নীলদর্পন নাটকের মূল কাহিনী

 দীনবন্ধু মিত্রের লেখা নীলদর্পন নাটকটি ছিলো একটি "পঞ্চাঙ্কের নাটক", অর্থাৎ এই নাটকটিতে ছিলো পাঁচটি অঙ্ক। উনিশ শতকে বাংলায় নীল চাষের প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করে এই নাটক লেখা হয়। 

স্বরপুর গ্রামের গোলকচন্দ্র বসুর পরিবার নীলচাষ করতে গিয়ে এবং নীলকরদের অত্যাচারের ফলে কিভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়, সেই মর্মান্তিক কাহিনীই "নীলদর্পন" নাটকে তুলে ধরা হয়।

নীলদর্পন নাটকের মূল কাহিনী
নীলদর্পন নাটকের মূল কাহিনী 


নাটকের প্রধান চরিত্র

নীলদর্পনের মূল কাহিনী আবর্তিত হয়েছে গোলকচন্দ্র বসুর পরিবারকে কেন্দ্র করে। তাই এই নাটকের একটি প্রধান চরিত্র ছিলো - গোলকচন্দ্র বসু। 

গোলকচন্দ্র বসু স্বরপুর গ্রামের সবচেয়ে ধনী ও সম্পন্ন চাষী ছিলেন। তার দুই পুত্র ছিলো - নবীন মাধব এবং বিন্দু মাধব। তারা দুজনেই বিবাহিত ছিলেন। নবীন মাধবকে কেন্দ্র করে নীলদর্পনের কাহিনী ও যাবতীয় ঘটনাক্রম পরিচালিত হয় বলে নবীন মাধবকেই এই নাটকের অন্যতম "প্রধান নায়ক" হিসাবে তুলে ধরা যায়। 

নাটকের এই কয়টি কেন্দ্রীয় চরিত্র গুলি ছাড়াও, আরোও কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলো। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো সাধুচরনরায়চরন। এরা দুজনেই গোলকচন্দ্র বসুর অনুগত প্রতিবেশী রায়ত (কৃষক) ছিলেন। সাধুচরনের এবং তার স্ত্রী রেবতির একমাত্র সন্তান ছিলো - ক্ষেত্রমনি। ক্ষেত্রমনি ছিলো বিবাহিতা ও সন্তান সম্ভবা। 

তোরাপ মিঞা ছিলো এই নাটকের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। স্বরপুর গ্রামের কিছুটা দূরেই ছিলো বেগুনবাড়ির নীলের কুঠি।এই নীলকুঠির বড়ো নীলকর সাহেব ছিলেন - আই আই উড এবং ছোট  নীলকর সাহেব ছিলেন পি পি রোগ। তারা দুজনেই ছিলেন খুব অত্যাচারী।

নীলদর্পন নাটকে এই মূল চরিত্রগুলোর পাশে আরোও বেশ কিছু পার্শ্বচরিত্র ছিলো। যার মধ্যে অন্যতম ছিলো -

  •  নীলকুঠির দেওয়ান,
  •  আমিন, 
  • ম্যাজিস্ট্রেট, 
  • ডাক্তার,
  •  লাঠিয়াল, 
  • জেলদারগা।

যাইহোক, এবার মূল গল্পে আসা যাক।

নীলদর্পনের মূল কাহিনী

স্বরপুর ও বেগুনবাড়ির নীলকুঠি

স্বরপুর গ্রামে বাস করেন গোলকচন্দ্র বসু। অত্যন্ত দরদি ও ভালো মনের মানুষ বলে গ্রামের সকলেই তাকে অত্যন্ত সম্মান করেন। তার বড়ো ছেলে নবীন মাধব ছিলেন পরোপকারী। তাকে গ্রামের সকলে "বড়োবাবু" বলেই ডাকে।

স্বরপুর গ্রামের অদূরেই ছিলো বেগুনবাড়ির নীলের কুঠি।এই নীলকুঠির নীলকররা আশে পাশের গ্রাম গুলিতে কৃষকদের দিয়ে জোর করে নীলচাষ করাতো। কেউ নীলচাষ করতে অসম্মত হলে তাদের নীলকুঠিতে ধরে এনে চামড়ার চাবুক "শ্যামচাঁদ" দিয়ে প্রহার করতো।

নীলদর্পনে অনেক গুলি ছোট ছোট দৃশ্যে বেগুনবাড়ির নীলকুঠির ভয়াবহ অত্যাচারের ছবিকে তুলে ধরা হয়। এমনই এক দৃশ্যে দেখা যায়, হরিচরনকালিচরন নামে দুই সম্পন্ন চাষী নীলচাষ করতে অসম্মত হলে বেগুনবাড়ির লেঠেল বাহিনী তাদের জোর করে নীলকুঠিতে ধরে নিয়ে যায় এবং ভয়ঙ্কর অত্যাচার করে।

যত দিন যেতে থাকে স্বরপুর গ্রামে চাষীদের ওপর নীলকরদের অত্যাচার বাড়তেই থাকে। নবীন মাধবের পক্ষে নীলকর সাহেবদের এই অত্যাচার আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিলো না। তিনি বেগুনবাড়ির নীল কুঠিতে গিয়ে এর প্রতিবাদ করলে তাকে চরম মূল্য চোকাতে হয়। 

বেগুনবাড়ির নীলকুঠি তরফ থেকে নবীনমাধবকে আগেই ৫০ বিঘা জমিতে নীলচাষ করতে বলা হয়েছিলো। কিন্তু নবীন মাধব ৫০ বিঘা জমিতে নীলচাষ করা সত্ত্বেও, তার পাওনা  নীলকররা মিটিয়ে দেয় নি।

পাওনা টাকা চাইতে গেলে বার বার নবীন মাধবকে অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হয়। এমতাবস্থায়, নবীন মাধব প্রতিবাদী হয়ে উঠলে নীলকুঠির তরফে তার বকেয়া পাওনা না মিটিয়েই সামনের বছরের জন্য ৬০ বিঘা জমিতে নীলচাষ করতে বলা হয়। এর ফলে বসু পরিবারকে প্রায় অনাহারে কাটাতে হয়। 

এর কিছু দিন পর গোলকচন্দ্র বসুর প্রতিবেশী চাষী সাধুচরনরাইচরনের ভালো ধানি জমিতে নীলকুঠির আমিন দাগ দিতে এলে একটা প্রচন্ড ঝেমেলার সৃষ্টি হয়। সাধুচরন ও রাইচরন নীল চাষে অসম্মত হলে তাদের জোর করে নীলকুঠিতে ধরে নিয়ে এসে অত্যাচার করা হয়। নবীন মাধব এর প্রতিবাদ করলে তাকেও চূড়ান্ত ভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়। 

শ্যামনগরের ঘটনা 

ইতিমধ্যে বেগুনবাড়ির নীলকুঠির আমিন শ্যামনগরের দরগাতলার জমিতে নীলচাষের জন্য দাগ দিয়ে গেলে হিন্দু মুসলমান সকলেই প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। হিন্দু মুসলিম কৃষকরা মিলিত হয়ে বড়োবাবু নবীন মাধবের স্মরনাপন্ন হয়। তাদের নেতৃত্ব দেয় তোরাপ মিঞা। 

নবীন মাধব সকল কৃষকদের গভীর রাতে দরগাতলায় সমবেত হতে বলেন। নবীন মাধবের নির্দেশে হিন্দু মুসলিম কৃষকরা দরগাতলায় সমবেত হলে নবীন মাধব সকলকে পিরের দরগায় হাত রেখে শপথ করান যে, নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে হিন্দু মুসলমান কৃষকরা একসঙ্গে লড়াই করবে এবং কেউ কোনমতেই "দাদন" নেবে না। 

নবীন মাধবের নেতৃত্বে শ্যামনগরের কৃষকরা দাদন নিতে অস্বীকার করে বিদ্রোহী হয়ে উঠলে, তাদের ওপর চাপ দেওয়ার জন্য বেগুনবাড়ির নীলকর রোগ সাহেব পুরো গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেন। 

শ্যামনগরে আগুন লাগার ঘটনায় বেগুনবাড়ির নীলকরদের বিরুদ্ধে নবীনমাধব মামলা দায়ের করে। শুধু মামলা দায়ের নয়, নীলকরদের অত্যাচারের সংবাদ গুলি তিনি সর্বত্র প্রচার  করারও ব্যবস্থা করেন। 

ক্ষেত্রমনি অপহরন 

এদিকে বেগুনবাড়ির নীলকর রোগ সাহেবের অত্যাচার আরোও বেড়ে যায়। সাধুচরনের মেয়ে ক্ষেত্রমনিকে জোর করে নীলকুঠিতে ধরে নিয়ে আসা হয়। রোগ সাহেব ক্ষেত্রমনিকে শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করলে, রোগ সাহেবের হাত থেকে ক্ষেত্রমনিকে উদ্ধার করেন নবীন মাধব ও তোরাপ মিঞা। 

গোলকচন্দ্র বসুর গ্রেপ্তার ও মামলা

বার বার নীলকরদের কাজে নবীন মাধবের এই হস্তক্ষেপে রোগ সাহেব বিরক্ত ও অতিষ্ট হয়ে ওঠেন। শেষপর্যন্ত নবীন মাধবকে জব্দ করবার জন্য রোগ সাহেব নবীন মাধবের বৃদ্ধ পিতা গোলকচন্দ্র বসুকে ১১ আইনে গ্রেপ্তার করে। 

১১ আইনটি ১৯৬০ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার পাশ করে। এই আইনে বলা হয়েছিলো, দাদন নিয়ে কোন কৃষক যদি নীলচাষ না করে তবে তাকে - (১.)  চুক্তিভঙ্গ হিসাবে দেখা হবে এবং (২.) ফৌজদারি আইনে তার কারাদন্ড হবে। 

যাইহোক, গোলকচন্দ্র বসুকে গ্রেপ্তার করে আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হয়। 

সিপাহী বিদ্রোহের আগে ১৮৫৬ খ্রিঃ  ব্রিটিশ সরকার নীলকরদের অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেটের আধিকার প্রদান করে। এই ঘটনার প্রতিফলন নীলদর্পনে লক্ষ্য করা যায়। আদালতে যখন গোলকচন্দ্র বসুর বিচার চলে, তখন প্রধান বিচারকের পাশের আসনে বসে পুরো মামলা নিয়ন্ত্রন করেন বেগুনবাড়ির প্রধান নীলকর উড্ সাহেব। 

আদালত কক্ষে গোলকচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষি হাজির করে বিচারের নামে কার্যত প্রহসন চলে। বিচারের রায়ে গোলকচন্দ্রের ১ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। 

এই বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে নবীন মাধব উচ্চতর আপিলের জন্য চেষ্টা চালান। এর ফলে শেষপর্যন্ত বিনা শর্তে গোলকচন্দ্র ছাড়া পাওয়ার নির্দেশ পান। কিন্তু জেলের মধ্যে অত্যাচার আর অপমানের জ্বালায় গোলকচন্দ্র বসু গলায় দড়ি লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন।  

উড্ সাহেবের প্রতিশোধ 

এদিকে উড্ সাহেবকে শ্যমনগরের ঘর পোড়ানোর মামলায় আসামী করা হলে ক্রুদ্ধ উড্ সাহেব নবীন মাধবের ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। 

গোলকচন্দ্র বসুর শ্রাদ্ধের দিন নবীন মাধবের পুকুর পাড়ের জমিতে উড সাহেব নীলচাষের জন্য দাগ দিতে গেলে, সেখানে তোরাপ মিঞা ও নবীন মাধবের সঙ্গে উড্ সাহেবের বচশা ও হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। 

এই খন্ডযুদ্ধে নবীন মাধব গুরুতর ভাবে আহত হন। উড্ সাহেবের গুলিতে তোরাপ মিঞার মৃত্যু ঘটে। এদিকে উড্ সাহেবের শারীরিক নির্যাতনের ফলে অন্তঃসত্ত্বা ক্ষেত্রমনিরও মৃত্যু ঘটে। 

নাটকের অন্তিম দৃশ্য - ট্র্যাজেডি

নীলদর্পন নাটকের শেষাংশ পর পর বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ট্র্যাজেডির দৃশ্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। ক্ষেত্রমনি ও তোরাপ মিঞার মৃত্যুর পরে নীলকর সাহেবের আক্রমণে গুরুতর আহত নবীন মাধবেরও মৃত্যু ঘটে। এর ফলে শুধু বসু পরিবারেই নয়, সারা স্বরপুর গ্রামেও শোকের ছায়া নেমে আসে। কান্না, দুঃখ আর স্বজন হারানোর বুকফাটা বেদনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় নীলদর্পন। 


 ("ইতিহাস পাঠের প্রয়োজন ও পর্যালোচনার তাগিদেই নীলদর্পনের এই গল্প বলা। সুতরাং পাঠকদের কাছে অনুরোধ, একে সাহিত্যের গুনাগুন বা দৃষ্টিভঙ্গিতে মাপবেন না। সংক্ষিপ্ত আকারে গল্প বলার সুবিধার্থে নাটকের যে কটি চরিত্রের উল্লেখ করা প্রয়োজন, সে টুকুই করেছি মাত্র । এর বাইরেও নাটকে অসংখ্য চরিত্র আছে"। - লেখক।)

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post