সামাজিক ইতিহাস চর্চার একটি অন্যতম দিক হলো - "দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস"।
দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস - প্রথম পর্ব |
দৃশ্য শিল্পের ইতিহাসের সংজ্ঞা
মানুষের হাতে আঁকা ছবি এবং ফটোগ্রাফির ইতিহাসচর্চাকেই সাধারনত "দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস" বলা হয়ে থাকে।
দৃশ্য শিল্পের ঐতিহাসিক
দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস চর্চার উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিকরা হলেন -
- বিনয় কে বেহল,
- ক্রিস্টোফার পিনে,
- পল বারলো,
- ই বি হ্যাভেল,
- এ কে কুমারস্বামী।
দৃশ্য শিল্পের শ্রেনী বিভাগ
দৃশ্য শিল্পকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা -
- চিত্র শিল্প বা হাতে আঁকা ছবি, এবং
- ফটোগ্রাফি।
আজকে আমরা চিত্র শিল্পকে নিয়ে আলোচনা করবো। দৃশ্য শিল্পের দ্বিতীয় পর্বে আমাদের আলোচ্য বিষয় থাকবে ফটোগ্রাফিকে নিয়ে।
চিত্র শিল্প বা আঁকা ছবি
ছবি আঁকা বলতে কি বোঝায়?
মানুষের মনের ভাব বা অভিব্যক্তি তুলি, পেন্সিল ও রঙের আঁচড়ের মধ্য দিয়ে তুলে ধরাকেই বলা হয় ছবি আঁকা।
ছবি আঁকার সঙ্গে ইতিহাস চর্চার সম্পর্ক
মানুষের আঁকা ছবির মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিকরা -
- বিভিন্ন ধরনের অঙ্কনশৈলী ও অঙ্কন রীতিকে বোঝবার চেষ্টা করেন।
- সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া শিল্পির ভাবনা চিন্তাকে জানবার চেষ্টা করেন এবং
- একটি সময় কালে আঁকা ছবি থেকে সেই সময়কালের সমাজ জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন ও মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে জানবার চেষ্টা করেন।
চিত্রশিল্পের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
চিত্রশিল্পের একাধিক ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। যেমন -
(১.) লিপির উদ্ভবের পরিচয়
মানব সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই চিত্রকলার চর্চা হয়ে চলেছে।আদিম মানুষ গুহার দেওয়ালে ছবি আঁকতো। ছবির মধ্য দিয়েই আদিম মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করতো। লিপির উদ্ভবের ক্ষেত্রে তাই ছবি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। উদাহরন হিসাবে মিশরের হায়রোগ্লিফিক লিপি, হরপ্পার চিত্র লিপির কথা বলা যায়।
(২.) আদিম মানুষের জীবন চর্চার পরিচয়
আদিম গুহা চিত্র গুলি থেকে আদিম মানুষের জীবন চর্চার একাধিক দিকের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন -
- গুহা চিত্র গুলিতে যৌথভাবে শিকারের ছবি দেখে আদিম মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের কথা জানতে পারা যায়।
- অনেক চিত্র বিশ্লেষক বলে থাকেন, আদিম মানুষ শিকারের আগে ছবি এঁকে তার পরিকল্পনা বা ইচ্ছার কথা তুলে ধরতো। তারা অতীন্দ্রীয় বা অলৌকিক ধারনায় বিশ্বাস করতো আগে থেকেই ছবিতে পশুকে মেরে ফেললে বাস্তবেও সফল ভাবে তারা ঐ কাজটি করতে সক্ষম হবেন।
- এই অতীন্দ্রীয় বা অলৌকিক চিন্তাধারা থেকেই ঈশ্বর, পাপ, পুন্য ইত্যাদি ধারনার উদ্ভব ঘটে।
চিত্র শিল্পের ইতিহাস চর্চা এইভাবে মানুষের মনস্তত্ত্ব ও চিন্তাধারার পরিবর্তনের নানা স্তর গুলো বুঝতে সাহায্য করে।
(৩.) পোশাক পরিচ্ছদের পরিচয়
সামাজিক ইতিহাস চর্চার একটি অন্যতম ভাগ হল পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস। প্রাচীন কালের পোশাক পরিচ্ছদের বিবর্তন একমাত্র চিত্র শিল্পের মাধ্যমেই বোঝা যায়।
অজন্তা ইলোরার গুহা চিত্র গুলি থেকে সেই সময়ের পোশাক পরিচ্ছদ সম্পর্কে যেমন ধারণা করা যায়, তেমনি পাল ও সেন যুগের চিত্রকলা বা মুঘল যুগের চিত্রকলা গুলি থেকে সেই সময়ের পোশাক পরিচ্ছদ ও সমাজ জীবন সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায়।
(৪.) চিত্র শিল্পে নবজাগরনের প্রতিফলন
মানুষের আঁকা ছবি তার সময়কালকে যে কতখানি প্রভাবিত করতে পারে, তার যথার্থ প্রতিচ্ছবি ইওরোপীয় চিত্র শিল্প থেকে পাওয়া যায়।
ইওরোপে নবজাগরনের সময় চিত্র শিল্পের অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটে। উদাহরন হিসাবে বলা যায় -
- নবজাগরনের মানবতাবাদী দর্শনের প্র্যাকটিক্যাল প্রয়োগে চিত্র শিল্প অভিনবত্ব আসে।
- মধ্যযুগে মানুষের আঁকা ছবি ছবি ধর্মীয় বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু নবজাগরনের মানবতাবাদী দর্শনের ছোঁয়াতে চিত্র শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মানুষ।
- এই সময় ইওরোপের চিত্র শিল্পিরা মানুষের মনের বিভিন্ন অভিব্যক্তিকে যেমন - রাগ, দুঃখ, বিস্ময় ইত্যাদি ছবিতে তুলে ধরেন।
- এই সময় মানব শরীর চিত্র শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট বা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
- লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি মানব শরীরের ভেতরের নানা অংশের ছবি আঁকেন, যা মানুষকে মানব শরীর সম্পর্কে আরোও উৎসাহিত করে তোলে। লিওনার্দোর আঁকা এই সমস্ত ছবি ইওরোপে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রসারে প্রভূত সাহায্য করে।
- মানব শরীর ছাড়াও লিওনার্দোর আঁকা বিভিন্ন ছবি কারিগরি, প্রযুক্তি ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার অগ্রগতি ঘটায়। বর্তমানে প্রচলিত আধুনিক যান ও যন্ত্রাংশ গুলির অধিকাংশেরই ছবি ও নকশা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এঁকে দিয়েছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায়, কি ধরনের মেধার অধিকারী ছিলেন তিনি।
(৫.) সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ছবি
চিত্র শিল্প অনেক ক্ষেত্রে সংস্কৃতিকে জানতে ও বুঝতেও সাহায্য করে। বাংলার পট শিল্পের কথা উদাহরন হিসাবে বলা যায়।
বাংলার পটচিত্র শিল্পীরা পটের ছবি গুলির মাধ্যমে পৌরাণিক নানা আখ্যান গানের সহযোগে তুলে ধরতেন। এটি গ্রামীন সংস্কৃতি ও বিনোদন চর্চার একটি অন্যতম অঙ্গ ছিলো।
(৬.) ঔপনিবেশিক সমাজ সম্পর্কে তথ্য
ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে আগত বেশ কিছু চিত্রকর ভারতের দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে অনেক ছবি এঁকেছিলেন। এগুলি ইতিহাস রচনায় ঐতিহাসিকদের প্রভূত সাহায্য করে থাকে।
ঔপনিবেশিক আমলের এই মন্বন্তর গুলিতে মানুষের অবস্থা কত দুর্বিষহ ও ভয়াবহ হয়ে উঠেছিলো, তার একমাত্র বাস্তব প্রমান ছিলো এই চিত্র শিল্প গুলি।
এগুলি ছাড়াও, আমাদের দেশের চিত্রশিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক সমাজ সম্পর্কে বেশ কিছু ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন। এইসব ব্যঙ্গচিত্র থেকে ঔপনিবেশিক সমাজের ধরন ও প্রকৃতি সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। যেমন -
- পাশ্চাত্য শিক্ষিত বাঙালি সমাজের অন্ধ সাহেবি আদব কায়দা অনুকরন,
- সমাজে মদ্যপানের ব্যপকতা,
- বক ধার্মিকদের শঠতা ও প্রবঞ্চনা,
- সমাজের জাল জোচ্চুরি প্রতারনা ও দ্বিচারিতার নানা চিত্র।
চিত্র শিল্পের এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্যই বর্তমানে চিত্র শিল্প সামাজিক ইতিহাস চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
সবশেষে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, চিত্র শিল্প রচনায় শিল্পী কল্পনার আশ্রয় নিলেও চিত্র শিল্প নির্মানের কাল্পনিক উপাদান শিল্পী তার সমকালীন পারিপার্শ্বিক সমাজ ও পরিবেশ থেকেই সংগ্রহ করেন। এই কারনে যেকোন সময়কালের নান্দনিক ভাবনা, সমাজ ভাবনা ও মনস্তত্ত্বের সঠিক পরিচয় পেতে গেলে ইতিহাস চর্চায় চিত্র শিল্পের গুরুত্বকে কখনোই আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।
ভারতীয় চিত্রশিল্পের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
ভারতের চিত্র শিল্পের ইতিহাস খুবই প্রাচীন।
(১.) প্রাচীন ভারতের চিত্রকলা
ভারতের মধ্য প্রদেশের ভীমবেটকায় আদিম মানুষের গুহা চিত্রের সর্ব প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গেছে।
এগুলি ছাড়াও, অজন্তা ইলোরার গুহা চিত্র গুলিও প্রাচীন কালে ভারতীয় চিত্রকলার উৎকর্ষতার পরিচয় তুলে ধরে।
(২.) মধ্য যুগের চিত্রকলা
মধ্য যুগে মুঘল চিত্রকলা তে পারসিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই সময়ের চিত্রকলা গুলিতে মুঘল দরবারের নানা ছবি সহ, রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী গুলিরও নানা ছবি আঁকা হয়। এ থেকে মুঘল যুগের হিন্দু মুসলিম সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের পরিচয় পাওয়া যায়।
(৩.) আধুনিক যুগের চিত্রকলা
উনিশ শতকের শেষ ভাগে ভারতে আধুনিক চিত্রকলার উদ্ভব ঘটে।
আধুনিক চিত্রকলার ৩ টি ধারা লক্ষ্য করা যায় -
- একটি হলো সাধারন লোকায়ত চিত্র। পটচিত্র ছিলো যার উদাহরন।
- দ্বিতীয় ধারাটি ছিলো পাশ্চাত্য রীতির দ্বারা প্রভাবিত। যেখানে ভারতের পৌরাণিক কাহিনী গুলি ইওরোপীয় চিত্র শৈলীতে আঁকা হয়েছিলো। রাজা রবিবর্মা ছিলেন এই ধারার শ্রেষ্ঠ চিত্র শিল্পী।
- তৃতীয় ধারার চিত্রশিল্পটি সম্পূর্ণ ভাবে ভারতীয় ঐতিহ্যের ওপর গড়ে উঠেছিলো। এই ধারার চিত্র শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়।
চিত্রশিল্পে ঠাকুরবাড়ীর ভূমিকা
ভারতীয় চিত্রকলার বিকাশে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ীর ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে ঠাকুরবাড়ীর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ অবদানের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৬০ বছর বয়সে ছবি আঁকতে শুরু করেন। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে অবশ্য তিনি প্রথাগত কোন ব্যাকরন মানতেন না।
- ঠাকুরবাড়ীর দ্বিতীয় প্রতিনিধি গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ভারতের আল্ট্রামর্ডান আর্টের প্রথম উদ্ভাবক। এছাড়া, তিনিই ছিলেন আমাদের দেশের প্রথম যথার্থ ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী। অ্যাবস্ট্রাক আর্ট বা শিশুদের কল্পিত জগতের ছবির ক্ষেত্রেও তিনি অভিনবত্ব আনেন।
- ঠাকুরবাড়ীর তৃতীয় প্রতিনিধি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইওরোপীয়, জাপানী ও ভারতীয় চিত্ররীতির সংমিশ্রনে ভারতীয় চিত্রশিল্পের একটি স্বতন্ত্র ঘরানা তৈরি করেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - নন্দলাল বসু।
যামিনী রায়ের কথা
ঠাকুরবাড়ী ছাড়াও আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার বিকাশে আরেকজন চিত্র শিল্পী অসামান্য অবদান রাখেন। এই দিকপাল শিল্পী ছিলেন যামিনী রায়। লাল মাটির দেশ বাঁকুড়ার এই চিত্র শিল্পী বাংলার পটচিত্র কে এক অন্য মাত্রা প্রদান করে তাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেন।
গ্রাম্য মানুষের সহজ সরল জীবন কথা ও জীবন দর্শনই ছিলো তাঁর চিত্রকলার মূল বৈশিষ্ট্য।