আধুনিক ইতিহাস চর্চার একটি অন্যতম দিক হলো "শিল্পচর্চার ইতিহাস" ।
শিল্পচর্চার ইতিহাস |
শিল্প চর্চার ইতিহাসের সংজ্ঞা
সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক এবং চলচ্চিত্রের ইতিহাস চর্চাকেই এককথায় "শিল্পচর্চার ইতিহাস" বলা হয়।
সামাজিক ইতিহাস চর্চারই একটি অন্যতম দিক হলো এই শিল্পচর্চার ইতিহাস।
শিল্পচর্চার ইতিহাস রচনা ও ইতিহাস চর্চা
শিল্পকলার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকদের পাশাপাশি শিল্প চর্চার বিভিন্ন ধারা গুলির সঙ্গে যুক্ত প্রথিতযশা গুনী ব্যক্তিরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকেন।
- শিল্পকলার ইতিহাস চর্চার জন্য ২০০৫ খ্রিঃ ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠিত হয় - "আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানটিজ রিসার্চ কাউন্সিল"।
- এছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোশ্যাল হিস্ট্রি সোসাইটিও শিল্পকলার ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। এই সংস্থা থেকে প্রকাশিত - "কালচারাল অ্যান্ড সোশ্যাল হিস্ট্রি" জার্নালে নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে শিল্প চর্চার ইতিহাস সম্পর্কিত নানা গবেষণা মূলক প্রবন্ধ।
এইসব প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ছাড়াও, ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে শিল্প চর্চার ইতিহাস চর্চা করছেন।
এদের মধ্যে আছেন -
- জার্মলিন ধামিজা,
- মধুখান্না,
- নিকোলাস পাভনার,
- ভিনসেন্ট ক্রোনিন,
- এইচ্ জিম,
- সিমন খামা,
- জ্যোতিন্দ্র জৌন,
- তপতি গুহঠাকুরতা,
শিল্প চর্চার ইতিহাসের গুরুত্ব
শিল্প চর্চার ইতিহাস আমাদের ৩ টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে -
- মনস্তত্ত্ব,
- সংস্কৃতি এবং
- সমাজ ভাবনা।
(১.) মনস্তত্ত্ব
শিল্প চর্চা হলো মানুষের নান্দনিকতা ও সৃষ্টিশীল অনুভূতির প্রকাশ মাধ্যম। ফলে শিল্প চর্চার ইতিহাস থেকে যে কোন সময়কালের নান্দনিকতা,সৃষ্টিশীলতা ও মনস্তাত্ত্বিক দিকটি সম্পর্কে বোঝা যায়।
(২.) সংস্কৃতি
সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে একটি দেশের সাংস্কৃতিক সত্তা প্রকাশিত হয়। শিল্প চর্চার ইতিহাস থেকে তাই একটি জাতীর সাংস্কৃতিক বিবর্তন ও বৈচিত্র্যের দিক গুলি সম্পর্কে জানা যায়।
(৩.) সামাজিক ভাবনা
সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক এবং চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে মানুষের অনুভূতির প্রকাশ ঘটে থাকে। এগুলি থেকে তাই ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত মানুষের জীবনচর্চা ও জীবন ধারার দিক গুলির পরিচয় পাওয়া যায়। এককথায় শিল্প চর্চায় তৎকালীন সমাজ ভাবনা ও অতীতের ইতিহাস প্রতিফলিত হয়।
উদাহরন হিসাবে, আদিবাসী সমাজের নৃত্য শৈলীর কথা বলা যায়।
আদিবাসী সমাজে কোন একক নৃত্য নেই। তারা একসঙ্গে জোটবদ্ধ অবস্থায় সমবেত হয়ে নাচ করেন। তাদের এই নৃত্যশৈলী থেকে আদিবাসী সমাজের জোটবদ্ধ ও গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের কথা জানা যায়।
আবার লালন ফকিরের বিভিন্ন গান থেকে তৎকালীন বাংলার জাতপাত নিয়ে সমাজের বিভিন্ন ছুৎমার্গের কথা জানা যায়। লালনের - "সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে" গানটির কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়। এই ভাবেই শিল্প চর্চার ইতিহাস থেকে সামাজিক ইতিহাস রচনার বিভিন্ন উপাদান পাওয়া যায়।
এই তিনটি মূল দিক ছাড়াও শিল্প চর্চার ইতিহাস থেকে আরোও কয়েকটি দিকের কথা জানা যায়। যেমন -
- শিল্পচর্চার অনুশীলন ও উপভোগ হলো মানুষের বিনোদনেরই একটি অঙ্গ। শিল্প চর্চার ইতিহাস থেকে তাই মানুষের বিনোদন চর্চার বিস্তৃত দিকের পরিচয় পাওয়া যায়।
- ভারতের শিল্প চর্চার ইতিহাস থেকে জানা যায় ,ভারতে শিল্পচর্চার প্রতিটি ধারার সঙ্গেই ধর্মের একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিলো।এইচ জিম তার বিখ্যাত - "Myths and symbols in Indian art and civilization" গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ভারতের শিল্পচর্চার সঙ্গে ধর্মের একটি গভীর সম্পর্ক ছিলো।
- এছাড়া, শিল্পচর্চার ইতিহাস থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নাটক, নৃত্য, সংগীত ও সিনেমার তুলনামূলক ইতিহাস ও বিবর্তনের নানা দিক গুলিরও পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে মানুষের সাংস্কৃতিক ধারার পরিবর্তন গুলি শিল্প চর্চার ইতিহাস থেকে খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায়।
শিল্প চর্চার ইতিহাসের বিভিন্ন দিক
শিল্প চর্চার ইতিহাসের ৪ টি দিক রয়েছে। যথা -
- সঙ্গীত,
- নৃত্য,
- নাটক, এবং
- চলচ্চিত্র।
শিল্পচর্চার ইতিহাসে এই ৪ টি দিকের উদ্ভব ও বিবর্তনের দিক গুলি নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে ইতিহাসচর্চা করা হয়ে থাকে।
উদাহরন হিসাবে বলা যায় -
- চলচ্চিত্রের ইতিহাস চর্চা থেকে আমরা জানতে পারি কিভাবে ভারতে নির্বাক থেকে সবাক চলচ্চিত্রের বিকাশ ঘটেছিলো। এছাড়া সময়ের হাত ধরে চলচ্চিত্র নির্মানের বিভিন্ন ধারা, প্রযুক্তির ব্যবহার, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নানা দিকের কথাও জানা যায়।
- একই রকম ভাবে নাটকের ইতিহাস চর্চা থেকে নাটকের উদ্ভব, ভারতীয় নাটকের ওপর গ্রিসের প্রভাব, ঔপনিবেশিক আমলে জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে নাটকের ভূমিকা, ইত্যাদি নানা দিকের কথা জানা যায়।
- সঙ্গীতের ইতিহাস চর্চায় উঠে আসে ভারতীয় সঙ্গীত চর্চার সামগ্রিক বিবর্তনের ইতিহাস, অথবা নির্দিষ্ট কোন একটি সময়কালের সঙ্গীত চর্চার ইতিহাস।
- নৃত্যের ইতিহাস চর্চায় ভারতীয় নৃত্যকলার উদ্ভব, বিবর্তন, প্রাচ্যের নৃত্য শৈলীর সঙ্গে ভারতীয় নৃত্য শৈলীর পার্থক্য, ইত্যাদি নানা দিকের পরিচয় পাওয়া যায়।
শিল্পচর্চা ও জাতীয়তাবাদ
"জাতীয়তাবাদ" হলো একটি অনুভূতিপ্রবন বিষয়। আর শিল্প সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে মানুষের মনের অনুভূতির প্রকাশ ঘটে থাকে। যেকোন দেশের জাতীয়তাবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে তাই শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে।
- পরাধীন ভারতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা "বন্দেমাতারম" গান ভারতীয়দের মধ্যে প্রবলভাবে জাতীয়তাবাদের সঞ্চার করে।
- বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুকুন্দরামের লেখা একাধিক গান জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটায় এবং স্বদেশী আন্দোলনকে প্রবল করে তোলে।
- জাতীয়তাবোধের বিকাশে সঙ্গীতের অসামান্য অবদান ও ভূমিকার কারনে পৃথিবীর প্রতিটি দেশের কাছেই আছে তাদের নিজস্ব জাতীয় সঙ্গীত। জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেমকে সচল রাখার জন্য স্কুল, কলেজ সহ, রাজনৈতিক মিটিং, সমাবেশ, আন্তর্জাতিক ক্রীড়ানুষ্ঠান সর্বত্রই এই জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়।
- গানের মতো নাটকও জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটায়। ঔপনিবেশিক আমলে রচিত দীনবন্ধু মিত্র, গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, প্রমুখ নাট্যকারদের রচিত বিভিন্ন নাটক ভারতে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার বিকাশ ঘটায়।ঔপনিবেশিক আমলে এই কারনে নাটকের ওপর কন্ঠরোধ করবার জন্য ১৮৭৬ খ্রিঃ বড়োলাট লর্ড নর্থব্রুক "নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রন আইন" জারি করেন।
- জাতীয়তাবোধের বিকাশে চলচ্চিত্রের অবদানও কম নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের পর ভারত পাক যুদ্ধকে নিয়ে ভারতে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ভারতের পরাধীনতা ও জাতীয় আন্দোলনের ওপরেও বিভিন্ন চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এইসব চলচ্চিত্র গুলি আধুনিক কালে আমাদের জাতীয়তাবোধের বিকাশে সাহায্য করে থাকে।
শিল্প চর্চার ইতিহাস সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- দুটি জাতীয়তাবাদী গান হলো - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা, "বন্দেমাতারম", মুকুন্দরামের "ভয় কি মরনে", রজনীকান্ত সেনের, "মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়",
- সঙ্গীত চিন্তা গ্রন্থটি রচনা করেন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
- ভারতের দুটি ধ্রুপদী নৃত্যের নাম হল - ভরতনাট্যম, কথ্থক, কথাকলি, মোহিনীঅট্টম,
- ভারতের উল্লেখযোগ্য ধ্রুপদী নৃত্য শিল্পী হলেন - উদয়শঙ্কর, অমলাশঙ্কর, পন্ডীত বিরজু মহারাজ, শম্ভু মহারাজ, কেলুচরন মহাপাত্র, রুক্নিনী দেবী,
- পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি লোকনৃত্য হলো - ছৌ নাচ (পুরুলিয়া), রাবনকাটা নাচ ( বিষ্ণুপুর), ঝুমুর নাচ, রনপা নাচ,
- নাটকের প্রথম উৎপত্তি ঘটেছিলো - গ্রিসে,
- বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস গ্রন্থের লেখক - ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,
- নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রন আইন জারি করেন - ১৮৭৬ খ্রিঃ, বড়োলাট লর্ড নর্থব্রুক,
- জাতীয়তাবাদের সঞ্চার করেছিলো এমন দুটি নাটক হল - সুরেন্দ্র বিনোদিনী, গজদানন্দ ও যুবরাজ, সরোজিনী, অশ্রুমতী, নীলদর্পন,
- উনিশ শতকের কয়েকজন বাংলা নাট্যকার ছিলেন - দীনবন্ধু মিত্র, মধুসূদন দত্ত, গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
- চলচ্চিত্রের জনক বলা হয় - অগাস্ট লুমিয়ের এবং লুই লুমিয়ের কে,
- ১৮৯৫ খ্রিঃ চলচ্চিত্রের জন্ম হয় - প্যারিসে (ফ্রান্স),
- ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক ছিলেন - হীরালাল সেন,
- ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র ছিলো - দাদাসাহেব ফালকে নির্মিত "রাজা হরিশচন্দ্র" (১৯১৩),
- প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রের নাম হলো - "বিল্বমঙ্গল" (নির্বাক চলচ্চিত্র - ১৯১৯)
- প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ছিলো - জামাইষষ্ঠী, দেনা পাওনা,
- চলচ্চিত্রের জন্য সর্বোচ্চ যে আন্তর্জাতিক পুরস্কার দেওয়া হয় তা হলো - অস্কার,
- ভারতের প্রথম অস্কার প্রাপক চলচ্চিত্র ছিলো - পথের পাঁচালি (পরিচালক - সত্যজিৎ রায়)
- পথের পাঁচালি মুক্তি লাভ করে - ১৯৫৫ খ্রিঃ,
- এ ট্রেন টু পাকিস্তানের লেখক - খুশবন্ত সিং,
- "তিতাস একটি নদীর নাম" চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন - ঋতিক ঘটক,
- "তিতাস একটি নদীর নাম" উপন্যাসের লেখক ছিলেন - অদ্বৈত মল্লবর্মন,
- ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার হলো - দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার,
- মল্লিকা সারাভাই কোন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত - নৃত্য।