দেওয়ানী লাভ ও তার গুরুত্ব

 আধুনিক ভারতের ইতিহাসে ইংরেজ কোম্পানির  আধিপত্য স্থাপনের ক্ষেত্রে যে ঘটনাটি সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো, সেটি হলো "দেওয়ানী লাভ"।

দেওয়ানী লাভ ও তার গুরুত্ব
দেওয়ানী লাভ ও তার গুরুত্ব 

 দেওয়ানীর অর্থ ও ধারনা 

"দেওয়ানী" ছিলো একটি অর্থনৈতিক ক্ষমতা। মুঘল আমলে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিটি সুবা বা প্রদেশের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতাকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলো -

  1. নিজামতী
  2. দেওয়ানী
(১.) নিজামতী - নিজামতী বলতে প্রদেশের সাধারণ শাসন পরিচালনা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, সামরিক, পুলিশ ও ফৌজদারি অপরাধের বিচারের দায়িত্ব ও ক্ষমতাকেই বোঝায়।

সাধারনত, সুবা বা প্রদেশের প্রধান শাসকের হাতে নিজামতীর ক্ষমতা থাকতো। 

(২.) দেওয়ানী - প্রদেশের রাজস্ব আদায় ও জমি জায়গা সম্পর্কিত মামলার বা বিচারের ক্ষমতা এবং দায়িত্বকেই এককথায় "দেওয়ানী" বলা হতো।

দেওয়ানীর ক্ষমতা যার হাতে থাকতো তাকে "দেওয়ান" বলা হতো। অন্যদিকে নিজামতীর অধিকারী ব্যক্তি সুবাদার, প্রদেশপাল,নবাব ইত্যাদি নামেই পরিচিত ছিলেন। 

 নিজামতী এবং দেওয়ানী ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিরা মুঘল সম্রাট কর্তৃক পৃথক পৃথক ভাবে প্রদেশের কাজের জন্য নিযুক্ত হতেন। দুজনেই তাদের কাজের জন্য মুঘল সম্রাটের কাছে আলাদা আলাদা ভাবে দায়বদ্ধ থাকতেন। 

সুবাদারেরা যাতে আর্থিক ক্ষমতা লাভ করে প্রদেশে স্বৈরাচারী হয়ে মুঘল সম্রাটকে চ্যালেঞ্জ জানাতে না পারে সেই জন্যই প্রদেশে শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতাকে দুভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিলো। 

১৭৬৫ খ্রিঃ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা প্রদেশের এই দেওয়ানীর ক্ষমতাই লাভ করেছিলো। অর্থাৎ মুঘল সম্রাটের পক্ষ থেকে আইনগত ভাবে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলাদেশের "দেওয়ান" নিযুক্ত করা হয়। 

দেওয়ানী লাভের প্রেক্ষাপট 

দেওয়ানী লাভের প্রেক্ষাপট রচনার ক্ষেত্রে ১৭৬৪ খ্রিঃ বক্সারের যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। 

বাংলার ক্ষমতাচ্যুত নবাব মিরকাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সম্মিলিত বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বক্সারের যুদ্ধ হয়েছিলো। 

এই যুদ্ধে ইংরেজ কোম্পানির কাছে নবাব বাহিনী পরাজিত হয় এবং "এলাহাবাদের সন্ধি" সাক্ষর করতে বাধ্য হয়। 

এলাহাবাদের সন্ধি - ১৭৬৫ 

বক্সারের যুদ্ধের পর ইংরেজ কোম্পানি দুটি এলাহাবাদের সন্ধি স্বাক্ষর করেছিলো। দুটি সন্ধিই ১৭৬৫ খ্রিঃ স্বাক্ষরিত হয়। 

(ক.) এলাহাবাদের প্রথম সন্ধি 

এলাহাবাদের প্রথম সন্ধি অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। 

এই সন্ধিতে - 
  • অযোধ্যার নবাব যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ইংরেজদের ৫০ লক্ষ টাকা এবং
  •  কারাএলাহাবাদ প্রদেশ দুটি ছেড়ে দেন। 
  • বিনিময়ে কোম্পানির সঙ্গে অযোধ্যার মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং 
  • ইংরেজ কোম্পানি অযোধ্যাকে বৈদেশিক আক্রমণ থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। 
(খ.) এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধি

অযোধ্যার নবাবের সাথে সন্ধি স্বাক্ষরিত করবার পর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধি স্বাক্ষর করে। 

এই সন্ধি দ্বারা - 
  • ইংরেজ কোম্পানি মুঘল সম্রাটকে কারাএলাহাবাদ প্রদেশ দুটি উপহার দেন, 
  • ইংরেজরা ভারতে মুঘল সম্রাটের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেন, 
  • বিনিময়ে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা কর দানের বিনিময়ে মুঘল সম্রাট বাংলা, বিহার, ঊড়িষ্যার দেওয়ানীর অধিকার কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেন। 
এইভাবে এলাহাবাদের সন্ধি দ্বারা ইংরেজ কোম্পানি বাংলাদেশের দেওয়ানীর ক্ষমতা লাভ করে। দেওয়ানীর ক্ষমতা লাভ করার ফলে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ৩ টি অধিকার লাভ করে - 
  1. তারা বাংলা সুবা থেকে ভূমিরাজস্ব আদায় করার অধিকার লাভ করে। 
  2. দেওয়ানী দপ্তরে লোক বা কর্মচারী নিয়োগ করবার অধিকার পায়। এবং 
  3. দেওয়ানী বিচারের অর্থাৎ জমি জায়গা সম্পর্কিত বিরোধের বিচারের দায়িত্ব লাভ করে। 

মিরকাশিমের কি হলো? 

দেওয়ানী লাভের পর বাংলার ক্ষমতাচ্যুত নবাব মিরকাশিমের কি হয়েছিলো তা জানতে অনেকেই উৎসাহ প্রকাশ করেন। কিন্তু অধিকাংশ ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে মিরকাশিমের অন্তিম পরিনতি বিষয়ে তেমন করে কিছু লেখা নেই। 

বক্সারের যুদ্ধের পর মিরকাশিমের অবস্থা খুবই খারাপ হয়। বাংলা প্রবাদ - "আমে দুধে মিশে যাওয়ার পর আঁটি যেভাবে গড়গড়ায়" মিরকাশিমের অন্তিম পরিনতি তাই হয়েছিলো। সুচতুর ইংরেজরা মুঘল বাদশাহ ও অযোধ্যার নবাবের সাথে মিত্রতা করায়, মিরকাশিম মাঝখান থেকে ফেলা গেলেন।

 ইংরেজদের সাথে মিত্রতা স্থাপিত হওয়ার পর অযোধ্যার নবাব মিরকাশিমের সমস্ত ধনসম্পদ আত্মসাৎ করে তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। অতি দারিদ্রতা ও রোগভোগের কারনে দিল্লিতে ১৭৭৭ খ্রিঃ মিরকাশিমের মৃত্যু হয়। 

কোম্পানি কেন দেওয়ানীর ক্ষমতা গ্রহণ করে? 

কোম্পানির দেওয়ানী লাভ সংক্রান্ত আলোচনায় ২ টি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে। এগুলি হলো - 
  1. বক্সারের যুদ্ধের পর চাইলেই ইংরেজরা বাংলার ক্ষমতা দখল করে নিতে পারতো। কিন্তু তা না করে কোম্পানি কেন শুধুমাত্র বাংলার দেওয়ানীর ক্ষমতা গ্রহণ করলো? এবং 
  2. মুঘল সম্রাটকে বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত করবার পরেও কেন ইংরেজ কোম্পানি দিল্লির ক্ষমতা দখল করলো না? এর পিছনে মূল কারণ কি ছিলো? 
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, বক্সারের যুদ্ধের পর কোম্পানি চাইলেই সম্পূর্ণ ভাবে বাংলা বা দিল্লির ক্ষমতা দখল করে নিতে পারতো। কিন্তু কোম্পানি তা করে নি। আসলে এর পিছনে অনেক গুলি কারন ছিলো - 
  • কোম্পানি তখনও নিজেকে একটি বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসাবেই ভাবতো। শাসন ক্ষমতা গ্রহণের ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ ছিলো না। 
  • ভারতে ইংরেজ কোম্পানির অবাধ বানিজ্যের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবার জন্য নিজেদের সহায়ক রাজনৈতিক পরিমন্ডল রচনা করাই ছিলো ইংরেজ কোম্পানির মূল উদ্দেশ্য। 
  • তাছাড়া সবচেয়ে বড়ো কথা, রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ করে তা পরিচালনা করবার মতো কোম্পানির কাছে পর্যাপ্ত লোকবলেরও যথেষ্ট অভাব ছিলো। 
এই সমস্ত কারনে সুযোগ এসে যাওয়া সত্ত্বেও, ইংরেজ কোম্পানি বাংলা বা দিল্লি কোন ক্ষেত্রেই সরাসরি শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে নি। আসলে বিচক্ষন, দূরদর্শী ইংরেজরা ভালো করেই জানতো, কোন কিছু গ্রহণ করতে হলে আগে নিজেকে তার যোগ্য করে তুলতে হয়। 

যাইহোক, এবার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে আসি। কেন কোম্পানি দেওয়ানীর ক্ষমতা গ্রহণ করতে চেয়েছিলো। আসলে একাধিক উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনকে সামনে রেখেই কোম্পানি বাংলার দেওয়ানীর ক্ষমতা গ্রহণ করে। এগুলি হল - 
  • মিরকাশিমের সঙ্গে অনেকবার যুদ্ধ করতে গিয়ে কোম্পানির প্রচুর অর্থ খরচ হয়। ১৭৬৩ খ্রিঃ মিরকাশিমের সঙ্গে কোম্পানির কাটোয়া, গিরিয়াউদয়নালার যুদ্ধ হয়। এরপর ১৭৬৪ খ্রিঃ কোম্পানি মিরকাশিমের সঙ্গে বক্সারের যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধ গুলিতে কোম্পানির যে বিপুল অর্থ খরচ হয়, তার সমাধানের একমাত্র পথ ছিলো বাংলার দেওয়ানীর ক্ষমতা গ্রহণ। 
  • দ্বিতীয় কারনটি ছিলো ভারতের বানিজ্যে কোম্পানির ইনভেস্টমেন্টের সমস্যা দূর করা এবং ইংল্যান্ডের "বুলিয়ান" অর্থাৎ  ভারতে সোনা আমদানি বন্ধ করা।কোম্পানি ভারতীয় রাজস্বের টাকাতেই ভারতের জিনিস কিনে মুক্ত ও অবাধ বানিজ্যের পরিকল্পনা করেছিলো। 
দুর্ভাগ্যক্রমে ইংরেজদের সমস্ত পরিকল্পনা সফল হয়। এবং ভারতের টাকায় ভারতের পন্য কিনে ইংল্যান্ডের বাজারে ব্যবসা করবার ফলে ভারতীয় অর্থনীতিতে রক্তশূন্যতা দেখা যায়, এবং সম্পদের বহির্গমন ঘটতে থাকে। 

দেওয়ানী লাভের পর বাংলার পরিস্থিতি 

১৭৬৩ খ্রিঃ মিরকাশিমকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইংরেজরা মিরজাফরকে বাংলার মসনদে বসিয়েছিলো।কিন্তু দেওয়ানী লাভের আগে কুষ্ঠরোগে মিরজাফরের মৃত্যু ঘটলে ইংরেজরা তার নাবালক পুত্র নজমউদ্দৌলাকে বাংলার মসনদে বসায়।

এই সময় নজমউদ্দৌলা এক গোপন চুক্তি দ্বারা যাবতীয় শাসন ক্ষমতা কোম্পানি নিযুক্ত সুবাদার রেজা খানের হাতে ছেড়ে দেন। 

দেওয়ানী লাভের পর কোম্পানি দেওয়ানীর ক্ষমতা সরাসরি নিজের হাতে না নিয়ে বাংলায় রেজা খাঁ এবং বিহারে সিতাব রায়কে নিযুক্ত করেন। এই দুজন ব্যক্তি ইংরেজ কোম্পানির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপে বাংলার কৃষকদের ওপর তীব্র শোষন চালিয়ে বিপুল ভাবে রাজস্ব আদায় করতে থাকেন। 

দেওয়ানী লাভের গুরুত্ব

আধুনিক ভারতের ইতিহাসে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানী লাভের গুরুত্ব ছিলো অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। বাংলার দেওয়ানী লাভ "ইংল্যান্ড এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির" কাছে "পৌষমাসের" সমতুল্য হলেও, এটি বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে একাধিক ভয়ানক "সর্বনাশ"ডেকে এনেছিল। 

দেওয়ানী লাভের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করতে হলে ৩ টি মূল দিকের পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। যেমন - 
  1. ইংল্যান্ড ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিভাবে দেওয়ানীর প্রাপ্তি থেকে লাভবান হয়েছিলো, 
  2. ইংরেজ কোম্পানির দেওয়ানী লাভের ফলে বাংলার ইতিহাসে কি প্রভাব পড়েছিলো, এবং 
  3. বাংলার দেওয়ানী লাভের ঘটনার সঙ্গে অবশিষ্ট ভারতের কি সম্পর্ক ছিলো, 

ইংল্যান্ড ও ইংরেজ কোম্পানির ওপর প্রভাব 

বাংলার দেওয়ানী লাভ থেকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক,এই দুটি দিক থেকে লাভবান হয়। যেমন - 

(ক.) রাজনৈতিক লাভ

(১.) আধিপত্যের আইনসঙ্গত স্বীকৃতি লাভ

 বক্সারের যুদ্ধের পর ১৭৬৫ খ্রিঃ মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে আইনত দেওয়ানীর দায়িত্ব লাভের ফলে ইংরেজ কোম্পানি ভারতের শাসন ব্যবস্থার একটি অংশ বা পার্টে পরিনত হয়। এই ঘটনার ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছিলো ৩ টি - 
  1. এর ফলে বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির আধিপত্যের একটি আইনসঙ্গত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। 
  2. পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলায় ইংরেজদের যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, তা বৈধতা লাভ করে। 
  3. দেওয়ানী লাভ করার পর বাংলায় ইংরেজ আধিপত্যকে নসাৎ করা আর কারো পক্ষেই সম্ভব ছিলো না। 
  4. বাংলায় নবাবের পক্ষ থেকে ইংরেজ বিরোধীতার সকল সম্ভবনা দূর হয়। 
  5. অন্যান্য বিদেশী বনিকগোষ্ঠীদের চাইতে বাংলা তথা ভারতে ইংরেজদের কর্তৃত্ব ও মর্যাদা বহুগুন বৃদ্ধি পায় 
  6. এই ঘটনায় বোঝা যায়, কোম্পানি এখুনি বা খুব সহজে ভারত ত্যাগ করবে না। 

(২.) অবশিষ্ট ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার 

বাংলার ভূমি ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে সবথেকে বেশি উর্বর ছিলো। তাই এর ভূমিরাজস্বের আয়ও ছিলো অনেক বেশি। এই কারনেই বক্সারের যুদ্ধের পর ভারতের অন্য কোন অঞ্চলের দেওয়ানীর অধিকার না নিয়ে ইংরেজরা বাংলার দেওয়ানীকেই বেছে নিয়েছিলো। 

বাংলার জমি উর্বর থাকায় দুগ্ধবতী গাভীর মতো অনায়াসে নির্মম ভাবে বাংলাকে দ্বিগুন, চর্তুগুন এবং বহুগুন ভাবে  দোহন করা সম্ভব হয়। বাংলার দেওয়ানীর লুন্ঠিত অর্থের একটা বড়ো অংশ ইংরেজরা এদেশে নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজে লাগায়। 

উদাহরন হিসাবে বলা যায়, বাংলার দেওয়ানীর বিপুল অর্থের সাহায্য ছাড়া প্রথম দিককার নড়বড়ে ইংরেজ কোম্পানির পক্ষে কখনই দক্ষিণ ভারতে, বিশেষত মারাঠা বা মহীশূর রাজ্যে আধিপত্য বিস্তার করা সম্ভব ছিলো না। 

(খ.) অর্থনৈতিক লাভ

দেওয়ানী লাভের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একাধিক দিক থেকে ইংরেজ কোম্পানি লাভবান হয় - 
  1. মিরকাশিমের সঙ্গে পরপর বেশ কয়েকটি যুদ্ধে, (কাটোয়া, গিরিয়া, উদয়নালা ও বক্সার) ইংরেজ কোম্পানির যে বিপুল অর্থ ক্ষতি হয়, দেওয়ানী লাভ থেকে সেই ঘাটতি অনেকটাই পূরন হয়। 
  2. দেওয়ানী লাভের ফলে ভারতীয় বানিজ্যে কোম্পানির ইনভেস্টমেন্টের চিন্তা দূর হয়। 
  3. বাংলার দেওয়ানীর অর্থকে ইংরেজ কোম্পানি বানিজ্য পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করে। 
  4. ভারতে বানিজ্যের জন্য ইংল্যান্ড থেকে বুলিয়ন বা সোনা আমদানি বন্ধ হয় এবং  বাংলার রাজস্বের অর্থ থেকেই ভারতীয় পণ্য কেনা হতে থাকে। 
  5. দেওয়ানী লাভের ফলে বাংলায় ইংরেজদের শুল্কহীন অবাধ বানিজ্যের সুযোগ ও পরিবেশ বহুগুন বৃদ্ধি পায়। 
(গ.) ইংল্যান্ডের লাভ 

বাংলার দেওয়ানী লাভের ফলে শুধু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নয়, ইংল্যান্ডও বিপুলভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভবান হয়। দেওয়ানীর অর্থ ইংল্যান্ডের শিল্প পুঁজির কাজে লাগে। 

অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের উড্ডয়নকাল ছিলো ১৭৬০ থেকে ১৭৮০ খ্রিঃ পর্যন্ত। আর কোম্পানি দেওয়ানী লাভ করে ১৭৬৫ খ্রিঃ। সুতরাং ইংল্যান্ডে শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে বাংলার দেওয়ানীর অর্থ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো, তাকে কোনমতেই অস্বীকার করা যায় না। 

বাংলার ওপর দেওয়ানী লাভের প্রভাব

১৭৬৫ খ্রিঃ ইংরেজ কোম্পানির দেওয়ানী লাভের ঘটনায় বাংলার ইতিহাসে একাধিক কুফল লক্ষ্য করা যায় - 

(১.) এতদিন "দেওয়ান" হিসাবে মুঘল প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা হলেও, এই প্রথম একটি বিদেশী কোম্পানী বা সংস্থাকে "বাংলার দেওয়ান" নিযুক্ত করা হয়।

 এর ফলে - 
  1.  সুবে বাংলার রাজকোষ পুরোপুরি ইংরেজ কোম্পানির হাতে চলে আসে।
  2.  বাংলায় তীব্র আর্থিক শোষন আরম্ভ হয়। 
  3. বিদেশী কোম্পানীর সঙ্গে কৃষি ও কৃষকদের কোন আত্মিক বন্ধন না থাকায়, কৃষকদের প্রতি কোম্পানির কোনরকম সহানুভূতিও ছিলো না। ফলে কৃষকদের ওপর অত্যাচার,পীড়ন ও শোষন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। 
  4. আলিবর্দি খাঁর আমলে পুর্নিয়া থেকে বছরে রাজস্ব আদায় করা হতো ৪ লক্ষ টাকা। দেওয়ানী লাভের পর তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ লক্ষ। কমবেশি সব জায়গাতেই এই ভাবে বিপুল রাজস্ব আদায়ের ফলে বাংলার কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। 
  5. তীব্র আর্থিক শোষনে ১৭৭০ খ্রিঃ বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ঘটে, যেখানে সমগ্র বাংলাদেশের তিনভাগের এক ভাগ লোক না খেতে পেয়ে মারা যায়। 
  6. বাংলার বনিক, কারিগর ও শিল্পীদের দুর্দশা বহুগুন বৃদ্ধি পায়। 
  7. ১৭৬৫ থেকে ১৭৭২ খ্রিঃ পর্যন্ত বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা চলে।
  8. আর্থিক ও সামরিক ক্ষমতা না থাকায় বাংলার নবাব নামমাত্র প্রশাসনিক প্রধানে পরিনত হন। নবাবের হাতে থাকে "ক্ষমতাহীন দায়িত্ব" আর কোম্পানির হাতে থাকে "দায়িত্বহীন ক্ষমতা"। 

অবশিষ্ট ভারতের ওপর দেওয়ানী লাভের প্রভাব 

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার দেওয়ানী লাভের ঘটনাটি অবশিষ্ট ভারতের ওপরেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিলো। যেমন - 
  1. বাংলার দেওয়ানী লাভের মধ্য দিয়ে ভারতের অর্থ ক্রমাগত ইংল্যান্ডে পাচার হতে থাকে। ফলে ভারতে সম্পদের বহির্গমন ঘটতে থাকে। 
  2. ভারত দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে থাকে।
  3.  দেওয়ানীর অর্থের একটা অংশ ইংল্যান্ড শিল্প বিপ্লবে পুঁজি হিসাবে কাজে লাগায়। এর ফলে ইংল্যান্ডে দ্রুত শিল্পায়ন ঘটে। এর ফলে ভারতে ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদের ফাঁস আরোও শক্ত হয়। 
  4. ব্রিটিশ শিল্পপন্যের দাপটে ভারতের কুটির শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। দেশে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যতা বৃদ্ধি পায় এবং এসবের ফলে ভারত একটি গরিব দেশে পরিনত হয়। 
  5. বাংলার দেওয়ানীর অর্থ সাহায্যেই দক্ষিণ ভারতে মারাঠা, মহীশূর রাজ্যের মতো বৃহৎ রাজ্য গুলির ওপর ইংরেজরা তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। 

মূল্যায়ন 

উপরে উল্লেখিত দেওয়ানীর এত ব্যপক ও সুগভীর প্রভাবের কারনেই ইংরেজ কোম্পানির বাংলার দেওয়ানীর লাভের ঘটনাটিকে ঐতিহাসিকরা ভারতের ইতিহাসের একটি কেন্দ্রীয় ঘটনা বলেই মনে করে থাকেন।

 ১৭৬৫ খ্রিঃ মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলার দেওয়ানী লাভ তাই তাৎক্ষণিক কোন ঘটনামাত্র ছিলো না। এর ঐতিহাসিক প্রভাব ছিলো সুদূরপ্রসারী। ইংল্যান্ড, ভারত ও সমগ্র বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপ্রকৃতিকে দেওয়ানী লাভের ঘটনা ব্যপক ভাবে প্রভাবিত করেছিলো। এর সবথেকে বড়ো ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখানেই।

দেওয়ানী সংক্রান্ত কিছু স্মরণীয় তথ্য 

  • মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ খ্রিঃ এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধি অনুযায়ী দেওয়ানীর ক্ষমতা লাভ করে। 
  • দেওয়ানী লাভের সময় বাংলার নবাব ছিলেন মিরজাফরের পুত্র নজমউদ্দৌলা। 
  • ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে লর্ড ক্লাইভ দেওয়ানীর ক্ষমতা গ্রহণ করেন। 
  • দেওয়ানী লাভের ফলে ১৭৬৫ - ১৭৭২ পর্যন্ত বাংলায় দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা চলে। 
  • দেওয়ানী লাভের পর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রেজা খাঁ ও সিতাব রায়কে দেওয়ান নিযুক্ত করে। 
  • ১৭৭২ খ্রিঃ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোম্পানির পরিচালক সভার নির্দেশে সরাসরি দেওয়ানীর ক্ষমতা গ্রহণ করে। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post