শিল্পচর্চার ইতিহাসের একটি অন্যতম দিক বা ভাগ হলো - "চলচ্চিত্রের ইতিহাস"। শিল্প চর্চার ৪ টি শাখা সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক এবং চলচ্চিত্রের মধ্যে সময়কাল ও বয়সের বিচারে "চলচ্চিত্র" হলো সবচেয়ে নবীনতম ও সাম্প্রতিক।
চলচ্চিত্রের ইতিহাস চর্চা |
চলচ্চিত্রের পরিচয় ও ধারনা
- চলচ্চিত্র শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো - চলমান চিত্র বা ছবি। চলচ্চিত্র আমাদের কাছে ছায়াছবি বা সিনেমা নামেই অধিক পরিচিত।
- বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী গন মাধ্যম হলো চলচ্চিত্র।
- শুরুর দিকে চলচ্চিত্র বা সিনেমা আজকের মতো ছিলো না। প্রথম দিকে চলচ্চিত্র ছিলো নির্বাক ও সাদা কালো। সেখানে শুধুই চলমান ছবির মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের কাহিনী বা বিষয়বস্তু তুলে ধরা হতো। পরে সবাক ও রঙিন চলচ্চিত্রের উদ্ভব ঘটে।
চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য
চলচ্চিত্রের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের দিক তুলে ধরা যায় -
- চলচ্চিত্র ছিলো বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম।
- চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত হয় সমকালীন সমাজের নানা ভাবনা, ঘটনা, কাহিনী, রুচি, সংস্কৃতি, ও পোশাক পরিচ্ছদের পরিচয়।
- বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনার নিরিখে চলচ্চিত্র মূলত ৩ ধরনের হয়ে থাকে। যথা - তথ্যচিত্র, আর্ট ফিল্ম, এবং কর্মাশিয়াল ফিল্ম।
- প্রথম দিকে চলচ্চিত্র ছিলো নির্বাক ও সাদাকালো। পরে সবাক চলচ্চিত্র তৈরি হয় এবং সবার শেষে আসে রঙিন চলচ্চিত্র।
চলচ্চিত্রের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে চলচ্চিত্রের জন্ম হয়। চলচ্চিত্রের উদ্ভাবক দেশ ছিলো ফ্রান্স।
চলচ্চিত্রের জনক
১৮৯৫ খ্রিঃ ২৮ ডিসেম্বর, প্যারিসের হোটেল ডি ক্যাফেতে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন - অগাস্ট লুমিয়ের এবং লুই লুমিয়ের। এইজন্য তাদেরই "চলচ্চিত্রের জনক" বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের সূচনা
- ফ্রান্সে চলচ্চিত্র আবিষ্কারের মাত্র এক বছর পরেই ভারতে চলচ্চিত্রের আগমন ঘটে।
- ১৮৯৬ খ্রিঃ মুম্বইয়ের ওয়াটসন হোটেলে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। কলকাতায় অবশ্য প্রথম চলচ্চিত্র দেখানো হয় ১৮৯৮ খ্রিঃ।
- ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মান করেন হীরালাল সেন ও মতিলাল সেন। তারা দুজনেই বাঙালি ছিলেন।
- ১৮৯৮ খ্রিঃ চলচ্চিত্র নির্মানের জন্য হীরালাল "রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানি" প্রতিষ্ঠা করেন। প্রকৃত অর্থে এটিই ছিলো "ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মান সংস্থা"।
- ক্লাসিক থিয়েটারে তিনি আলিবাবা নাটকের কিছু অংশ ক্যামেরাবন্দী করে ১৮৯৮ খ্রিঃ খন্ডচিত্র আকারে এবং ১৯০৪ খ্রিঃ সম্পূর্ন আকারে প্রদর্শন করেন।
- প্রথম চলচ্চিত্র নির্মান ও প্রদর্শনের কৃতিত্বের জন্য অনেকে হীরালাল সেনকে "ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক" এর প্রকৃত দাবিদার বলে তুলে ধরলেও, এখনও তা ঐতিহাসিক মহলে স্বীকৃতি লাভ করে নি। এর প্রধান কারন হলো, যথেষ্ট প্রামাণ্য নথির অভাব। ১৯১৭ খ্রিঃ এক অগ্নিকাণ্ডে হীরালাল সেনের সমস্ত চলচ্চিত্র পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। পরিনামে যিনি এই দেশে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মান করলেন এবং প্রদর্শন করলেন, ইতিহাসে তার নুন্যতম স্বীকৃতি টুকুও জুটলো না।
দাদাসাহেব ফালকে ও ভারতীয় চলচ্চিত্র
ভারতে যথার্থ অর্থে পূর্ন দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র প্রথম নির্মান করেন ধুন্দিরাজ গোবিন্দ ফালকে। এই জন্য তাকেই ঐতিহাসিকরা "ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রকৃত জনক" বলে অভিহিত করেছেন।
ধুন্দিরাজ গোবিন্দ ফালকে ভারতীয়দের কাছে দাদাসাহেব ফালকে নামেই অধিক পরিচিত। ১৯১৩ খ্রিঃ তিনি নির্মান করেন ভারতের প্রথম সিনেমা "রাজা হরিশচন্দ্র"। এটি ছিলো ভারতে নির্মিত প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রকৃত উদ্বোধন ঘটানোর জন্য দাদাসাহেব ফালকের নামে পরবর্তীকালে এদেশে প্রচলিত হয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার - "দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার।
নির্বাক ও সবাক চলচ্চিত্র সম্পর্কিত তথ্য
- ভারতের প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র ছিলো - রাজা হরিশচন্দ্র। (১৯১৩)
- বাংলার প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র ছিলো - বিল্বমঙ্গল। (১৯১৯)।
- ভারতে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মিত হয় - ১৯৩০ খ্রিঃ।
- বাংলায় প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মিত হয় - ১৯৩১ খ্রিঃ। চলচ্চিত্রের নাম ছিলো "জামাইষষ্ঠী" ও "দেনা পাওনা" ।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ধারা ও বৈশিষ্ট্য
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ধারার মধ্যে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ও প্রবনতা লক্ষ্য করা যায় -
- শুরুর দিকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ধর্মীয় চলচ্চিত্র নির্মানের ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়। রাজা হরিশচন্দ্র (১৯১৩), শ্রীকৃষ্ণ জন্ম (১৯১৮), বিল্বমঙ্গল (১৯১৯) ইত্যাদি এই সময়ের নির্মিত চলচ্চিত্র গুলি সবই ছিলো ধর্মমূলক ছবি।
- বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে সাহিত্যধর্মী চলচ্চিত্র তৈরি হতে থাকে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা দেবদাস, জীবন নাটক ইত্যাদি চলচ্চিত্রের কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়।
- ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ দশকের চলচ্চিত্র গুলিতে দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা ও জাতীয়তাবাদী মানসিকতার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। কিসমত (১৯৪৩), শহীদ (১৯৪৮) ইত্যাদি চলচ্চিত্রের কথা এপ্রসঙ্গে বলা যায়।
- ১৯৫০ দশক পর জটিল সমাজ জীবনকে নিয়ে ছবি তৈরি হতে শুরু করে। যার মধ্যে অন্যতম ছিলো - পথের পাঁচালি, অপরাজিতা, দো বিঘা জমিন ইত্যাদি।
- সঙ্গীতের ব্যবহার প্রথম থেকেই ভারতীয় চলচ্চিত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো। আজকের দিনেও গান ছাড়া চলচ্চিত্রের কথা আমরা ভাবতেই পারি না। শুরুর দিকে অভিনেতাদের বেছে নেবার ক্ষেত্রে দেখা হতো তারা ভালো গাইতে পারেন কিনা।
পথের পাঁচালি ও অস্কার
- পথের পাঁচালি ছিলো সাহিত্যিক বিভূতিভূষন বন্দোপাধ্যায়ের লেখা প্রথম উপন্যাস। আর এই উপন্যাসকে নিয়েই সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবনের প্রথম চলচ্চিত্রটি নির্মান করেন।
- পথের পাঁচালি মুক্তি লাভ করে ১৯৫৫ খ্রিঃ।
- পথের পাঁচালি চলচ্চিত্রের জন্য সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক পুরস্কার "অস্কার" লাভ করেন।
- পথের পাঁচালি হলো এখনও পর্যন্ত (২০২১) ভারতের প্রথম এবং একমাত্র অস্কার প্রাপক চলচ্চিত্র।
চলচ্চিত্রের ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব
চলচ্চিত্রের ইতিহাস চর্চার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিকের কথা তুলে ধরা যায়। যেমন -
(১.) চলচ্চিত্রের পশ্চাৎপটের ইতিহাস
কোন পরিস্থিতিতে এবং কিভাবে চলচ্চিত্রের উদ্ভব ও সূচনা ঘটেছিলো, তার পশ্চাৎপটের ইতিহাস একমাত্র চলচ্চিত্রের ইতিহাস থেকেই জানা যায়। ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মানের যে টুকু অতীত এখনও পর্যন্ত জানা গেছে, তা এই ইতিহাস চর্চার ফলেই জানা সম্ভব হয়েছে।
(২.) সামাজিক ইতিহাস রচনার উপাদান
চলচ্চিত্র থেকে সামাজিক ইতিহাস রচনার নানা উপাদান পাওয়া যায়। যেমন -
- চলচ্চিত্র থেকে সমকালীন সময়ের সাজ পোশাক, পোশাক পরিচ্ছেদ, কথ্য ভাষার বিবর্তন ইত্যাদি দিক গুলি সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
- চলচ্চিত্র মানুষের বিনোদনের একটি মাধ্যম। তাই চলচ্চিত্র থেকে সমাজের রুচি ও সংস্কৃতির বিবর্তন ও পরিবর্তনের নানা দিক গুলোকে বুঝে নেওয়া যায়।
- চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে যেকোন সময়কালের সমাজ ব্যবস্থার ধরন, মনস্তত্ত্ব, মানুষের আশা আকাঙ্খা, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র ইত্যাদি দিকের পরিচয় পাওয়া যায়।
- এছাড়া, চলচ্চিত্রের দ্বারা গন সংস্কৃতিও প্রভাবিত হয়। জনসাধারণের একটি বড়ো অংশ চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত বিষয় গুলির (যেমন সাজ পোশাকের ধরন,গান) অনুকরন করে থাকে।
চলচ্চিত্রের ইতিহাস সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- চলচ্চিত্রের প্রথম উদ্ভব ঘটে - ফ্রান্সে।
- চলচ্চিত্রের জনক ছিলেন - অগাস্ট লুমিয়ের, লুই লুমিয়ের।
- ভারতে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মান করেন - হীরালাল সেন।
- ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক ছিলেন - দাদাসাহেব ফালকে।
- ভারতের প্রথম পূর্ন দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মান করা হয় - ১৯১৩, রাজা হরিশচন্দ্র। পরিচালক, দাদাসাহেব ফালকে।
- রাজা হরিশচন্দ্র প্রদর্শিত হয় - অলিম্পিয়া থিয়েটারে।
- প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় - ১৯১৯, বিল্বমঙ্গল।
- প্রথম ভারতীয় নির্বাক ছবি ছিলো - রাজা হরিশচন্দ্র।
- প্রথম বাংলা নির্বাক ছবি ছিলো - বিল্বমঙ্গল।
- রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানি তৈরি করেন - হীরালাল সেন ও তার ভাই মতিলাল সেন।
- আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের অবদানের জন্য সর্বোচ্চ পুরস্কার দেওয়া হয় - অস্কার।
- প্রথম অস্কার প্রাপক ভারতীয় চলচ্চিত্র হলো - পথের পাঁচালি (১৯৫৫)।
- পথের পাঁচালি উপন্যাস লিখেছিলেন - বিভূতিভূষন বন্দোপাধ্যায়।
- ভারতে চলচ্চিত্রের কৃতিত্বের জন্য দেওয়া হল - দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার।
- বাংলার কয়েকজন স্মরণীয় চলচ্চিত্র পরিচালক হলেন - সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক কুমার ঘটক, মৃনাল সেন
- সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্র - পথের পাঁচালি, অশনি সংকেত, অরন্যের দিনরাত্রি, হীরক রাজার দেশে, গুপি গায়েন বাঘা বায়েন, গুপি বাঘা ফিরে এলো।
- ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত চলচ্চিত্র - মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, সুবর্ন রেখা, তিতাস একটি নদীর নাম।
- তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের লেখক ছিলেন - অদ্বৈত মল্ল বর্মন।
- দেশভাগ সম্পর্কিত চলচ্চিত্র - দীপা মেহতার "1947, আর্থ," পামেলা রুকসের "ট্রেন টু পাকিস্তান"।
- এ ট্রেন টু পাকিস্তানের লেখক ছিলেন - খুশবন্ত সিং।
- ভারতীয় চলচ্চিত্র হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চলচ্চিত্র শিল্প।
- বিষয় চলচ্চিত্র গ্রন্থের লেখক - সত্যজিৎ রায়।
- "চলচ্চিত্র, মানুষ এবং আরোও কিছু লেখা" লেখেন - ঋত্বিক ঘটক।