নীলদর্পনে বর্নীত সমাজ চিত্র

 নীলচাষের ফলে গ্রামীন সমাজ ব্যবস্থা কিভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলো, তা জানা যায় নীলদর্পন নাটক থেকে। কর্মসূত্রে পোষ্টমাস্টারের চাকুরি করায় বাংলার বিভিন্ন গ্রামে ঘোরার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিলো দীনবন্ধু মিত্রের। এই সূত্রেই তিনি গ্রামে নীলকরদের অবর্ননীয় অত্যাচারের নানা ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছিলেন এবং সেই সত্য অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই ১৮৬০ খ্রিঃ লেখেন "নীলদর্পন" নাটক।

নীলদর্পনে বর্নীত সমাজ চিত্র
নীলদর্পনে বর্নীত সমাজ চিত্র


এই নাটকে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার যে চিত্র গুলি ফুটে উঠেছিলো, তা নিন্মলিখিত ভাবে আমরা তুলে ধরতে পারি -

(১.) বাধ্যতামূলক নীলচাষ

উনিশ শতকে গ্রামীন সমাজে কৃষকদের কাছে নীলচাষ বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছিলো। শুধু সাধারণ কৃষকরাই নয়, গ্রামের সম্ভ্রান্ত জমিদার ও সম্পন্ন চাষীদেরও বাধ্যতামূলক ভাবে নীল চাষ করতে হতো।

নীলদর্পন নাটকে দেখা যায়, স্বরপুর গ্রামের গোলকচন্দ্র বসুর মতো সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবার নীলচাষ করে একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এটি তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার একটি জীবন্ত প্রতিচ্ছবি ছিলো।

(২.) নীলকরদের অত্যাচার

গ্রাম বাংলায় নীলচাষে অসম্মত চাষীদের ধরে এনে অকথ্য অত্যাচার করা হতো। চামড়ার চাবুক "শ্যামচাঁদ" দিয়ে তাদের প্রহার করা হতো।

নীলদর্পন নাটকে গ্রামীন সমাজের ওপর নীলকরদের অত্যাচারের নানা বাস্তব চিত্র ছোট ছোট দৃশ্যে তুলে ধরা হয়েছিলো। নাটকে দেখা যায়, হরিচরনরাইচরন নামে দুই কৃষক নীল বুনতে অস্বীকার করলে তাদের ওপর নির্মম অত্যাচার করা হয়।

(৩.) নীলের দাম না পাওয়া

নীলচাষ করেও চাষীরা নীলের উপযুক্ত দাম পেতেন না। অনেক সময় নীলকুঠিতে নীল ওজনের সময় নীলকররা নানা ধরনের কারচুপি করতেন।

নাটকে দেখা যায়, নবীন মাধব নীলকরদের কথা মতো ৫০ বিঘা জমিতে নীল চাষ করলেও, তার উপযুক্ত দাম বেগুনবাড়ির নীলকররা দেয় নি। বার বার পাওনার টাকা চাইতে যাওয়ায় নবীন মাধবকে সামনের বছরের জন্য ৬০ বিঘা জমিতে নীল চাষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

(৪.) পারিবারিক নির্যাতন ও বিপর্যয়

নীলচাষ গ্রাম বাংলার পারিবারিক জীবনে নানা অশান্তিবিপর্যয় ডেকে আনে। নাটকে দেখা যায়, নীলচাষ করতে গিয়ে স্বরপুরের গোলক বসুর সুখী ও সমৃদ্ধ পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়।সাধারন কৃষকদের অবস্থাটা আরোও নিদারুণ ছিলো।

নীলচাষে অসম্মত কৃষকদের পরিবার সমেত নীলকৃঠিতে ধরে এনে নানা পারিবারিক নির্যাতন চালানো হতো। 

(৫.) মেয়েদের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন 

নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও লালসার প্রায়ই শিকার হতেন কৃষক পরিবারের মেয়েরা। নীলকুঠিতে কর্মরত কর্মচারীরা গ্রামের একটি ভালো মেয়ের সন্ধান দিতে পারলে ভালো  "পেশকাশ" পেতেন। গ্রামের মেয়েদের ওপর নীলকর সাহেবদের নানা নির্যাতন ছিলো উনিশ শতকে গ্রাম বাংলার এক বাস্তব সমাজ চিত্র। 

নীলদর্পন নাটকে দেখা যায়, সাধুচরনের মেয়ে ক্ষেত্রমনি সন্তান সম্ভবা জেনেও নীলকর রোগ সাহেব তার ওপর নানা শারীরিক নির্যাতন চালায়। এর ফলে শেষ পর্যন্ত ক্ষেত্রমনির মৃত্যু ঘটে। 

(৬.) ভালো জমিতে দাগ দেওয়া

নীলকররা প্রায়ই নীলচাষের জন্য কৃষকদের ভালো ধানি জমিতে দাগ দিতো। এজন্য কৃষকরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতো। এই নাটকে দেখা যায়, সাধুচরনরাইচরন তাদের ভালো ধানি জমিতে নীলকরদের দাগ দেওয়ার প্রতিবাদ করলে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।

(৭.) নীলকরদের প্রতিহিংসা ও নির্যাতন

নীলকর সাহেবরা নীলচাষে অসম্মত ও বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ওপর কিভাবে নির্যাতন ও প্রতিহিংসা চালাতেন, তার এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি এই নাটকে তুলে ধরা হয়।

এই নাটকে দেখা যায় - 

  • নীলচাষের বিরোধীতা করায় তোরাপ মিঞাকে বেগুনবাড়ির নীলকুঠিতে ধরে এনে বেঁধে রাখা হয়,
  •  সাধুচরনের মেয়েকে অপহরন করে অত্যাচার করা হয়, 
  • নবীন মাধবকে অপমান ও তিরস্কার করা হয়।
  • শ্যামনগরে বিদ্রোহী কৃষকদের পুরো গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। 

(৮.) আইন ও প্রশাসনের অপব্যবহার

নীলকররা স্থানীয় প্রশাসনকে নিজেদের হাতে রেখে কিভাবে আইনের অপব্যবহার করে কৃষকদের ওপর নির্যাতন চালাতেন, তার এক বাস্তব নিখুঁত ছবি নীলদর্পনে তুলে ধরা হয়।

নবীন মাধবের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে নীলকররা তার পিতা গোলকচন্দ্র বসুকে ১১ আইনে গ্রেপ্তার করে। ১৮৫৬ খ্রিঃ নীলকরদের অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেটের অধিকার দেওয়া হলে তারা কিভাবে এর অপব্যবহার করে তা নীলদর্পনে তুলে ধরা হয়।

নাটকে দেখা যায়, ১১ আইনে গোলকচন্দ্র বসুকে গ্রেপ্তার করার পর যখন আদালতে বিচার চলে, তখন পদাধিকার বলে  বেগুনবাড়ির নীলকর উড সাহেব প্রধান বিচারকের পাশে বসে পুরো মামলা নিজের স্বপক্ষে নিয়ন্ত্রন করেন।

(৯.) কৃষকদের প্রতিরোধ ও হিন্দু মুসলিম ঐক্য

নীল বিদ্রোহে হিন্দু মুসলিমরা যৌথভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। নীলদর্পন নাটকে পিরের দরগাতলায় হিন্দু মুসলিম কৃষকদের যৌথ শপথ তৎকালীন গ্রামীন সমাজের হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির দিকটি তুলে ধরে। 

(১০.) গ্রাম সমাজের চরিত্র 

নীলদর্পন নাটকটি দীনবন্ধু মিত্র চলতি গ্রাম্য কথ্য ভাষায় রচনা করেছিলেন। এই নাটক থেকে তাই তৎকালীন গ্রাম সমাজের কথ্য ভাষার রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রাম বাংলার সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনধারা, প্রবাদ প্রবচনের ব্যবহার, যৌথ পরিবার, হিন্দু মুসলমান ঐক্য, সামাজিক সদ্ভাব ও মিলন, ইত্যাদি নানা দিক গুলিরও পরিচয় পাওয়া যায়। 

তবে এসবের থেকেও নীলদর্পন নাটকে - নীলচাষের ফলে বিপর্যস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম সমাজের চিত্রায়নই বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ছিলো। এককথায় বলতে গেলে, নীলচাষ গ্রামীন জনজীবনকে কিভাবে বিধ্বস্ত করে তুলেছিল, তারই জীবন্ত সমাজদর্পন ছিল "নীলদর্পন"। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post