মিউজিয়ামের উদ্ভব,বিকাশ ও কার্যাবলী

 মিউজিয়াম বা সংগ্রহশালা হলো একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে ইতিহাস জানতে সাহায্য করে, এমন সব পুরাবস্তু সংরক্ষণ করে রাখা হয়।

মিউজিয়ামের উদ্ভব, বিকাশ ও কার্যাবলী
ভারতের একটি মিউজিয়ামের খন্ড চিত্র 


মিউজিয়ামের বুৎপত্তিগত অর্থ

গ্রিক শব্দ "Mouseion" (মউসিয়ান) থেকে "Museum" (মিউজিয়াম) শব্দটি এসেছে। Mouseion শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে -

  • প্রাচীন গ্রিসে কাব্য ও কলাবিদ্যার ৯ জন দেবতাদের মন্দিরকে Mouseion বলা হতো।
  • অন্য আরেক অর্থে গ্রিসের ছোট ছোট পাহাড়কে Mouseion বলা হতো। এইসব পাহাড়ে Mousaious/"মাওসিয়াস" নামে এক ব্যক্তি গান গাইতেন।
  • অর্থাৎ বুৎপত্তিগত অর্থে মিউজিয়াম শব্দটি "শিল্প চর্চার প্রতিষ্ঠান" বা "পন্ডিত ব্যক্তিদের স্থান" অর্থে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে শব্দটির অর্থ পরিবর্তন হয়।
  • সপ্তদশ শতাব্দীতে ইওরোপে "জ্ঞানের সংরক্ষণ" করা অর্থে মিউজিয়াম শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়।
  • ১৭৫৯ খ্রিঃ লন্ডনের "দ্য ব্রিটিশ মিউজিয়াম" প্রতিষ্ঠার পর "মিউজিয়াম" শব্দটি একটি "প্রাতিষ্ঠানিক রূপ" নেয়। 
  • মিউজিয়াম শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হলো - জাদুঘর, সংগ্রহশালা বা প্রদর্শনশালা।
  • মিউজিয়াম সংক্রান্ত বিদ্যাকে বলা হয় - "Museology" (মিউজিওলজি) বা প্রদর্শন সংক্রান্ত বিদ্যা। 

মিউজিয়ামের সংজ্ঞা

মিউজিয়াম বা জাদুঘর হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রাচীন ইতিহাস জানতে সাহায্য করে এমন সব নিদর্শন, যেমন - পুরাবস্তু, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি এবং অন্যান্য বিষয়ক বস্তু সামগ্রী (১.) সংগ্রহ করা হয়,(২.) সংরক্ষণ করা হয় এবং (৩.) প্রদর্শন করা হয়। দর্শনার্থীরা এইসব দেখে আনন্দ লাভ করে এবং অতীত সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে।

 মিউজিয়ামের উদ্ভব ও বিকাশ

অতীতে মিউজিয়াম গুলি সাধারনত (১.) কোন ব্যক্তি,(২.) পরিবার বা (৩.) প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিলো। পরবর্তীকালে অবশ্য এই সমস্ত উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং উদ্যোগে বিভিন্ন দেশে মিউজিয়াম গড়ে উঠতে শুরু করে। 

মিউজিয়ামের উদ্ভব ও বিকাশকে আলোচনার সুবিধার্থে ৩ টি ভাগে বিভক্ত করে তুলে ধরা যায় - 
  • প্রাচীন যুগের মিউজিয়াম, 
  • মধ্য যুগের মিউজিয়াম, 
  • আধুনিক যুগের মিউজিয়াম, 

(১.) প্রাচীন যুগের মিউজিয়াম 

  • পৃথিবীর সবথেকে প্রাচীন মিউজিয়াম গড়ে উঠেছিলো মেসোপটেমিয়াতে ৫৩০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে।নাম ছিলো - "ইনিগালদি নান্নার সংগ্রহশালা
  • প্রাচীন যুগে গ্রিসের এথেন্সে দার্শনিক প্লেটো পুস্তকের একটি গ্রন্থাগার বা সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছিলেন। 
  • তবে প্রাচীন যুগে মিউজিয়ামের সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটেছিলো চিনে। চিনের সি হুয়াং তি এবং হু তি  প্রমুখ সম্রাটরা দুর্লভ নানা বস্তুসামগ্রী সংরক্ষণের জন্য সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন। 

(২.) মধ্য যুগের মিউজিয়াম 

মধ্য যুগে ভূমধ্যসাগরীয় বানিজ্যক্রুসেডের সূত্রে বহু দুর্লভ বস্তু ইতালি এবং ইওরোপের অন্যান্য দেশ গুলিতে প্রবেশ করে। এর ফলে মধ্যযুগের শেষ দিকে বিশেষত পঞ্চদশ শতকে নবজাগরনের সময় ব্যক্তিগত এবং রাজকীয় উদ্যোগে নানা মিউজিয়াম গড়ে ওঠে। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো - 
  • ক্যাপিটোলাইন মিউজিয়াম, 
  • ভ্যাটিকান মিউজিয়াম, 
  • এছাড়া এইসময় ইওরোপের বিভিন্ন রাজাদের উদ্যোগে অনেক রাজকীয় সংগ্রহশালাও গড়ে উঠেছিলো। 

(৩.) আধুনিক যুগের মিউজিয়াম 

সপ্তদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক মিউজিয়াম গুলির অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত সময়কালে, পৃথিবীর বেশিরভাগ আধুনিক মিউজিয়াম গুলি গড়ে ওঠে। এইজন্য এই সময়কালকে "জাদুঘরের যুগ" বলা হয়ে থাকে।

প্রাচীন ও মধ্য যুগের মিউজিয়াম গুলির সঙ্গে আধুনিক যুগের মিউজিয়ামের একটি মৌলিক পার্থক্য ছিলো।

 আগেকার যুগের মিউজিয়াম গুলোতে সাধারন মানুষের কোন প্রবেশাধিকার ছিলো না। কিন্তু আধুনিক যুগের মিউজিয়াম গুলিতে সাধারন মানুষ প্রবেশাধিকার লাভ করে। 

এই সময়ের উল্লেখযোগ্য মিউজিয়াম গুলি হল - 
  • ব্রিটিশ মিউজিয়াম, 
  • ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়াম, 
  • ফ্লোরেন্সের উফ্ফিজি গ্যালারি, 
  • দ্য আর্ট ইন্সটিটিউট অব শিকাগো, 
  • দ্য ফিল্ড মিউজিয়াম (শিকাগো)। 

মিউজিয়াম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য 

ইওরোপের মিউজিয়াম 

  1. পৃথিবীর প্রাচীনতম মিউজিয়াম ছিলো - "ইনিগালদি নান্নার সংগ্রহশালা"।
  2. পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বেশি মিউজিয়াম আছে - মেক্সিকো সিটিতে, (১২৮ টি)।
  3. ইংল্যান্ডে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত প্রথম জাদুঘর হলো - লন্ডনের রয়েল আরমারিজ। 
  4. পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক দর্শনার্থীদের ভিড় হয় এমন ৩ টি মিউজিয়াম হল -
    •  ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত ল্যুভর মিউজিয়াম (১৭৯৩ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয়), 
    • আমেরিকার নিউইয়র্কের ম্যাট্রিপলিটন মিউজিয়াম, 
    • ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ মিউজিয়াম (১৭৫৩ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয়),

ভারতের মিউজিয়াম 

  1. ভারতে মোট মিউজিয়াম আছে - ৪০০ টি।
  2. ভারতের ৩ টি বৃহৎ মিউজিয়াম হলো - 
    • পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবস্থিত ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম বা কলকাতা জাদুঘর, 
    • উত্তরপ্রদেশের বারানসীতে অবস্থিত ভারতকলা ভবন মিউজিয়াম, 
    • মুম্বইয়ের প্রিন্স অব ওয়েলস মিউজিয়াম। 

পশ্চিমবঙ্গের মিউজিয়াম 

  1. পশ্চিমবঙ্গের সবথেকে বিখ্যাত মিউজিয়াম হলো - ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম
    • এটি ১৮১৪ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয়।
    • এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জীববিদ্যা বিশারদ ড. ন্যাথানিয়েল উলিখ। 
    • এটি ছিলো এশিয়া তথা ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বপ্রাচীনসর্ববৃহৎ জাদুঘর, 
    • কলকাতা জাদুঘর নামেই এটি প্রসিদ্ধ। 

জাদুঘরের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী

মিউজিয়ামের মূল উদ্দেশ্য এবং কার্যাবলি হলো ৩ টি - 
  • সংগ্রহ, 
  • সংরক্ষণ এবং 
  • প্রদর্শন। 

(১.) সংগ্রহ 

জাদুঘরের প্রধান কাজই হলো দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঐতিহাসিক পুরাবস্তু গুলিকে খুঁজে বের করা এবং সেগুলিকে সংগ্রহ করা। 

(২.) সংরক্ষণ 

মিউজিয়ামের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য বা কাজটি হলো সংগৃহীত ঐতিহাসিক বস্তু গুলিকে যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করে রাখা। ঐতিহাসিক নিদর্শন গুলিকে চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে একমাত্র রক্ষা করতে পারে মিউজিয়াম। 

দুর্লভ প্রাচীন মুদ্রা, লিপি, রাজা মহারাজার ব্যবহৃত নানা জিনিস পত্র, ঐতিহাসিক চিঠিপত্র, শিল্পকর্ম ইত্যাদি নানা ধরনের বস্তু সামগ্রীকে বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে নিরাপদে সংরক্ষণ করে রাখা মিউজিয়ামের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। 

(৩.) প্রদর্শন 

ঐতিহাসিক বস্তু সামগ্রী সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করে মিউজিয়ামের কাজ শেষ হয়ে যায় না। বস্তু সামগ্রীকে স্থায়ী ভাবে বা সময়ান্তরে অস্থায়ী ভাবে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করাও মিউজিয়ামের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে পড়ে। 

ঐতিহাসিক বস্তু সামগ্রী প্রদর্শনের ক্ষেত্রে মিউজিয়াম দুটি উদ্দেশ্য সাধন করে থাকে। যথা - 
  • (ক.) শিক্ষা মূলক উদ্দেশ্য এবং 
  • (খ.) বিনোদন মূলক উদ্দেশ্য। 

(ক.) শিক্ষা মূলক উদ্দেশ্য

মিউজিয়ামের শিক্ষামূলক উদ্দেশ্য ৩ টি - 


(১.) গবেষণার কাজকে ত্বরান্বিত করা 

মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করে রাখা ঐতিহাসিক বস্তু সামগ্রী গুলি নানা দিক থেকে গবেষকদের গবেষনায় সাহায্য করে থাকে। 


(২.) জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো 

মিউজিয়ামে সংরক্ষিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক বস্তু সামগ্রী এবং তার সংক্ষিপ্ত তথ্য সম্বলিত বর্ননা দেখে সাধারন দর্শক ও শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে থাকেন। 

(৩.) ইতিহাসকে প্রানবন্ত করে তোলা

মিউজিয়ামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা মূলক উদ্দেশ্য হলো ইতিহাসকে প্রানবন্ত ও আকর্ষনীয় করে তোলা। 

ইতিহাস বইয়ে আমরা অতীতের যেসব ঘটনার কথা পড়ি, মিউজিয়ামে গিয়ে সেই সব ঘটনার জীবন্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন গুলি দেখতে পাই। এর ফলে ইতিহাস আমাদের কাছে অনেক বেশি জীবন্ত ও প্রানবন্ত হয়ে ওঠে। 

(খ.) বিনোদন মূলক উদ্দেশ্য 

মিউজিয়ামের বিনোদন মূলক উদ্দেশ্য গুলি হলো - 
  1. আনন্দদান করা, 
  2. অতীতঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা, 
  3. জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটানো, 

মূল্যায়ন 

মিউজিয়াম উপরে উল্লেখিত মূল কাজ গুলি ছাড়াও আরোও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। যেমন - 
  1. গবেষকদের কাজে লাগিয়ে সংগৃহীত বস্তুগুলির ঐতিহাসিক মূল্য ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করে রাখা, 
  2. নতুন সংগৃহীত পুরাবস্তুর খবর ঐতিহাসিক পত্র পত্রিকাতে প্রকাশনার ব্যবস্থা করা
  3. অস্থায়ী ভাবে অন্যান্য মিউজিয়ামে প্রেরন করে মূল্যবান পুরাবস্তু গুলি প্রদর্শনে সাহায্য করা
  4. অ - স্থানান্তর দুষ্প্রাপ্য পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন গুলির মডেল তৈরি করে তার প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। যেমন - তাজমহলের মডেল তৈরি, কুতুবমিনারের মডেল তৈরি, হরপ্পা সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ক্ষেত্রের মডেল তৈরি ইত্যাদি। 
  

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post