যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস

 সামাজিক ইতিহাস চর্চার একটি অন্যতম দিক হলো - "যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস"

যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস
যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস


যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসের সংজ্ঞা

এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতবার্তা প্রেরনের মাধ্যম গুলির উদ্ভব, বিবর্তন এবং জনসমাজে তার প্রভাবের দিক গুলি নিয়ে আলোচনার ইতিহাসকেই সাধারনত "যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস" বলা হয়।

যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ধরন

যানবাহন মূলতধরনের হয়ে থাকে। যথা -

  • জলপথের যান, (নৌকা, জাহাজ, ভেলা ইত্যাদি) 
  • স্থলপথের যান, ( বাস, ট্রাম, ট্রেন, ঘোড়ার গাড়ি বা গরুর গাড়ি, মোটরবাইক, ট্যাক্সি ইত্যাদি) 
  • অন্তরীক্ষ বা আকাশপথের যান, ( এরোপ্লেন, রকেট, হেলিকপ্টার, ইত্যাদি) 
অন্যদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্র গুলি হলো -
  • টেলিগ্রাফ,
  • টেলিফোন, 
  • চিঠিপত্র,
  • রেডিও, 
  • টিভি, 
  • ফ্যাক্স,
  • ইমেল, 
  • মোবাইল,
  • ইন্টারনেট, 
  • হোয়াটস অ্যাপ, টেলিগ্রাফ, ফেসবুক ইত্যাদি অ্যাপ।
যানবাহন এবং যোগাযোগ দুয়েরই মূল লক্ষ্য থাকে সংযোগ স্থাপন করা। 

যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস চর্চার সূচনা

  1. ১৯৬০ - ৭০ এর দশক থেকেই যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত ঘটে।
  2. বর্তমানে সামাজিক ইতিহাস চর্চার একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসাবে যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস স্বীকৃতি লাভ করেছে। 
  3. সাম্প্রতিক কালে অনেকেই যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস নিয়ে চর্চা করে চলেছেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন - 
    • ইয়ান কের, 
    • সুনীল কুমার মুন্সি, 
    • নীতিন সিনহা, 
    • আর এস চৌরাসিয়া। 

যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব 

যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস চর্চার একাধিক গুরুত্বের দিক রয়েছে। সংক্ষেপে এর গুরুত্বের প্রধান দিক গুলি আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি - 

(১.) যোগাযোগ ব্যবস্থার বিবর্তনের ইতিহাস 

যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস চর্চা থেকে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম গুলির উদ্ভব ও বিবর্তনের ইতিহাস জানা যায়। 

(২.) অবলুপ্ত পথঘাটের অনুসন্ধান 

কালের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া অনেক পথ ঘাটের অনুসন্ধান এই ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিকরা করে চলেছেন। আবার বর্তমানে প্রচলিত পথ ঘাট গুলির অতীত ইতিহাসও এই ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়ে উঠে আসছে। 

(৩.) আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাব

যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা কিভাবে মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক জীবনকে প্রভাবিত করে তা এই ইতিহাস চর্চা থেকে জানা যায়। 

উদাহরন হিসাবে বলা যায় - 
  • ভারতে রেলপথের বিস্তার ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবকে যেমন ত্বরান্বিত করেছিলো, তেমনই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ফাঁসকেও শক্ত করে তুলতে সাহায্য করেছিলো। 
  • সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার এক নিবিড় সম্পর্ক থাকে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্যই ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ সহ, অন্যান্য স্বাধীনতা আন্দোলন গুলিকে ইংরেজদের পক্ষে দমন করা সহজ হয়। 
  • ঔপনিবেশিক আমলে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার হাত ধরেই বেশ কিছু রোগ ভারতে মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়েছিলো। প্রাচীন ভারতবর্ষে দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য মানুষের স্থানান্তর খুব কম হতো। ফলে ছোঁয়াচে রোগ সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছড়িয়ে মহামারীর আকার নিতে পারতো না। 
  • যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সূত্র ধরে ভারতে বর্নবৈষম্যবাদ প্রকট হয়ে উঠেছিলো। ট্রেন বা ট্রামের প্রথম শ্রেণীর কামরায় ওঠবার কোন অধিকার কোন ভারতীয়র ছিলো না। মহাত্মা গান্ধী একবার ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর কামরায় যাত্রা করলে কিছু ইংরেজ তাকে লাথি মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দেন। 
  • ঔপনিবেশিক ভারতে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে ভারতে কৃষি পন্যের বানিজ্যীকীকরন ঘটে। দামের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রভেদ দূর হয় এবং সমতা দেখা যায়।

(৪.) প্রযুক্তির অগ্রগতির পরিচয়

যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকে প্রযুক্তি। তাই যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়ে একটি সময়কালের প্রযুক্তির উন্নতি ও অগ্রগতির দিক গুলিরও পরিচয় পাওয়া যায়। 

(৫.) বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে যোগাযোগের ভূমিকা 

উন্নত ও সহজ যোগাযোগ বিশ্বায়নকে করেছে ত্বরান্বিত। বর্তমানে ইন্টারনেট, মোবাইল, ইমেল, হোয়াটস অ্যাপ যোগাযোগের প্রচলিত সংজ্ঞাটাই পাল্টে দিয়েছে। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যোগাযোগ হয়ে উঠেছে দ্রুত ও সহজ। 
এই যোগাযোগ ও ভাববিনিময় - খাদ্যাভ্যাস থেকে পোশাক পরিচ্ছদ, খেলাধুলা থেকে সংস্কৃতি, মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকেই প্রভাবিত করছে। এমনকি এর ফলে বিশ্ব পরিবেশও প্রভাবিত হচ্ছে। 

খুব স্বাভাবিক ভাবেই এত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবের জন্য যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসকে ঐতিহাসিকরা সামাজিক ইতিহাস চর্চায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। 

যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য 

  1. টেলিফোন আবিষ্কার করেন - গ্রাহাম বেল (১৯৭৬)।
  2. পিচ দিয়ে রাস্তা তৈরির কৌশল আবিষ্কার করেন - টেলফোর্ড ও ম্যাকডাম।
  3. বাষ্পীয় রেল ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন - জর্জ স্টিভেনশন। 
  4. বাষ্পীয় স্টিমার আবিষ্কার করেন - ফুলটন। 
  5. এরোপ্লেন আবিষ্কার করেন - রাইট ভ্রাতৃদ্বয়। 
  6. ভারতে প্রথম রেলপথ স্থাপিত হয় - ১৮৫৩ খ্রিঃ বোম্বেতে।
  7. ভাস্কো দা গামা ভারতে আসেন - ১৪৯৮ খ্রিঃ। 
  8. ভাস্কো দা গামা ভারতে আসার ফলে - ইওরোপ থেকে ভারতে আসার নতুন জলপথের আবিষ্কার হয়। পরবর্তীকালে এই পথেই ইংরেজ, ফরাসি প্রভৃতি বিদেশী শক্তি গুলি ভারতে পদার্পণ করে। 
  9. সুয়েজ খাল খনন করা হয় - ১৮৬৯ খ্রিঃ।
  10. ইংল্যান্ডে ট্রামের সূচনা হয় - ১৮০৭ খ্রিঃ। 
  11. প্রাক্ ঔপনিবেশিক কালে ভারতের উল্লেখযোগ্য যানবাহন ছিলো - গরুরগাড়ী ও পালকী। 
  12. যাতায়াতের ৩ টি মাধ্যম হলো - জলপথ, স্থলপথ ও আকাশপথ। 
  13. কলকাতায় ঘোড়ায় টানা ট্রামের সূচনা হয় - ১৯০২ খ্রিঃ।
  14. যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস চর্চার সঙ্গে যুক্ত ঐতিহাসিক - ইয়ান কের, সুনীল কুমার মুন্সী, নীতিন সিনহা।

যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস সম্পর্কিত গ্রন্থ 

  • ইঞ্জিন অব চেঞ্জ দ্য রেলরোডস দ্যাট মেড ইন্ডিয়া - ইয়ান কের।
  • পূর্ব ভারতে পরিবহন ও যোগাযোগ বিষয়ক গ্রন্থ - নীতিন সিনহা।
  • হিস্ট্রি অব মর্ডান ইন্ডিয়া - আর এস চৌরাসিয়া। 


Post a Comment (0)
Previous Post Next Post