সামাজিক ইতিহাস চর্চার একটি অন্যতম দিক হলো - "সামরিক ইতিহাস"।
সামরিক ইতিহাস |
সামরিক ইতিহাসের সংজ্ঞা
(১.) সামরিক সরঞ্জাম, (২.) সামরিক পদ্ধতি বা কৌশল, (৩.) সেনা সংগঠন, (৪.) যুদ্ধ কৌশল ও যুদ্ধ প্রযুক্তি এবং (৫.) যুদ্ধের প্রভাব ও ফলাফল - এই মূল ৫ টি দিক কে নিয়ে আলোচনার ইতিহাসকেই এককথায় "সামরিক ইতিহাস" বলা হয়।
অর্থাৎ সামরিক নানা দিকের পর্যালোচনা করা হলো সামরিক ইতিহাসের মূল আলোচ্য বিষয়।
সামরিক ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই ইওরোপের দেশ গুলিতে সামরিক ইতিহাস চর্চা শুরু হয়।
- এই সময়ের সামরিক ইতিহাস চর্চায় - সমরাস্ত্র, সামরিক পদ্ধতি, সেনা সংগঠন, যুদ্ধ কৌশল ও যুদ্ধ প্রযুক্তির নানা দিকগুলি নিয়ে আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।
নতুন সামরিক ইতিহাস চর্চা
১৯৭০ এর দশক থেকে নতুন সামরিক ইতিহাস চর্চা শুরু হয়। নতুন সামরিক ইতিহাস চর্চায় -
- যুদ্ধ কৌশল অপেক্ষা যুদ্ধের সাইকোলজি বা মনস্তত্ত্ব,
- সেনা প্রধানদের ভূমিকার চাইতে যুদ্ধে সাধারন সৈনিকদের ভূমিকা, এবং
- রাজনৈতিক প্রভাব অপেক্ষা বৃহত্তর সমাজ ও সংস্কৃতিতে যুদ্ধের প্রভাবের দিক গুলি আলোচনায় উঠে আসছে এবং গুরুত্ব লাভ করছে।
সামরিক ইতিহাস চর্চার ঐতিহাসিক
ইওরোপের ঐতিহাসিক
সামরিক ইতিহাস নিয়ে ইওরোপের বহু গবেষক দীর্ঘদিন ধরেই ইতিহাস চর্চা করে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে আছেন -
- কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড জে ইভানস,
- মার্ক ফেরো,
- রিচার্ড কোন,
- জন হোয়াইট ক্লে,
- রজার স্পিলার,
- জন টেরাইন।
ভারতের ঐতিহাসিক
ভারতে সামরিক ইতিহাস নিয়ে প্রথম গবেষণা করেন স্যার যদুনাথ সরকার। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ - "মিলিটারি হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া" থেকেই ভারতে সামরিক ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত হয়।
যদুনাথ সরকারের পর অনেক ভারতীয় ঐতিহাসিক সামরিক ইতিহাস চর্চায় এগিয়ে আসেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন -
- সুরেন্দ্রনাথ সেন,
- কৌশিক রায়,
- নিখিলেশ ভট্টাচার্য,
- সুবোধ ঘোষ,
- উমা প্রসাদ,
- জি এস সরদেশাই।
সামরিক ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব
সামরিক ইতিহাস চর্চার প্রধান গুরুত্বের দিক গুলি হলো -
(১.) সামরিক বিবর্তন সম্পর্কে ধারণালাভ
মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে যুদ্ধ ছিলো। যুদ্ধ আজও আছে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই তাই আছে নিজস্ব সামরিক বাহিনী। সামরিক ইতিহাস চর্চার আলোকে একটি দেশ তার সামরিক সক্ষমতা ও বিবর্তন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে।
(২.) যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধ কৌশলের পরিচয়
সামরিক ইতিহাস চর্চা থেকে যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধ কৌশল ও যুদ্ধ প্রযুক্তির নানা দিকের পরিচয় পাওয়া যায়। যে কোন যুদ্ধের সাফল্যের ক্ষেত্রে এগুলি অপরিহার্য। সামরিক ইতিহাস চর্চা থেকেই তাই কোন একটি যুদ্ধের জয় পরাজয়ের সঠিক কারনের ব্যাখ্যা আমরা পেয়ে থাকি।
(৩.) যুদ্ধের প্রকৃতি অন্বেষন
সামরিক ইতিহাস যুদ্ধের প্রকৃতিকেও বুঝতে সাহায্য করে। যুদ্ধের কারন কি, যুদ্ধের বিভিন্ন প্রকারভেদ, এবং কোন যুদ্ধ সামরিক অভ্যুত্থান আর কোন যুদ্ধ গন অভ্যুত্থান - তার যথাযথ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষন একমাত্র সামরিক ইতিহাস থেকেই উঠে আসে।
(৪.) অতীতের ভুল ক্রুটি অন্বেষন
যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেমন নতুন সমাজের প্রতিষ্ঠা হয়, তেমনই একটি যুদ্ধের পর তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যুদ্ধ কৌশলেও নানা বদল আসে। সামরিক ইতিহাস তাই অতীতের যুদ্ধ কৌশলের নানা ক্রুটি ও ভুল ভ্রান্তির দিক গুলিকে চিনিয়ে দেয়।
(৫.) উন্নত মেধা ও আর্থিক সক্ষমতার দিক
সামরিক ইতিহাস চর্চা থেকে একটি দেশ বা সময়কালের প্রযুক্তি, মেধা ও আর্থিক সক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। কেননা উন্নত সমর প্রযুক্তির হাত ধরেই যুদ্ধে জয় আসে। আর উন্নত সমর প্রযুক্তি অর্জন করা সম্ভব উন্নত মেধা ও আর্থিক সক্ষমতার দ্বারা।
(৬.) যুদ্ধের প্রভাব ও ফলাফল
একটি যুদ্ধ কিভাবে বৃহত্তর জনসমাজে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে তাও সামরিক ইতিহাস চর্চা থেকে জানা যায়।
(৭.) ইতিহাসের নানা কার্যকারন সম্বন্ধ
সামরিক ইতিহাস চর্চা ইতিহাসের নানা কার্যকারন সম্বন্ধ গুলি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে। যেমন -
- এদেশে সেনা সংগঠনে কেন ব্রিটিশ সরকার বাঙালিদের নিয়োগ করতে চাইতো না,
- বাংলাতে কেন সিপাহী বিদ্রোহের কোন প্রভাব পড়ে নি,
- উত্তর ভারতে কেন সিপাহী বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারন করেছিলো, তার যথাযথ ব্যাখ্যা একমাত্র সামরিক ইতিহাস থেকেই জানা যায়।
ফলে সামরিক ইতিহাসের চর্চা মূল ধারার ইতিহাসকেও প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ করে।
(৮.) সংস্কার ও সামরিক রনকৌশল
কোন দেশ বা জাতির ধর্ম ও সংস্কার বোধ কিভাবে সামরিক ক্ষেত্রটিকে প্রভাবিত করে, তাও সামরিক ইতিহাস চর্চার আলোচনাতে উঠে আসে।
সামরিক ইতিহাস চর্চা থেকে জানা যায় -
- ইংরেজরা প্রথম থেকেই এদেশে জাতপাতের ভিত্তিতে সেনা সংগঠন করেছিলো।
- ভারতের ইতিহাসে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুই প্রথম সেনা সংগঠনে জাতপাত কে বর্জন করেন।
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের সমুদ্র পার করে বাধ্যতামূলক ভাবে যুদ্ধে নিয়োগ করা হলে, সেনাদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়। কেননা হিন্দু ধর্মে সমুদ্র যাত্রা শাস্ত্র বিরুদ্ধ বলে ঘোষনা করা হয়েছিলো।
এইভাবেই সামরিক ইতিহাস চর্চা থেকে ইতিহাসের অনেক অজানা দিকের কথা জানা যায়।
সামরিক ইতিহাস সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- ভারতে সামরিক ইতিহাস নিয়ে প্রথম গবেষণা করেন - যদুনাথ সরকার।
- নতুন সামরিক ইতিহাসের সূত্রপাত ঘটে - ১৯৭০ দশকে।
- ১৭৯৫ খ্রিঃ কোলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ইংরেজরা তিনটি পৃথক সেনাবাহিনী গঠন করে।
- ১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহের পর ৩ টি বাহিনীকে একত্রিত করে গঠন করা হয় - "ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি"।
- ১৯৩০ খ্রিঃ "ইন্ডিয়ান নেভি" এবং "ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স" গঠন করা হয়।
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করা সমর সরঞ্জাম - গোলাবারুদ, বিমান, বোমা, বন্দুক, রকেট লঞ্চার, মাইন, সাবমেরিন।
- ভারতের ইতিহাসে প্রথম কামানের ব্যবহার করেন - বাবর।
- স্বাধীনতা লাভের পর ভারত একাধিক যুদ্ধের সম্মুখীন হয়। যেমন -
- কাশ্মীরকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রশ্নে ১৯৪৭ খ্রিঃ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ।
- ১৯৬১ খ্রিঃ গোয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পর্তুগালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
- ১৯৬২ খ্রিঃ চিন ভারত যুদ্ধ।
- ১৯৬৫ খ্রিঃ কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ।
- ১৯৬৭ খ্রিঃ সিকিমকে কেন্দ্র করে ভারত চিন যুদ্ধ।
- ১৯৭১ খ্রিঃ বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ।
- ১৯৮৪ খ্রিঃ সিয়াচেন গ্লেসিয়ারকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ।
- ১৯৯৯ খ্রিঃ কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ।
- এই যুদ্ধ গুলির মধ্যে সব গুলিতেই ভারত জয়ী হয়। একমাত্র ১৯৬২ খ্রিঃ চিন ভারত যুদ্ধে চিনের কাছে ভারত পরাজিত হয়। পাকিস্তান প্রতিবারই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে।
সামরিক ইতিহাস চর্চা সম্পর্কিত গ্রন্থ
- মিলিটারি হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া - যদুনাথ সরকার।
- মিলিটারি সিস্টেম অব দ্য মারাঠাস - সুরেন্দ্রনাথ সেন।
- মিলিটারি কসটিউম অব ইন্ডিয়া - উমা প্রসাদ।
- আ মিলিটারি হিস্ট্রি অব অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়া - জি এস সাঁধু।
- হিস্ট্রি অব মিলিটারি ট্রানজ্যাকশন ইন হিন্দুস্থান - রবার্ট আর্ম।
- ভারতীয় ফৌজের ইতিহাস - সুবোধ ঘোষ।
- দ্য গ্রেট ওয়ার : 1914 - 1918 - মার্ক ফেরো।
- দ্য আর্মি ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া - কৌশিক রায়।
- ওয়ার অ্যান্ড সোসাইটি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া - কৌশিক রায়।
- দ্য আর্মড ফোর্সেস অব ইন্ডিয়া 1947 - 2006 - কৌশিক রায়।
- দ্য কিলিং অব হিস্ট্রি - কিথ উইন্ডস্কাটল।
- ইন ডিফেন্স অব হিস্ট্রি - রিচার্ড জে ইভানস।