স্থাপত্যের ইতিহাস

 সামাজিক ইতিহাসের একটি অন্যতম দিক হলো - "স্থাপত্যের  ইতিহাস" চর্চা।

স্থাপত্যের ইতিহাস
স্থাপত্যের ইতিহাস 


স্থাপত্যের ইতিহাসের সংজ্ঞা 

মানুষের সৃষ্টিশীল নির্মান বা স্থাপনা গুলির উদ্ভব, বিবর্তন এবং সেগুলির বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বতন্ত্র ভাবে যে ইতিহাস চর্চা করা হয়, তাকেই সাধারণত "স্থাপত্যের ইতিহাস" বলা হয়।

 স্থাপত্যের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত থাকে ভাস্কর্য। এখন আলোচনার শুরুতেই স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বলতে ঠিক কাকে বোঝায়, সেটি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধরনা করে নেওয়া যাক। 

স্থাপত্যের ধারনা

পরিবেশের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট আকার ও আয়োতনের যে কোন নির্মান বা স্থাপনাই" স্থাপত্য" নামে পরিচিত।

অর্থাৎ স্থাপত্য হলো পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে সাযুর্জ্য রেখে নির্দিষ্ট একটি নকশা অনুযায়ী কোন নির্মান শৈলীর সামগ্রিক রূপ বা কাঠামো বা স্ট্রাকচার। 

স্থাপত্যের কিছু উদাহরণ হলো - বসতবাড়ী, দূর্গ, শহর, প্রাসাদ, রাস্তা, সাঁকো, সেতু, স্মৃতিসৌধ, সমাধি, উপাসনালয় ইত্যাদি।

ভাস্কর্যের ধারনা 

স্থাপত্যের গায়ে খোদাই করে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য যে নকশা আঁকা হয়, তাকেই বলা হয় ভাস্কর্য।

মন্দিরের গায়ে যে পোড়ামাটির নকশা আঁকা থাকে, তা হলো ভাস্কর্যের উদাহরণ

স্থাপত্যের ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত

স্থাপত্য ভাষ্কর্যের ইতিহাস নতুন নয়। বহু দিন ধরেই ঐতিহাসিকরা প্রথাগত ইতিহাস চর্চার মধ্যেই স্থাপত্য ভাষ্কর্যের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করে আসছেন।

তবে বর্তমানে ইতিহাস চর্চার একটি আলাদা শাখা হিসাবে স্থাপত্য ভাষ্কর্যের ইতিহাস গুরুত্ব লাভ করেছে।

যে সমস্ত ঐতিহাসিকদের অবদানের ফলে স্থাপত্য ভাষ্কর্যের ইতিহাসের ধারাটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন -

  • জেমস ফার্গুসন,
  • আলেকজান্ডার কানিংহাম, 
  • পার্সি ব্রাউন,
  • জন মার্শাল, 
  • অমিয় কুমার বন্দোপাধ্যায়,
  • তারাপদ সাঁতরা, 
  • হিতেশরঞ্জন সান্যাল,
  • রতনলাল চক্রবর্তী। 

স্থাপত্যের ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব 

স্থাপত্যের ইতিহাস চর্চার একাধিক গুরুত্বের দিক রয়েছে। যেমন  -


(১.) মানুষের সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডের পরিচয় 

  স্থাপত্য ভাষ্কর্যের ইতিহাস চর্চা থেকে মানুষের সৃষ্টিশীল মননকর্মকান্ডের পরিচয় পাওয়া যায়।

(২.) নান্দনিক ভাবনার পরিচয় 

এই ইতিহাস চর্চা থেকে মানুষের নান্দনিক ভাবনাসৌন্দর্য বোধেরও পরিচয় পাওয়া যায়। কারন মানুষের নান্দনিক ভাবনার প্রতিফলন তার স্থাপত্য ও ভাষ্কর্যে প্রতিফলিত হয়। 


(৩.) স্থাপত্য রীতির বিবর্তনের পরিচয়

স্থাপত্যের ইতিহাস চর্চায় একটি অঞ্চলের বা সময়কালের স্থাপত্য রীতির বিবর্তনের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায়। কারন অঞ্চল ভেদে বা সময় ভেদে স্থাপত্য ভাষ্কর্যে তারতম্য থাকে। এই বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা স্থাপত্য ভাষ্কর্যের অন্যতম একটি  বৈশিষ্ট্য হিসাবে প্রতিভাত হয়। 

(৪.) ধর্ম বিশ্বাসের পরিচয় 

 স্থাপত্যের ইতিহাস চর্চা থেকে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের দিকটি সম্পর্কেও জানা যায়। কারন ধর্মীয় দর্শন ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রতিটি ধর্মেরই আলাদা আলাদা স্থাপনা আছে। হিন্দুদের মন্দির স্থাপত্য শৈলীর যেমন নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, তেমনি মসজিদ, বৌদ্ধ বিহার, চার্চেরও নিজস্ব স্থাপত্য শৈলী আছে। 

ধর্মীয় স্থাপত্যের বিস্তার থেকে একটি ধর্মের বিস্তার এবং গভীরতা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। যেমন প্রাচীন বহু বৌদ্ধ স্তুপ ও বিহারের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকেই ঐতিহাসিকদের পক্ষে বলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, প্রাচীনকালে ভৌগলিক দিক থেকে বৌদ্ধ ধর্মের কতদূর প্রসার ঘটেছিলো। 

আবার বাংলার সাধারণ মানুষদের চালা ঘরের আদলে "চালা মন্দিরের স্থাপত্য" থেকে বাংলার সহজ সরল লৌকিক ধর্ম বিশ্বাসের দিকটিরও পরিচয় পাওয়া যায়।

(৫.) মিশ্র সংস্কৃতির পরিচয় 

স্থাপত্যের ইতিহাস চর্চা থেকে একটি সময়কালের মিশ্র সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। যেসব ক্ষেত্রে বৈদেশিক প্রভাব পড়ে থাকে, স্থাপত্য তার মধ্যে অন্যতম। 

অর্থাৎ স্থাপত্যের ইতিহাস চর্চা থেকে একটি সময়কালের মিশ্র সংস্কৃতি বা বিদেশী সাংস্কৃতিক প্রভাবের দিকটি সম্পর্কে জানা যায়। 

(৬.) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার পরিচয় 

স্থাপত্যের ইতিহাস চর্চায় যেকোন সময়কালের গানিতিক, জ্যামিতিক এবং ভূবিদ্যার অগ্রগতির দিক গুলিরও পরিচয় পাওয়া যায়। এ বিষয়ে প্রাচীন কালের অনেক স্থাপনা আজও আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেগ করে। 

উদাহরন হিসাবে কোনার্কের সূর্য মন্দির, অজন্তা ইলোরার গুহা মন্দির, মিশরের পিরামিডের কথা বলা যায়। 

সবশেষে স্থাপত্যের ইতিহাসের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা যায় -
 স্থাপত্যের ইতিহাস চর্চা থেকে একটি ধর্মের প্রসার কতদূর ঘটেছিলো, একটি শহর বা প্রাচীন সভ্যতার বিস্তার কতদূর হয়েছিলো, তা অনায়াসে বলে দেওয়া যায়। এর সবথেকে বড়ো ঐতিহাসিক মূল্য এখানেই।

স্থাপত্য সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য 

  1. ব্রিটিশ আমলে ভারতে গথিক স্থাপত্যের প্রচলন হয়। 
  2. কলকাতা হাইকোর্ট ছিলো গথিক স্থাপত্যের প্রথম নিদর্শন। 
  3. বাংলার বিশ্বকর্মা বলা হয় - রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি কে। 
  4. ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মন্দির এবং হাওড়া ব্রিজের রূপকার ছিলেন - রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি। 
  5. স্থাপত্যে "রুফিং স্টাইল" দেখা যায় - বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুরের মন্দিরে। 
  6. দক্ষিণেশ্বরের কালিমন্দির নির্মিত হয় - ভঞ্জ স্টাইলে। 
  7. প্রত্যন্ত গ্রামের মন্দির গুলি নির্মিত হয়েছিলো - বাংলো স্টাইলে। 
  8. জিগুরাত বলা হতো - সুমেরীয় সভ্যতার মন্দির গুলিকে।
  9. পিরামিড দেখা যায় - মিশরীয় সভ্যতায়। 
  10. গরিবদের স্থপতি বলা হয় - লরি বেকার কে। 
  11. ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শন গুলি হলো - ভিক্টোরিয়া মিমোরিয়াল, রাইটার্স বিল্ডিং, প্রিন্সেপ ঘাট, শহিদ মিনার। 
  12. স্থাপত্যের ইতিহাস চর্চা করেছেন এমন কিছু ঐতিহাসিক হলেন - 
  • জেমস ফার্গুসন,আলেকজান্ডার কানিংহাম, পার্সি ব্রাউন,জন মার্শাল, অমিয় কুমার বন্দোপাধ্যায়,তারাপদ সাঁতরা, হিতেশরঞ্জন সান্যাল,রতনলাল চক্রবর্তী।

স্থাপত্যের ইতিহাস সম্পর্কিত গ্রন্থ 

  • হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইস্টার্ন আর্কিটেকচার - জেমস ফার্গুসন।
  • ইন্ডিয়ান আর্কিটেকচার - পার্সি ব্রাউন।
  • দ্য মেকিং অব দ্য নিউ ইন্ডিয়ান আর্ট - তপতী গুহ ঠাকুর।
  • ব্রিক টেম্পল অব বেঙ্গল - জর্জ মিশেল। 
  • আর্কিটেকচার অব মুঘল ইন্ডিয়া - ক্যাথরিন অ্যাশার।
  • পশ্চিমবঙ্গের পুরাসম্পদ - অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। 
  
 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post