথ যুগের আপাত অবসান হয়  এবং কেশবচন্দ্র যুগের সূচনা ঘটে। 

চলবে.... 

তৃতীয় পর্ব - কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post