হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা

 উনিশ শতকের প্রকাশিত পত্রিকা গুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পত্রিকা ছিলো "হিন্দু প্যাট্রিয়ট"। হিন্দু প্যাট্রিয়ট কথাটির অর্থ ছিলো - হিন্দু দেশপ্রেমিকপত্রিকার এই নামকরনটি করেছিলেন গিরিশ চন্দ্র ঘোষ

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা
হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা 

প্রকাশকাল

১৮৫৩ খ্রিঃ ৬ ই জানুয়ারি, কলকাতায় মধুসূদন রায়ের প্রেস থেকে গিরিশ চন্দ্র ঘোষের সম্পাদনায় প্রথম হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে।

পত্রিকার ধরন 

হিন্দু প্যাট্রিয়ট ছিলো একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা। প্রতি বৃহস্পতিবার এই পত্রিকা প্রকাশিত হতো। 

পরে পত্রিকাটি জনপ্রিয়তা লাভ করলে ১৮৯২ খ্রিঃ থেকে এটি দৈনিক পত্রিকায় পরিনত হয়। 

প্রকাশক ও মালিকানা

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার মালিকানা সত্ত্ব ছিলো মধুসূদন রায়ের হাতে। পরে ১৮৫৫ খ্রিঃ ১ লা জুন, তার কাছ থেকে পত্রিকাটির মালিকানা কিনে নেন, হরিশচন্দ্র মুখার্জির দাদা হারানচন্দ্র মুখার্জি। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাটির যাবতীয় খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা হরিশচন্দ্র মুখার্জির হাত ধরেই এসেছিলো।

হরিশচন্দ্র মুখার্জির মৃত্যুর পর পত্রিকাটির মালিকানা কিনে নেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। ১৯২৪ খ্রিঃ পর্যন্ত পত্রিকাটি টিকে ছিলো

সম্পাদক

  1. হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন - গিরিশ চন্দ্র ঘোষ। 
  2.  দ্বিতীয় সম্পাদক ছিলেন - হরিশচন্দ্র মুখার্জি। 
  3. হরিশচন্দ্র মুখার্জির পর হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় কিছুদিনের জন্য সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন - কালীপ্রসন্ন সিংহ

কালীপ্রসন্নের পর আরোও অনেকে এই পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাটির উদ্দেশ্য

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রকাশিত খবর, সংবাদ বিশ্লেষন এবং সাংবাদিকতার দৃষ্টিভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করে, এই পত্রিকার ৫ টি মূল উদ্দেশ্যের কথা তুলে ধরা যায়। এগুলি হল -

  1. ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অনিয়ম ও স্বৈরাচারী দিক গুলিকে তুলে ধরা,
  2. সরকারি শাসন নীতির ক্রুটি বিচ্যুতি গুলি তুলে ধরে তার সমালোচনা করা, 
  3. কৃষকদের ওপর জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের অত্যাচারের স্বরূপ তুলে ধরা,
  4. নারী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ, পুরুষের বহু বিবাহ রদ ইত্যাদি প্রগতিশীল সংস্কারের স্বপক্ষে জনমত গঠন করা, 
  5. জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ও আদর্শ প্রচার করা।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার বৈশিষ্ট্য

  1. হিন্দু প্যাট্রিয়ট ছিলো ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা
  2. এটি জমিদারদের সংগঠন "ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন" এর মুখপত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো।
  3. প্রতি বৃহস্পতিবার এই পত্রিকা প্রকাশিত হতো।
  4. হিন্দু প্যাট্রিয়ট ছিলো ভারতের প্রথম জাতীয়তাবাদী পত্রিকা
  5. হরিশচন্দ্র মুখার্জির সম্পাদনা কালে এই পত্রিকা কৃষকদের ওপর জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের সংবাদ নির্ভিক ভাবে পরিবেশন করতো।
  6. সমকালীন ঘটনাবলীর মূল্যায়নে এই পত্রিকা অন্যান্য পত্র পত্রিকা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছিলো এবং প্রগতিশীল চিন্তা ধারার পরিচয় দিয়েছিলো। 

 ইতিহাসের উপাদান হিসাবে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ?

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। 
  • হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা নির্ভিকতার সাথে সংবাদ পরিবেশন করতো। 
  • সমকালীন ঘটাবলীর মূল্যায়নে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির উর্দ্ধে উঠে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকে বিচার বিশ্লেষণ করতো।
  • হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার এই বিশেষ গুনাবলীর জন্য পত্রিকাটিতে সরবরহ করা তথ্য ইতিহাসের উপাদান হিসাবে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য বলে ঐতিহাসিকরা মনে করে থাকেন। 
  • উনিশ শতকে শিক্ষিত বাঙালি মানসের "ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার" প্রতিফলন একমাত্র হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা থেকেই পাওয়া যায়। ইতিহাসের উপাদান হিসাবে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সবথেকে বড়ো ঐতিহাসিক মূল্য এখানেই।
সংক্ষেপে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও অবদানের প্রধান দিক গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
  1. নীলের মতো অর্থকরী ফসলের চাষ বাংলার গ্রামীন সমাজ ও গ্রামীণ অর্থনীতির ভিতকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলো, তা উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির কাছে প্রথম বলিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরেছিলো হিন্দু প্যাট্রিয়ট।
  2. জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধেও এই পত্রিকা সোচ্চার হয়েছিলো। জমিদারদের অত্যাচারের নানা সংবাদ নির্দ্ধিধায় এই পত্রিকায় হরিশচন্দ্র প্রকাশ করতেন।
  3. হিন্দু প্যাট্রিয়ট ছিলো ভারতের একমাত্র পত্রিকা, যে আদিবাসী সাঁওতালদের বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিলো, এবং সাঁওতাল সমাজে জমিদার, মহাজন ও বাঙালি ব্যবসায়ীদের শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলো।ব্রিটিশ সরকার সাঁওতাল বিদ্রোহ দমনে তীব্র দমননীতি নিলে হিন্দু প্যাট্রিয়ট তার সমালোচনা করে। 
  4. ১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহের প্রতিও হিন্দু প্যাট্রিয়ট ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নেয়। বাংলার মধ্যে একমাত্র হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাই মহাবিদ্রোহকে কিছুটা হলেও সমর্থন করে। মহাবিদ্রোহের প্রতি হিন্দু প্যাট্রিয়টের মূল্যায়ন ছিলো - বর্তমান সময় মহাবিদ্রোহকে যে দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যায়ন করছে, ভবিষ্যত তাকে অন্য নজরে দেখবে ও মূল্যায়ন করবে। এই বিদ্রোহ দমনে সরকারের নিষ্ঠুর দমন নীতিরও হিন্দু প্যাট্রিয়ট নিন্দা করে।
  5. লর্ড ডালহৌসি নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী নীতি নিয়ে একের পর এক রাজ্য গ্রাস করলে, হিন্দু প্যাট্রিয়ট তার তীব্র সমালোচনা করে। "ঝাঁসি অধিকার" শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে হরিশচন্দ্র লেখেন - ডালহৌসি রাজ্য গ্রাসের যে নির্লজ্জ নীতি নিয়েছেন, তা শয়তানের পক্ষেও লজ্জাজনক। 
  6. হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো অত্যন্ত উদার। এই পত্রিকা বিধবা বিবাহ, নারী শিক্ষা, ইত্যাদি প্রগতিশীল সমাজ সংস্কারের স্বপক্ষে এবং পুরুষের বহু বিবাহ, মদ্যপান ইত্যাদি কুপ্রথার বিপক্ষে জনমত গঠন করেছিলো।
এইভাবে দেখা যায়, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি এই ৩ টি মূল ক্ষেত্রেই হিন্দু প্যাট্রিয়ট ভারতবাসীর হিতকর বিষয় গুলির স্বপক্ষে সোচ্চার হয়েছিলো। হিন্দু প্যাট্রিয়ট কখনোই টিকে থাকার স্বার্থে পদলেহন করে নি, বা সরকারি রোষানলের সঙ্গে আপোষ করে নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই পত্রিকা স্বদেশবাসীর স্বার্থ সংরক্ষণে জাতীয়তাবাদী মানসিকতা ও নীতির অবলম্বন করেছিলো। এই কারনে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাকেই ভারতের প্রথম জাতীয়তাবাদী পত্রিকা বলা হয়ে থাকে।

মাথায় রাখতে হবে, হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হতো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই পত্রিকা ইওরোপীয়দের মধ্যে ভারতীয়দের মূল সমস্যা গুলিকে নিয়ে শক্তিশালী আকারে জনমত গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলো। যা অন্যান্য পত্র পত্রিকা গুলি সেভাবে করতে পারে নি। 

সবচেয়ে বড়ো কথা, ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে সংবাদপত্র যে কতটা শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ রেখে গিয়েছিলো "হিন্দু প্যাট্রিয়ট"। তাই উনিশ শতকে ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার শিকড় অন্বেষন করতে হলে, হিন্দু প্যাট্রিয়ট কে কখনই ইতিহাসের উপাদান থেকে বাদ দেওয়া যায় না। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post