কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ

 ১৮৫৭ খ্রিঃ মাত্র ১৯ বছর বয়সে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন। ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেওয়ার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ব্রাহ্মসমাজের রাশ পুরোপুরি কেশবচন্দ্রের হাতে চলে আসে। 

কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ
কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ 

ব্রাহ্ম সমাজে কেশবচন্দ্রের অবদান

কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেওয়ার পর ব্রাহ্ম সমাজ প্রকৃত অর্থে একটি "আন্দোলনের" রূপ নেয় এবং "নববলে" বলীয়ান হয়ে ওঠে।

  1. কেশবচন্দ্রের আদর্শ, নিষ্ঠা, ব্যক্তিত্ব এবং অসাধারণ বাগ্মীতার আকর্ষণে বহু শিক্ষিত তরুন দলে দলে ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দিতে থাকেন। এর ফলে অতি অল্প সময়ে ব্রাহ্মসমাজের সদস্য সংখ্যা ৫০০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ২০০০ । 
  2. কেশবচন্দ্র সেন তার অসাধারন সাংগঠনিক ক্ষমতার গুনে ব্রাহ্মধর্মকে বাংলার বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। 
  3. তার এই উদ্যোগের ফলে সারা ভারতে ব্রাহ্মসমাজের ৫৪ টি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।
  4. কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজের "সামাজিক ভাবনা ও দর্শনকে"  সংস্কারের রূপ দেন, এবং তাকে বাস্তবায়িত করতে একাধিক পত্র পত্রিকা ও সভাসমিতি প্রতিষ্ঠিত করেন। যেমন ব্রাহ্মবন্ধু সভা,সঙ্গত সভা, বামাবোধিনী সভা, সুলভ সমাচার পত্রিকা, ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা ইত্যাদি।
ব্রাহ্ম সমাজে কেশবচন্দ্রের সাংগঠনিক কাজকর্ম ও আধ্যাত্মিক সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬২ খ্রিঃ কেশবচন্দ্র সেনকে "ব্রহ্মানন্দ" উপাধি দেন এবং ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক ও আচার্য পদে নিয়োগ করেন। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম অব্রাহ্মন আচার্য

ব্রাহ্ম সমাজের অভ্যন্তরে পরিবর্তন

কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই ব্রাহ্মসমাজের অভ্যন্তরে একটি বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার অনুগামীরা ব্রাহ্মসমাজকে নিরাকার ব্রহ্ম উপাসনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু কেশবচন্দ্র সেন ও তার অনুগামীরা বেদান্তের "সামাজিক ভাবনা ও দর্শন" কে বাস্তবে প্র্যাকটিক্যালে প্রয়োগ করতে চান।

বেদান্তের মূল দর্শন বা ফিলোজফি ছিলো প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই পরমাত্মা ঈশ্বর বিরাজ করছেন। এই দার্শনিক ভাবনা অনুযায়ী সাম্য, জগৎ কল্যান ও সমষ্টির মুক্তি ছিলো বেদান্ত ভাবনার মূল সামাজিক আদর্শ।

কেশবচন্দ্র সেন প্রচলিত সমাজের সমস্ত ভাবাবেগ ও সংস্কার কে দূরে সরিয়ে রেখে বেদান্তের এই সামাজিক আদর্শকেই বাস্তবে প্রয়োগ করে তাকে একটি আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান। জাতপাত হন, সামাজিক বঞ্চনা মুক্ত একটি সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে একের পর এক সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে থাকলেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিলো -
  1. স্ত্রী শিক্ষার প্রসার ঘটানো,
  2. নারীদের মধ্যে পর্দাপ্রথার বিলোপ
  3. বিধবা বিবাহের প্রচলন ও প্রচার,
  4. অসবর্ন বিবাহের প্রচলন,
  5. ব্রাহ্মনদের উপনয়নের বিরোধীতা করা ইত্যাদি।

সভাসমিতি ও পত্র পত্রিকার প্রকাশ

কেশবচন্দ্র সেন তার সামাজিক কর্মসূচি গুলিকে বাস্তবায়িত করবার জন্য ব্রাহ্মসমাজের বাইরেও আরো ছোট ছোট সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এইজন্য তিনি -
  • ১৮৬০ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠা করেন "ব্রাহ্মবন্ধু সভা" এবং "সঙ্গত সভা"।
  • এরপর নারী শিক্ষা ও নারী মুক্তি আন্দোলনের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন" বামাবোধিনী সভা"।
  • একই উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে তোলেন ১৮৬৫ খ্রিঃ" ব্রাহ্মিকা সমাজ"।
সভা সমিতি ছাড়াও পত্র পত্রিকার মধ্য দিয়ে কেশবচন্দ্র তার প্রগতিশীল ভাবধারা প্রচারের ব্যবস্থা করেন।
  • এইজন্য তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর্থিক সহায়তায় ১৮৬১ খ্রিঃ প্রকাশ করেন "ইন্ডিয়ান মিরর"পত্রিকা।
  • এছাড়াও "সুলভ সমাচার" নামে আরেকটি স্বল্প মূল্যের পত্রিকা প্রকাশ করেন।
  • সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় মদ্যপানের বাড়াবাড়ি ও কুফল দূর করবার জন্য "মদ না গরল" নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন।

ব্রাহ্ম সমাজের অভ্যন্তরে বিরোধ

ধীরে ধীরে কেশবচন্দ্র সেন ও তার অনুগামীদের হাত ধরে সমাজ সংস্কারের কর্মসূচি যখন রেডিক্যাল হয়ে উঠতে আরম্ভ করলো, তখনই ব্রাহ্ম সমাজের অভ্যন্তরে এক বিরাট অশান্তি ও বিরোধ দেখা যেতে লাগলো।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার অনুগামীরা ব্রাহ্মসমাজকে আধ্যাত্মিক পরিমন্ডলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষপাতী ছিলেন।চরম কোন সংস্কারকের তারা বিরোধী ছিলেন। আসলে মতাদর্শগত দিক থেকে তারা ব্রাহ্ম হলেও, সংস্কারের ঐতিহ্যের জন্য তারা মনের দিক থেকে কখনই নিজেদের হিন্দু ধর্ম থেকে পৃথক বলে ভাবতে পারেন নি। এই কারনে হিন্দু ধর্ম বা প্রথাগত সামাজিক ঐতিহ্যের খুব একটা পরিবর্তন ঘটানোর তারা বিরোধী ছিলেন। এইজন্য কেশবপন্থীরা ব্রাহ্মসমাজে সংস্কৃতের বদলে বাংলায় মন্ত্রোচ্চারনের প্রস্তাব দিলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই প্রস্তাবকে পুরোপুরি বাতিল করে দেন। আর তাদের এই রক্ষনশীল মানসিকতার জন্যই অচিরেই কেশবপন্থীদের সঙ্গে দেবেন্দ্রপন্থীদের বিরোধ দেখা দিলো।

এই বিরোধ ও মতান্তরের কথা বলতে গিয়ে তৎকালীন সময়ে ব্রাহ্মসমাজের কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা প্রয়োজন। কারন এই ঘটনা গুলির সূত্র ধরেই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ ও বিচ্ছেদের চিড় ধরতে আরম্ভ করেছিলো।

(১.) ব্রাহ্ম সমাজে নারীদের অংশ গ্রহণ ও বিতর্ক 

কেশবচন্দ্র সেন একবার তার স্ত্রীকে ব্রাহ্মসমাজের আসরে নিয়ে এলে, তা নিয়ে সমাজে তুমুল হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। কারন সেই সময়ে মেয়েদের প্রকাশ্যে আসাটা সমাজের একেবারেই ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিলো। বাড়ির বউকে বাড়ির বাইরে পুরুষ সদস্য পরিবৃত ব্রাহ্মসমাজে নিয়ে যাওয়ার অপরাধে কেশবচন্দ্রকে পৈত্রিক বাড়ি চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে হয়ে যায়। ব্রাহ্মসমাজের অভ্যন্তরেও ঘটনাটি নিয়ে তুমুল সমালোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়।

কেশবচন্দ্র এর তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, সমাজে স্ত্রীকে নিয়ে এসে তিনি কোন অন্যায় করেন নি। বরং সমাজের অন্যান্যরা যে আচরন করছেন তা বৈদিক ভাবনার বিরোধী। সমাজে পুরুষরা অংশ নিতে পারলে নারীরা কেন পারবেন না? তাদের কি পরমব্রহ্ম সৃষ্টি করেন নি, না তাদের অন্তরে তিনি বিরাজ করেন না? সুতরাং সামাজিক বৈষম্য ও অন্যায় সমাজ  ও বেদান্ত ভাবনার সম্পূর্ণ বিরোধী

তীব্র বাদানুবাদে শেষপর্যন্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যস্থতায় ঠিক হয়, নারীরা সমাজে অংশ নিতে পারে, তবে তারা পুরুষদের সঙ্গে প্রকাশ্যে বসবে না। বসবে পর্দার আড়ালে

(২.) বিবাহ সংক্রান্ত বিরোধ

১৮৬১ খ্রিঃ ব্রাহ্মসমাজে পুনরায় বিরোধ দেখা দিলো। এই সময় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার দ্বিতীয় কন্যা সুকুমারী দেবীর বিবাহ হিন্দুমতে সম্পন্ন করলে, কেশবপন্থীরা ব্রাহ্মসমাজে বিবাহ সংস্কারের প্রস্তাব দেন। কিন্তু কেশবপন্থীদের প্রস্তাব দেবেন্দ্রনাথ শুধু বাতিল করে দিলেন না, তাদের অসবর্ন বিবাহের প্রস্তাবেরও বিরোধীতা করেন।

এই ঘটনায় কেশবপন্থীরা মনে মনে প্রচন্ড রুষ্ট হন। যদিও এই বিষয়টি নিয়ে কোন মতেই তারা পিছু হটবার পক্ষপাতী ছিলেন না। কারন তারা মনে করতেন, হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা ভেঙ্গে ফেলবার একমাত্র শক্তিশালী অস্ত্র হলো অসবর্ন বিবাহ অর্থাৎ এক জাতির সঙ্গে অন্য জাতির বিয়ের প্রচলন করা। 

 এই সময় কেশবপন্থীরা গোপনে একজন ব্রাহ্ম যুবকের অসবর্ন বিবাহ দিয়ে দেন। এরপর ১৮৬৪ খ্রিঃ দেবেন্দ্রনাথকে না জানিয়েই বেশ কিছু অসবর্ন বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই বিবাহের সংবাদ গুলি সম্পূর্ণ ভাবে গোপন রাখা হয়েছিলো।

কিন্তু এগুলি যখন সমাজে প্রকাশ্যে চলে আসে, তখন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার অনুগামীরা প্রচন্ড অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হন। সমাজের ভিতরে তিনি কেশবচন্দ্রের তীব্র সমালোচনা করেন।

মোটকথা, জাতিভেদ প্রথা দূর করার বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচি গুলি নিয়ে দেবেন্দ্রপন্থীদের সঙ্গে কেশবপন্থীদের নানা বিরোধ ও মনোমালিন্য দেখা যেতে থাকে। যত দিন যাচ্ছিলো, দুই শিবিরের আদর্শগত, চিন্তাধারা, নীতিগত, দৃষ্টিভঙ্গিগত, পার্থক্য বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। শেষটায়, দুই গোষ্ঠীর বিরোধ চরমে ওঠে ১৮৬৬ খ্রিঃ, ব্রাহ্মনদের উপবীতধারন বা পইতে ত্যাগ করার বিষয়টিকে নিয়ে। 

দুই শিবিরের চূড়ান্ত বিচ্ছেদ

১৮৬৬ খ্রিঃ ব্রাহ্ম মন্দিরের সংস্কারের কিছু কাজ চলছিলো। তাই এই সময় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতেই ব্রাহ্মসমাজের অধিবেশন গুলির আয়োজন করা হয়। 

এই সময় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উপবীতধারী দুজন ব্রাহ্মনকে ব্রাহ্মসমাজে উপাচার্য নিয়োগ করলে, কেশবচন্দ্র সেন ও তার অনুগামীরা তার তীব্র বিরোধিতা করেন। 

কেশবপন্থীরা যুক্তি দেন, উপবীতধারী কোন ব্রাহ্মন ব্রাহ্মসমাজের উপাচার্য হতে পারেন না। কারন উপবীত বা পৈইতা জাতিভেদ প্রথাকে সমর্থন করে ও মান্যতা দেয়। এটি বেদান্তের সামাজিক ভাবনা ও আদর্শেরও বিরোধী। 

ক্রমে এই বিষয়টি নিয়ে সমাজে তীব্র হৈ চৈ শুরু হয়ে গেলে কেশবপন্থীরা উপবীতধারী দুজন উপাচার্যকে বরখাস্ত করে উপবীতত্যাগী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীঅন্নদাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে ব্রাহ্মসমাজের নতুন উপাচার্য ঘোষনা করেন। 

সমাজে কেশবপন্থীদের এইসব ঔদ্ধত্য দেখে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যারপরনাই অসন্তুষ্ট হলেন। শেষটায় ব্রাহ্মসমাজের প্রধান ট্রাস্টির ক্ষমতাবলে তিনি নতুন নিয়োগ বাতিল করে দিয়ে, উপবীতধারী ব্রাহ্মনদেরই উপাচার্য নিয়োগ করেন। এমনকি ব্রাহ্মসমাজের সমস্ত সাংগঠনিক পদ গুলি থেকে কেশবপন্থীদের অপসারন করে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন। 

এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ ও অপমানিত হয়ে কেশবপন্থীরা কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মসমাজ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ১৮৬৬ খ্রিঃ ১১ নভেম্বর গঠন করেন - "ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ"। এই সমাজের মূল নেতৃত্বে থাকেন কেশবচন্দ্র সেন ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। 

অন্যদিকে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে থাকা অবশিষ্ট ব্রাহ্মসমাজ "আদি ব্রাহ্মসমাজ" নামে পরিচিত হয়।

ভাবতে অবাক লাগে, যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একসময় নিজে উপবীত ত্যাগ করার প্রস্তাব দিয়ে অক্ষয় কুমার গোষ্ঠীর সঙ্গে চরম বিবাদে লিপ্ত হয়েছিলেন, সেই তিনিই শেষপর্যন্ত কেশবপন্থীদের উপবীত ত্যাগের বিষয়টিকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারলেনই না। একেই বোধ হয় বলে ইতিহাসের ট্র্যাজেডি! 

চলবে..... 

চতুর্থ পর্ব - "আদি ব্রাহ্মসমাজ ও ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ" 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post