বাংলার নবজাগরনের প্রকৃতি

 উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে বাংলার সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, শিক্ষা, দর্শন - সর্বত্র এক অভূতপূর্ব জাগরন দেখা যায়। (১.) মানবতাবাদ, (২.) যুক্তিবাদ এবং (৩.) বিজ্ঞান মনস্কতার দ্বারা এইসময় প্রভাবিত হয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র। বাংলার এই অভূতপূর্ব জাগরনকে অনেক ঐতিহাসিক পঞ্চদশ শতকে ইতালির রেনেসাঁর সঙ্গে তুলনা করে একে "বঙ্গীয় নবজাগরন" বলে উল্লেখ করেছেন।

বাংলার নবজাগরনের প্রকৃতি
বাংলার নবজাগরনের প্রকৃতি 

প্রকৃতি নির্নয় ও বিতর্ক

উনিশ শতকে বঙ্গীয় জাগরনের প্রকৃতি নির্নয় করতে গিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রধানত ৩ টি মত উঠে এসেছে। অনেক ঐতিহাসিক উনিশ শতকের বঙ্গীয় জাগরনকে - 

  • ইতালির রেনেসাঁর মতোই একটি "যথার্থ নবজাগরন" বলে উল্লেখ করেছেন। 
  • অনেক ঐতিহাসিক আবার এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে বাংলার নবজাগরনের বেশ কিছু ত্রুটিসীমাবদ্ধতার দিকের উল্লেখ করেছেন। এবং একে যথার্থ অর্থে নবজাগরন বলতে আপত্তি করেছেন। 
  • তৃতীয় ধারার ঐতিহাসিকরা বঙ্গীয় জাগরনকে ইতালির রেনেসাঁর সঙ্গে তুলনা না করে, স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বঙ্গীয় জাগরনের প্রকৃতি বিশ্লেষন করতে চেয়েছেন। 

এখন উনিশ শতকের বঙ্গীয় নবজাগরনের প্রকৃত চরিত্র বা প্রকৃতি বিশ্লেষন করতে গেলে ৩ টি মতের মূল বক্তব্য ও আলোচনা তুলে ধরা প্রয়োজন।

ইতালির রেনেসাঁর সঙ্গে তুলনা 

ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারই প্রথম তার "History of Bengal" গ্রন্থে উনিশ শতকের বঙ্গীয় জাগরনকে পঞ্চদশ শতকে ইতালির রেনেসাঁর সঙ্গে তুলনা করে একে "নবজাগরন" বলে উল্লেখ করেন। পরবর্তীকালে সুশোভন সরকার, ড. অম্লান দত্ত এবং আরোও অনেকে এই মত মেনে নেন।

এদের সবারই যুক্তি ছিলো, পঞ্চদশ শতকে ইতালির রেনেসাঁর ক্ষেত্রে যে যে প্রবনতা ও বৈশিষ্ট্য গুলি দেখা গিয়েছিলো। বঙ্গীয় জাগরনের ক্ষেত্রেও তাই হুবহু দেখা যায়। সুতরাং উনিশ শতকের বাংলার অভূতপূর্ব জাগরনকে ইতালির রেনেসাঁর সঙ্গে তুলনা করে একে "বঙ্গীয় নবজাগরন" বলাই যুক্তিযুক্ত।

এই শ্রেণীর ঐতিহাসিকরা তাদের মতের স্বপক্ষে বলেন -

  1. ইতালির রেনেসাঁ যেমন মধ্যযুগীয় তন্দ্রা থেকে সারা ইওরোপকে মুক্ত করে। তেমনই উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁও মধ্যযুগীয় তন্দ্রা, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে ভারতবর্ষকে মুক্তির সন্ধান দেয়। 
  2. ইতালির রেনেসাঁর যুক্তিবাদী মানসিকতা, স্বাধীন চিন্তাধারার ছাপ বাংলার রেনেসাঁর ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়। বাংলার ইয়ং বেঙ্গলরা ছিলেন যুক্তিবাদী মানসিকতা ও স্বাধীন চিন্তাধারার উজ্জ্বল প্রতিমূর্তি। এছাড়া, উনিশ শতকে সমাজ সংস্কারের আন্দোলনের পুরোটাই পরিচালিত হয়েছিলো যুক্তিবাদী দর্শনের আলোকে।
  3. ইতালির রেনেসাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান ছিলো মানবতাবাদী দর্শন। এই দর্শনের প্রভাবে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার জাগরনে গুরুত্বপূর্ণ স্থানলাভ করে মানুষ। বাংলার রেনেসাঁর ক্ষেত্রেও এটি লক্ষ্য করা যায়। এই সময়ে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কার ভাবনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করেন মানুষ। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ব্রাহ্মসমাজ এই সময় মানবতাবাদী দর্শনের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েই একের পর এক সমাজ সংস্কার গুলি পরিচালিত করেন। স্বামী বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণদেব, ব্রাহ্মসমাজের ধর্মভাবনাতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সমন্বয়বাদ, মানবকল্যান ও জগত কল্যানের আদর্শ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিকরা প্রচলিত ধর্মীয় সাহিত্যের ধারা থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গীয় সাহিত্যকে নবযৌবনে পদার্পণ করান। তাদের সাহিত্য রচনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন মানুষ ও দেশ।
  4. ইতালির রেনেসাঁর মতো বঙ্গীয় নবজাগরনের ক্ষেত্রেও কথ্য ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু হয়। এছাড়া, 
  5. ইতালির নবজাগরনের প্রেরনা ছিলো ল্যাটিন ও গ্রিক সাহিত্য। একই ভাবে বাংলার নবজাগরনের ভিত্তি ছিলো প্রাচীন সংস্কৃত এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য
এখানে মনে রাখতে হবে, ১৪৫৩ খ্রিঃ তুর্কিদের হাতে  কনস্ট্যানটিনোপলের পতনের পর সেখানকার বুদ্ধিজীবীরা প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যগুলো নিয়ে ইতালির বিভিন্ন শহর গুলোতে চলে আসেন। এই সময় স্থানান্তরিত হয়ে আসবার পর সারা মধ্যযুগ ধরে চর্চার অন্তরালে চাপা পড়ে থাকা ল্যাটিন ও গ্রিক ধ্রুপদি সাহিত্য গুলো তাদের নজরে নতুন করে উদ্ভাসিত হয়। তারা এই সময় সেগুলো পড়লেন এবং দেখলেন, ধ্রুপদী সাহিত্যে ধর্মের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ছিলেন মানুষ। 

মানুষের সুখ, দুঃখ, আনন্দ ও নানা অভিব্যক্তি ছিলো প্রাচীন ধ্রুপদী  সাহিত্যের কেন্দ্রীয় বিষয়। এই ভাবে ইতালিয় নবজাগরনের ধ্রুপদী চর্চা থেকে "মানবতাবাদী" ভাবধারার জন্ম হয়। ধীরে ধীরে ধ্রুপদী চর্চা থেকে যুক্তিবাদঅনুসন্ধিৎসার জন্ম হয়। যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ ও অনুসন্ধিৎসা ইওরোপকে "বিজ্ঞান বিপ্লবের" দিকে টেনে নিয়ে যায়। আর বিজ্ঞান বিপ্লব ইওরোপকে পৌঁছে দেয় "আধুনিকতার" দ্বার প্রান্তে।

ইতালির রেনেসাঁর মতো, বাংলার রেনেসাঁর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো সংস্কৃত এবং  ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য। মাথায় রাখতে হবে, ব্রাহ্মসমাজ থেকে সতীদাহ, বিধবাবিবাহ, নারী শিক্ষা - বাংলার সব সংস্কার আন্দোলন গুলির পশ্চাৎপটের যুক্তি প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের চর্চা থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। ইংরেজি ভাষা ও দর্শন বাংলায় এনেছিল যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের ধারনা। সেই ধারনার প্রভাবে শুরু হয়েছিলো সংস্কার আন্দোলন। আর সংস্কার আন্দোলনের প্রয়োজনীয় যুক্তির অনুসন্ধানে বঙ্গীয় সংস্কারকরা ডুব দিয়েছিলেন ভারতের ধ্রুপদী সাহিত্য চর্চায়

 এর ফলে উনিশ শতকে বেদ নিয়ে নতুন করে চর্চার সূত্রপাত হয়। প্রথমে রাজা রামমোহন রায় বেদান্ত চর্চা করে ব্রাহ্মসমাজের জন্ম দেন। পরে স্বামী বিবেকানন্দ নতুন করে বেদান্তের চর্চা করে নববেদান্তের জন্ম দেন। বিদ্যাসাগর প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য থেকে প্রমান তুলে এনে দেখান, বিধবা বিবাহ এবং নারী শিক্ষা শাস্ত্র সম্মত। সতীদাহ প্রথা যে শাস্ত্র বিরুদ্ধ একটি সামাজিক কুসংস্কার তা প্রমান করতেও রামমোহন প্রাচীন ধ্রুপদী শাস্ত্রের শরনাপন্ন হন।

মোটকথা, প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্য ও শাস্ত্রের চর্চা থেকে যেমন ইতালির নবজাগরন বিকশিত হয়েছিলো। তেমনই বাংলাতেও ধ্রুপদী সাহিত্য চর্চা থেকেই রেনেসাঁ পরিচালিত ও বিকশিত হয়েছিলো। ইতালির রেনেসাঁর সঙ্গে বাংলার রেনেসাঁর এইসব সাদৃশ্যপূর্ন দিক গুলির উপস্থিতির জন্য উনিশ শতকের বঙ্গীয় জাগরনকে "নবজাগরন" বলাই যুক্তিসঙ্গত। 

রেনেসাঁ মতের বিরুদ্ধ যুক্তি

ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী, বিনয় ঘোষ, অধ্যাপক সুমিত সরকার, অশোক মিত্র প্রমুখ ঐতিহাসিকরা উনিশ শতকের বঙ্গীয় জাগরনের উপরোক্ত মতের প্রবলভাবে বিরোধিতা করেছেন। তাদের মতে, পঞ্চদশ  শতকের ইতালীয় নবজাগরনের সঙ্গে বঙ্গীয় নবজাগরনের তুলনা করাটাই অর্থহীন। 

কারন দুটি নবজাগরনের বিকাশের চরিত্রগত পার্থক্য ছিলো অনেক। যেমন - 
  1. ইতালির নবজাগরন ঘটেছিলো স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশে। কিন্তু বাংলার নবজাগরন ঘটেছিলো ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে - কলকাতায়।
  2. ইতালির নবজাগরনের মতো বাংলার নবজাগরনের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে নি। এটি অনেকাংশে ছিলো আরোপিত।
  3. বঙ্গীয় নবজাগরনের পথিকৃৎদের বেশিরভাগ ছিলেন জমিদার বা সরকারি কর্মচারী। 
  4. ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কার ব্যতিত শিল্প, সাহিত্য কর্মের কোন উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ তারা নিতে পারেন নি। ইতালির নবজাগরনের মতো আলোড়নও সৃষ্টি করতে পারেন নি। 
  5. ইতালির ফ্লোরেন্সের মতো কলকাতা শিল্পের শহর ছিলো না। এটি ছিলো বানিজ্য নগরী। 
  6. ইতালির নবজাগরনের প্রেরনা ছিলো গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য। কিন্তু বঙ্গীয় নবজাগরনের মূল প্রেরনা আসে ইংরেজি সাহিত্য থেকে। 

বঙ্গীয় নবজাগরনের সীমাবদ্ধতা 

বস্তুতপক্ষে উপরোক্ত পার্থক্য ছাড়াও, উনিশ শতকের বঙ্গীয় নবজাগরনের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিলো। যেমন - 
  1. বঙ্গীয় নবজাগরনের সঙ্গে শ্রমিক, কৃষক বা গ্রামীন মানুষের কোন সম্পর্ক ছিলো না। 
  2. মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেনীর ভিতরেই নবজাগরন চলেছিলো এবং বিকশিত হয়েছিলো। 
  3. নবজাগরন ছিলো মূলত কলকাতা কেন্দ্রীক
  4. মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে এর কোন যোগ ছিলো না। 
  5. নবজাগরন বলতে যেটুকু বোঝায় তা ঔপনিবেশিক শক্তির সহযোগিতাতেই বিকশিত হয়েছিলো এবং সম্পন্ন হয়েছিলো। নবজাগরনের পুরহিতরা ব্রিটিশ জাতি, সংস্কৃতি ও শাসনের প্রতি পূর্ন আস্থা রেখেছিলেন। 
  6. সর্বোপরি, উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরনের মধ্যে মৌলিকত্বেরও যথেষ্ট অভাব ছিলো। 
অধ্যাপক সুমিত সরকার তাই বঙ্গীয় নবজাগরনকে "নকল নবিশি" বলে উল্লেখ করেছেন। বিনয় ঘোষ একে "অতিকথা" এবং অশোক মিত্র একে "তথাকথিত নবজাগরন" বলে অভিহিত করেছেন। 

আধুনিক ঐতিহাসিকদের মত

আধুনিক যুগের ঐতিহাসিকরা উনিশ শতকের বঙ্গীয় জাগরনকে ইতালির নবজাগরনের সঙ্গে তুলনা না করে, একে স্বতন্ত্র ভাবে বিচার করার পক্ষপাতি। এঁদের মতে, উনিশ শতকের বঙ্গীয় জাগরনের ৩ টি মূল ধারা ছিলো। যথা - 

(১.) পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক ভাবধারা 

পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক ভাবধারার প্রভাবে উনিশ শতকে বাংলায় সামাজিক, ধর্মীয় ও নারী মুক্তি আন্দোলন বিকশিত হয়। 

(২.) পুনরুজ্জীবনবাদী ভাবধারা 

 পুনরুজ্জীবনবাদী ভাবধার প্রাচ্যের সুপ্রাচীন গৌরবময় ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে চেয়েছিলো। এই ধারার নেতৃত্বে ছিলেন, রাজা রাধাকান্ত দেব, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখ ব্যক্তি। 

(৩.) সমন্বয়বাদী ভাবধারা 

সমন্বয়বাদী ভাবধারা প্রাচীন প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে পশ্চিমা দুনিয়ার জ্ঞান বিজ্ঞান ও শ্রেষ্ঠত্বের দিকগুলির সমন্বয়ের কথা বলেছিলো। এই ধারার নেতৃত্বে ছিলেন - রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্গীমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরোও অনেকে। 

মূল্যায়ন 

সুতরাং উনিশ শতকের বঙ্গীয় নবজাগরনের প্রকৃতি নির্নয়ে
 সিদ্ধান্তে বলা যায় - 
  1. উনিশ শতকে বঙ্গীয় নবজাগরন আক্ষরিক অর্থে ব্যাপ্তি, বিকাশ ও ব্যপকতার বিচারে ইতালিয় নবজাগরনের মতো ছিলো না। 
  2. এই নবজাগরনের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিলো। তাই একে সীমিত নবজাগরন বা তথাকথিত নবজাগরন না বলে শুধুমাত্র - "উনিশ শতকের বঙ্গীয় জাগরন" বলাই যুক্তিসঙ্গত।
  3. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবধারার সংমিশ্রন ছিলো উনিশ শতকের এই বঙ্গীয় জাগরনের মূল ভিত্তি বা চালিকা শক্তি। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post