সঙ্গীতের ইতিহাস চর্চা

 শিল্পচর্চার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাগ বা শাখা হল "সঙ্গীতের ইতিহাস চর্চা"

সঙ্গীতের ইতিহাসচর্চা
সঙ্গীতের ইতিহাসচর্চা 


সঙ্গীতের সংজ্ঞা ও ধারনা 

অর্থযুক্ত কথা - সুর, ছন্দ ও তালের সহযোগে প্রকাশের ধরনকেই সাধারনত "সঙ্গীত" বলা হয়ে থাকে।

সঙ্গীতের ইতিহাসচর্চায় যুক্ত ঐতিহাসিক 

প্রথাগত ঐতিহাসিকরা ছাড়াও, অনেক সঙ্গীত শিল্পীও সঙ্গীতের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস রচনায় যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন -

  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।গ্রন্থ - "সঙ্গীত চিন্তা"।
  • মান্না দে। গ্রন্থ - "জীবনের জলসাঘরে"।
  • করুনাময় গোস্বামী। গ্রন্থ - "বাংলা গানের বিবর্তন" । 
  • রাজকুমার। গ্রন্থ - "এসেজ অন ইন্ডিয়ান মিউজিক" ।
  • সুকুমার রায়। গ্রন্থ - "বাংলা সংগীতের রূপ" ।
  • সুধীর চক্রবর্তী। গ্রন্থ - "বাংলা গানের সন্ধানে" ।
  • রাজেশ্বর মিত্র। গ্রন্থ - "সংগীত মূল্যায়ন"।

সঙ্গীতের ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব

সামাজিক ইতিহাস চর্চায় সঙ্গীতের ইতিহাসের একাধিক গুরুত্বের দিক রয়েছে - 
  1. সঙ্গীতের ইতিহাস চর্চায় উঠে আসে সঙ্গীত চর্চার ধারাবাহিক বিবর্তনের ইতিহাস। 
  2. এছাড়া, সঙ্গীত চর্চা থেকে সমকালীন সময়ের প্রভাবশালী সামাজিক ঘটনা ও বৈশিষ্ট্য গুলির একটি আভাস পাওয়া যায়। কারন প্রভাবশালী সামাজিক অনুভূতি গুলি গানের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। উদাহরন হিসাবে বলা যায় - 
    • লালন ফকিরের গান গুলি থেকে তৎকালীন সমাজে হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক, সামাজিক বৈষম্য, জাতি ভেদ, ইত্যাদি দিক গুলি সম্পর্কে সামাজিক অনুভূতির দিক গুলির পরিচয় পাওয়া যায়।
    • আবার নিধিবাবুর টপ্পা গান থেকে কলকাতার বাবু কালচার ও ধনী ব্যক্তিদের সামাজিক জীবন যাপন সম্পর্কে অনেক তথ্যের আভাস মেলে। 
    • একইরকম ভাবে ১৯৯০ এর দশকের পর বাংলার জীবনমুখী গান গুলি থেকে মানুষের অস্থির জীবনধারা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়, আশা ভঙ্গ, ইত্যাদির প্রতি সামাজিক অনুভূতির পরিচয় পাওয়া যায়।

সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক 

সঙ্গীত মানসিক অনুভূতির প্রকাশ মাধ্যম। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদও একটি ভাবগত ধারনা ও মানসিক অনুভূতির বিষয়। তাই সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। 
  • এই গভীর সম্পর্কের জন্যই প্রতিটি দেশেই জাতীয়বোধের সঞ্চারনে সঙ্গীতকে ব্যবহার করা হয়, এবং প্রতিটি দেশেই রয়েছে তার নিজস্ব জাতীয় সঙ্গীত। 
  • পরাধীন ভারতে দেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদের জাগরনে সঙ্গীত এক বিরাট ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলো। এ প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের "বন্দেমাতারম" গান, মুকুন্দরামের "ভয় কি মরনে" , রজনীকান্ত সেনের "মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়" , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "বাংলার মাটি বাংলার জল" , "ও আমার দেশের মাটি" , "আমার সোনার বাংলা" ইত্যাদি গান গুলির কথা বলা যায়। এই গান গুলি পরাধীন ভারতে প্রবল জাতীয়তাবাদের সঞ্চার করে। 

ভারতীয় সঙ্গীতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস 

ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। ঐতিহাসিকরা মনে করেন ভারতীয় সঙ্গীতের জন্ম হয়েছিলো সামবেদ থেকে। সামবেদে বৈদিক মন্ত্র গুলি বিভিন্ন ছন্দ ও সুরের সাথে পাঠ করা হতো। এখান থেকেই সঙ্গীতের আদি ধারনার উৎপত্তি হয়েছিলো।

ভারতীয় সঙ্গীতের শ্রেনী বিভাগ

ভারতীয় সঙ্গীতকে ৩ টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা - 
  1. শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, 
  2. লোক সঙ্গীত, এবং 
  3. অন্যান্য ধারার সঙ্গীত।

(১.) শাস্ত্রীয় সঙ্গীত 

ভারতের মূল ধারার সঙ্গীত ছিলো শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। একে মার্গ সঙ্গীতও বলা হয়ে থাকে। 
  • শাস্ত্রীয় সংগীতের গায়কির ভিন্ন ভিন্ন ধারা দেখা যায়। এই ভিন্ন ভিন্ন ধারা "ঘরানা" নামে পরিচিত।
  • ভারতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দুটি মূল ঘরানা আছে - একটি উত্তর ভারতীয় গায়কি ঘরানা, অন্যটি দক্ষিণ ভারতীয় কার্নাটকি ঘরানা। 
  • বাংলার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একমাত্র ঘরানা ছিলো বিষ্ণুপুর ঘরানা। 

(২.) লোক সঙ্গীত

শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ছাড়াও ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত ঘরানা ছিলো লোক সঙ্গীত। লোক সঙ্গীত গুলি দীর্ঘদিন ধরেই লোক মুখে প্রচারিত হয় এবং এগুলির প্রকৃত স্রষ্টা বা রচয়িতার নাম জানা যায় না। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নিজস্ব লোক সঙ্গীত আছে। 

(৩.) অন্যান্য ধারার সঙ্গীত

শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও লোক সঙ্গীত ছাড়াও, ভারতে তারানা, ঠুংরি, টপ্পা, গজল, ভজন, ইত্যাদি শ্রেনীর গান বহুদিন ধরেই প্রচলিত আছে। 
  • টপ্পা ছিলো পাঞ্জাবের উট চালকদের গান। এর প্রবর্তক ছিলেন - গোলাম নবি। 
  • ঠুংরি গানের প্রবর্তক ছিলেন - গোলাম আলি খাঁ। 
  • গজল ছিলো - আরবে রাজার স্তুতিমূলক গান। 

বাংলার গানের ইতিহাস 

বাংলার সঙ্গীতের ইতিহাসকে দু ভাগে ভাগ করে তুলে ধরা যায়। যথা - 
  1. গ্রাম বাংলার সঙ্গীত, 
  2. শহরের গান

(১.) গ্রাম বাংলার গান 

গ্রাম বাংলায় দীর্ঘদিন ধরেই নানা লোকগান, বাউল গান, টুসু গান, ঝুমুর গান প্রচলিত ছিলো। এছাড়া কীর্তন তো ছিলোই। 

(২.) কলকাতা শহরের গান

ঔপনিবেশিক আমলে কলকাতা শহরের পত্তন হলে শহরের নিজস্ব গান ও সংস্কৃতি গড়ে উঠতে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো - 

(ক.) নিধিবাবুর গান 

উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রভাবে রামনিধি গুপ্ত সর্বসাধারনের উদ্দেশ্যে বৈঠকী গানের রচনা করেন। 

(খ.) বাঈ গান 

কলকাতায় বাবু কালচার গড়ে উঠলে বাঈ গানের কদর বাড়ে। সাধারনত বাঈজীরা বিনোদনের উদ্দেশ্যে এই গান গাইতো বলে একে বাঈ গান বলা হতো। 

বাংলা আধুনিক গানের উদ্ভব

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে বাংলা আধুনিক গানের উদ্ভব ঘটতে থাকে। এই সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্রগীতিনজরুলগীতি বাংলা গানের জগতে বিপ্লবের সূচনা করে। বাংলায় কাজি নজরুল ইসলামই প্রথম গজল গানের সূচনা করেন। 

রবীন্দ্র যুগের পরে বাংলা আধুনিক গানের জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ছায়াছবি বা চলচ্চিত্রের গান। প্রথম দিকে ছায়াছবি বা চলচ্চিত্রের অভিনেতাদের যোগ্যতা বিচারের অন্যতম মাপকাঠি ছিলো তার গাইতে পারেন কিনা। 

সঙ্গীতের ইতিহাস সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য 

  1. ভারতীয় সঙ্গীতের আদি উৎস হলো - সামবেদ। 
  2. পাঞ্জাবের উট চালকদের গানকে বলা হতো - টপ্পা। 
  3. টপ্পা গানের প্রবর্তক ছিলেন - লখনৌর গোলাম নবি। 
  4. ঠুংরি গানের প্রবর্তক ছিলেন - বড়ে গোলাম আলি খা 
  5. আরবে রাজার স্তুতিমূলক গানকে বলা হতো - গজল। 
  6. বাংলায় প্রথম গজল ঘরানার সঙ্গীতের প্রবর্তন করেন - কাজি নজরুল ইসলাম। 
  7. ভারতের মূল ধারার সঙ্গীত ছিলো - শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। 
  8. শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গায়কির ভিন্ন ভিন্ন ধারাকে বলে - ঘরানা। 
  9. দুটি জাতীয়তাবাদী সঙ্গীত হলো - বন্দেমাতারম, মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়, ও আমার দেশের মাটি, ভয় কি মরনে। 
  10. ভারতের দুটি সঙ্গীত ধারা হলো - শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, তারানা, ঠুংরি, টপ্পা, গজল, লোকসঙ্গীত। 
  11. বাংলার দুটি সঙ্গীত ধারা হলো - বাউল গান, টুসু গান, ঝুমুর গান, লোকগান, কীর্তন, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, দ্বিজেন্দ্রগীতি। 
  12. বাংলার একজন বিখ্যাত বাউল শিল্পী ছিলেন - লালন ফকির। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post