নাটকের ইতিহাস চর্চা

 সাহিত্য ও শিল্প চর্চার একটি অন্যতম ভাগ হল - নাটক

নাটকের ইতিহাস চর্চা
নাটকের ইতিহাস চর্চা 

নাটকের বুৎপত্তিগত অর্থ ও ধারনা

  • নাটক বা নাট্য শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিলো "নট" শব্দটি থেকে, যার অর্থ ছিলো নড়াচড়া করা, অঙ্গ চালনা করা বা কোন কিছু করা।
  • মানুষের অনুকরন করবার সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই নাটকের উৎপত্তি ঘটেছিলো। 
  • নাটকের প্রথম উৎপত্তি ঘটে গ্রিসে
  • আমাদের দেশে নাটকের উৎপত্তি ঘটে বৈদিক যুগে। বেদের অনেক স্তোত্র বা মন্ত্র কথোপকথনের আকারে রচনা করা হয়েছিলো। এইসব স্তোত্র নৃত্যগীতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে "নাটকে" রূপলাভ করেছিলো বলে ঐতিহাসিকরা মনে করে থাকেন।

প্রাচীন ভারতে নাট্যচর্চা

প্রাচীন ভারতের নাটক সম্পর্কিত একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো ভরতমুনির লেখা "নাট্যশাস্ত্র"। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, কমবেশি ২,০০০ বছর আগে ভারতে নাটকের চর্চা শুরু হয়।
  • প্রাচীন ভারতে নাটক গুলি সবই সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছিলো।
  •  খ্রিঃ প্রথম শতকে ভারতে সংস্কৃত নাটকের উদ্ভব হয়। খ্রিঃ প্রথম শতক থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত ছিলো সংস্কৃত নাটকের গৌরবময় যুগ।

প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত কিছু নাটক

প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত নাটক গুলির মধ্যে অন্যতম হলো -
  • শূদ্রকের লেখা - "মৃচ্ছকটিক",
  • ভাসের লেখা - "স্বপ্নবাসবদত্তা",
  • কালিদাসের লেখা - "মালবিকাগ্নিমিত্রম", "অভিজ্ঞান শকুন্তলম",
প্রাচীনকালে সংস্কৃত নাটকের ওপর গ্রিসের নাটকের অনেক প্রভাব পড়েছিলো। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, গ্রিসের প্রভাবে ভারতে নাটকের সমাপ্তির পর "পর্দার ব্যবহার" প্রচলিত হয়। একে বলা হতো" "যবনিকা"। প্রসঙ্গত এটিও জেনে রাখা প্রয়োজন যে, ভারতে বিদেশী গ্রিকদের "যবন" বলেই ডাকা হতো।

আধুনিক ভারতে নাট্যচর্চা

আধুনিক ভারতে নাট্যচর্চার এক নতুন ধারা শুরু হয় ঔপনিবেশিক আমলে। এইসময় পাশ্চাত্য নাটকের সংস্পর্শে এসে ভারতীয় নাট্য ধারায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে।
  • এক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শিশির ভাদুড়ী, শম্ভু মিত্র উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
  • পরবর্তীকালে ভারতীয় গননাট্য সংঘের সদস্য পৃথ্বিরাজ কাপুর, বিজন ভট্টাচার্য, ঋতিক ঘটক, উৎপল দত্ত, সলিল চৌধুরী, নাটককে সর্বসাধারনের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন।

নাটকের ইতিহাস চর্চার সঙ্গে যুক্ত ঐতিহাসিক

আধুনিককালে অনেক গবেষকই নাটকের ইতিহাস চর্চা করছেন। এদের মধ্যে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজীবন মুখোপাধ্যায় এবং আশুতোষ ভট্টাচার্য অন্যতম।

নাটকের ইতিহাস চর্চা সম্পর্কিত এদের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলি হলো -
  • বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস - ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
  • দৃশ্যকাব্য পরিচয় - সত্যজীবন মুখোপাধ্যায়।
  • বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস - আশুতোষ ভট্টাচার্য।

নাটকের বৈশিষ্ট্য

শিল্পকলার অন্যতম শাখা হিসাবে নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি হলো -
  1. নাটক মানুষের নান্দনিকতারঅনুভূতির প্রকাশ মাধ্যম।
  2. পৃথিবীর সব জনসমাজের কাছেই নাটক সংস্কৃতি চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। 
  3. উপস্থাপন পদ্ধতি অনুসারে নাটক বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। যথা - শ্রুতিনাটক, পথনাটক, একাঙ্কনাটক, গীতিনাট্য, গননাট্য ইত্যাদি।
  4. বিষয়বস্তুর নিরিখে নাটক সাধারনত ৩ রকমের হয়ে থাকে। যথা - বিয়োগান্তক নাটক (Tragedy), মিলনাত্মক নাটক এবং প্রহসন মূলক নাটক।
  5. একাধিক চরিত্রের সমাবেশ নাটকের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

নাটকের ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব

প্রথাগত ইতিহাস ও সামাজিক ইতিহাস দুটি ক্ষেত্রেই নাটকের ইতিহাস চর্চা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সংক্ষেপে এর গুরুত্বের প্রধান দিক গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি - 

(১.) চলমান সমাজের প্রতিচ্ছবি 

যেকোন সময়কালের নাটকেই প্রতিফলিত হয় সেই সময়কালের সমাজের প্রতিচ্ছবি। নাটকের মধ্য দিয়ে তাই সমকালীন সমাজের চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, সমাজের নৈতিক মানদন্ড ও সংঘবদ্ধ জীবনের উত্থান পতনের নানা দিক গুলির পরিচয় আমরা পেয়ে থাকি। 

(২.) প্রভাবশালী ঘটনার পরিচয়

সমাজে দাগ কেটে যাওয়া এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী ঘটনা গুলিই সাধারনত মানুষের সংস্কৃতি চর্চায় উঠে আসে। নাটকও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। নাটক থেকে বিশেষ কোন সামাজিক প্রবনতা বা ঘটনার ব্যাপ্তি ও ব্যপকতার নানা দিক গুলির পরিচয় পাওয়া যায়। উদাহরন হিসাবে বলা যায় - 
  • বিধবা বিবাহ আইন পাশ হবার পর বিধবা বিবাহ নিয়ে কলকাতায় অনেক গুলি নাটক মঞ্চস্থ হয়। এইসব নাটক গুলি থেকে বিধবা বিবাহের প্রতি তৎকালীন সমাজের প্রতিক্রিয়া ও মনোভাবের কথা জানতে পারা যায়। 
  • একইরকম ভাবে পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় গ্রামবাংলা এবং কলকাতার সমাজ চিত্র কেমন ছিলো, তা জানতে বিজন ভট্টাচার্যের "নবান্ন" নাটকটি বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকে। 

(৩.) ঐতিহাসিক তথ্যের সন্ধান 

নাটক থেকে অনেক সময় ইতিহাসের নানা অজানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পাওয়া যায়। উদাহরন হিসাবে বলা যায় - 
  • প্রাচীন ভারতে কালিদাসের "মালবিকাগ্নিমিত্রম" নাটক থেকেই একমাত্র শুঙ্গ শাসক "অগ্নিমিত্রের" কথা জানা যায়। 
  • একই রকম ভাবে বিশাখদত্তের "দেবীচন্দ্রগুপ্তম" নাটক থেকে জানা যায়, গুপ্ত সম্রাট সমুদ্র গুপ্তের মৃত্যুর পর তার জেষ্ঠ পুত্র রামগুপ্ত সিংহাসনে বসেছিলেন। রামগুপ্তের কথা একমাত্র "দেবীচন্দ্রগুপ্তম" নাটক থেকে জানতে পারা যায়। এই ভাবে দেখা যায়, নাটকের ইতিহাস চর্চা থেকে প্রথাগত ইতিহাসও সমৃদ্ধ হয়ে থাকে।

নাটকের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক 

পরাধীন ভারতে জাতীয়তাবাদের বিকাশে নাটক এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সময় পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক নাটকের মোড়কে বহু নাট্যকার দেশাত্মবোধ জাগরনের চেষ্টা করেন। 

"সুরেন্দ্র বিনোদিনী", "গজদানন্দ ও যুবরাজ", "সরোজিনী", "অশ্রুমতী" ইত্যাদি নাটক পরাধীন ভারতে প্রবল ভাবে জাতীয়তাবোধের জাগরন ঘটায়। 

দীনবন্ধু মিত্রের "নীলদর্পন" নাটকের কথাও প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়। নীল চাষের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছিলো এই নাটক। ভারতীয়দের ওপর শ্বেতাঙ্গদের নানা অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে এই নাটকটি ভারতীয়দের মধ্যে এতটাই জাতীয়তাবাদী ক্ষোভের সঞ্চার করে যে, ১৯০৮ খ্রিঃ নীলদর্পনের অভিনয়ের ওপর ব্রিটিশ সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে। 

এছাড়া, সাধারন ভাবে নাটকের ওপর নিয়ন্ত্রন স্থাপনের জন্য এবং নাটকের মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদের কন্ঠরোধের জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৭৭৬ খ্রিঃ "নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রন আইন" জারি করে। 

 নাটক বন্ধ করবার জন্য সরকারের আইন প্রণয়ন দেখেই বোঝা যায়, পরাধীন ভারতে জাতীয়তাবাদের জাগরনে নাটক ঠিক কতখানি প্রভাব ফেলতে পেরেছিলো। 

নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রন আইনের পরিচয় 

নাটক জনগনের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা কে জাগরিত করে শাসক শ্রেনীর মনে কতখানি ত্রাসের সঞ্চার ঘটাতে পারে, তারই একটি স্বার্থক উদাহরন ছিলো ব্রিটিশ সরকারের "নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রন আইন" প্রণয়ন। 

আইটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় 

১৮৭৬ খ্রিঃ বড়োলাট লর্ড নর্থব্রুক "নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রন আইন" জারি করেন। 

এর মুল উদ্দেশ্য ছিলো - ভারতে নাটকের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে রাখা। এই আইনে বলা হয় - 
  1. নাটক মঞ্চস্থ করবার আগে তার খসড়া লোকাল থানায় জমা করতে হবে। 
  2. সরকার বিরোধী কোন নাটক মঞ্চস্থ করা যাবে না। 
  3. সরকার বিরোধী কোন নাটক মঞ্চস্থ হলে নাটকের পরিচালক, প্রযোজক ও অভিনেতাদের শাস্তি দেওয়া হবে। 

নাটক সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য 

  1. নাটকের প্রথম উৎপত্তি ঘটে - গ্রিসে।
  2. ভারতীয় নাটকের আদি উৎস ছিলো - ভরতমুনির লেখা নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থ। 
  3. মৃচ্ছকটিক নাটকের লেখক - শূদ্রক। 
  4. কালিদাসের লেখা নাটক - মালবিকাগ্নিমিত্রম, অভিজ্ঞান শকুন্তলা, মেঘদূতম।
  5. দেবীচন্দ্রগুপ্তম নাটকের লেখক - বিশাখদত্ত। 
  6. উনিশ ও বিশ শতকের বাংলা নাট্যকার - মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শিশির ভাদুড়ী, শম্ভু মিত্র। 
  7. জাতীয়তাবাদের সঞ্চার করে এমন কিছু নাটক - সুরেন্দ্র বিনোদিনী, গজদানন্দ ও যুবরাজ, সরোজিনী, অশ্রু তি, নীলদর্পন। 
  8. নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রন আইন জারি করা হয় - ১৮৭৬ খ্রিঃ লর্ড নর্থব্রুক ।
  9. বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস লেখেন - ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। 
  10. কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক - 
    • নবান্ন - বিজন ভট্টাচার্য, 
    • নীলদর্পন - দীনবন্ধু মিত্র, 
    • নবান্ন - বিজন ভট্টাচার্য, 
    • রক্তকরবি - শম্ভু মিত্র, 
    • টিনের তলোয়ার - উৎপল দত্ত। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post