ভারতে ইংরেজদের আধিপত্য স্থাপনের ক্ষেত্রে যে দুটি যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো, তার একটি ছিলো পলাশীর যুদ্ধ। অপরটি ছিলো বক্সারের যুদ্ধ।
|
পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের মধ্যে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ?
|
ঐতিহাসিকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই এই বিতর্কটি চলে আসছে যে, পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের মধ্যে কোনটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হলে দুটি যুদ্ধেরই ফলাফলের তুলনামূলক আলোচনা করা প্রয়োজন।
তবে তুলনামূলক আলোচনায় আসবার আগে সবার প্রথমে দুটি যুদ্ধের মূল ফলাফল কি হয়েছিলো, সেটি পৃথক ভাবে আলোচনা করা আবশ্যক। কেননা দুটি যুদ্ধের মূল ফলাফল সম্পর্কে ধারনা লাভ করবার পরেই আমরা সঠিক ভাবে দুটি যুদ্ধের তুলনামূলক আলোচনা করতে পারবো।
পলাশীর যুদ্ধ
১৮৫৭ খ্রিঃ ২৩ জুন, বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লা ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো।
পলাশীর যুদ্ধের মূল ফলাফল
পলাশীর যুদ্ধ একটি পূর্ব পরিকল্পিত যুদ্ধ ছিলো। যুদ্ধের ফলাফলের অনেকটা তাই আগে থেকেই ঠিক করে রাখা ছিলো।
এই যুদ্ধে -
- সিরাজদৌল্লা পরাজিত হন এবং ইংরেজ কোম্পানি জয় লাভ করে।
- আগে থেকে ঠিক করে রাখা চুক্তি অনুযায়ী বাংলার নবাবের বদল ঘটে। সিরাজদৌল্লার জায়গায় তার প্রধান সেনাপতি মীরজাফর বাংলার নবাব হন।
- ইংরেজ কোম্পানি,তার আধিকারিক ও কর্মচারীরা যুদ্ধের পর বিপুল পরিমানে অর্থ লাভ করেন।
- কোম্পানি বাংলায় বিনাশুল্কে বানিজ্য করার এবং চব্বিশ পরগনার জমিদারি সত্ত্ব লাভ করে।
- পলাশীর যুদ্ধের পর নবাবের ওপর চাপ সৃষ্টি করে কোম্পানির আধিকারিকরা বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করতে থাকেন, যেটাকে ঐতিহাসিকরা "পলাশীর লুন্ঠন" বলে অভিহিত করেন।
- নবাবের ওপর আর্থিক চাপ ও তার কাজকর্মে হস্তক্ষেপের ফলে বাংলার নবাবের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়।
- বাংলার মানুষদের ওপর ইংরেজদের জুলুম ও অত্যাচার অনেকখানি বেড়ে যায়।
- বাংলার নবাবের পরিনতি অন্যান্য দেশীয় রাজা ও নবাবদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
বক্সারের যুদ্ধ
পলাশীর যুদ্ধের ৭ বছর পর ১৭৬৪ খ্রিঃ বক্সারের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে পলাশীর যুদ্ধের আর বক্সারের যুদ্ধের তারিখ একই ছিলো। পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিলো ২৩ জুন, আর বক্সারের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৩ অক্টোবর।
বক্সারের যুদ্ধ হয়েছিলো বাংলার নবাব মিরকাশিম, আযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌল্লা এবং মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সম্মিলিত শক্তি জোটের সঙ্গে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে।
বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল
বক্সারের যুদ্ধ পলাশীর যুদ্ধের মতো কোন পূর্ব পরিকল্পিত যুদ্ধ ছিলো না। এটি ছিলো সত্যিকারের যুদ্ধ। তাই এর ফলাফলের তাৎপর্য ও গুরুত্ব পলাশীর যুদ্ধ থেকে অনেক বেশি ছিলো।
বক্সারের যুদ্ধে -
- ইংরেজ কোম্পানি জয়লাভ করে এবং নবাব পক্ষ পরাজিত হয়।
- বক্সারের যুদ্ধের পর মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে কোম্পানি বাংলাদেশের "দেওয়ানী" অর্থাৎ রাজস্ব আদায় করবার প্রশাসনিক অধিকার লাভ করে।
- দেওয়ানীর বিপুল অর্থ পরবর্তীকালে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজে বিনিয়োগ করা হয়
- বাংলার মসনদে মিরকাশিমকে সরিয়ে পুনরায় তার শ্বশুরমশাই মিরজাফরকে বসানো হয়।
- বাংলার নবাবের পক্ষে ইংরেজ বিরোধিতার সকল আশঙ্কা দূর হয়।
- দেওয়ানী লাভ করবার পর ইংরেজরা বাংলায় তীব্র আর্থিক শোষন চালাতে থাকে।
- তীব্র আর্থিক শোষনে বাংলায় "ছিয়াত্তরের মন্বন্তর"ঘটে।
তুলনামূলক আলোচনা
পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের প্রকৃতি, ফলাফল ও গুরুত্বের দিক গুলির তুলনামূলক আলোচনা করলে পার্থক্যের যে মূল দিকগুলি উঠে আসে তা হলো -
(১.) যুদ্ধের চরিত্র
যুদ্ধের প্রকৃতির বিচারে পলাশীর যুদ্ধকে কখনই প্রকৃত "যুদ্ধ" বলা চলে না। কারন এই যুদ্ধ পূর্ব পরিকল্পিত ছিলো। এটি ছিলো একটি "খন্ডযুদ্ধ" , "হাতাহাতির যুদ্ধ" , "সাজানো যুদ্ধ" ।
কিন্তু বক্সারের যুদ্ধ ছিলো সত্যিকারের প্রকৃত যুদ্ধ। তাই এর গুরুত্ব পলাশীর যুদ্ধ থেকে অনেক বেশি ছিলো।
(২.) কোম্পানির শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিষ্ঠা
পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ কোম্পানির সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের কোন প্রমান পাওয়া যায় নি। সেটা ছিলো সম্পূর্নই এক সাজানো ও পূর্ব পরিকল্পিত যুদ্ধ। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে মাত্র ৭,০০০ ইংরেজ সেনা যেভাবে নবাব পক্ষের ৬০, ০০০ সেনাকে পরাজিত করেছিলো, তাতে নিঃসন্দেহে ভারতে ইংরেজ কোম্পানির সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলো।
পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পরিনতি দেখে যেখানে অন্যান্য ভারতীয় রাজন্যবর্গ আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলো, সেখানে বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব দেখে অনেকেই তাদের প্রতি আকর্ষিত হন। এর ফলে ভারতীয় রাজন্য মহলে ইংরেজদের মর্যাদা ও সম্মান বহুগুন বৃদ্ধি পায়।
তাছাড়া, বক্সারের যুদ্ধের পর অযোধ্যার নবাব, বাংলার নবাব এমনকি মুঘল সম্রাটের ভাগ্য যেভাবে ইংরেজদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলো, তা কখনই পলাশীর যুদ্ধে দেখা যায় নি। এইসব ঘটনাই ভারতে ইংরেজ শক্তির শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলো।
(৩.) পলাশীর সাফল্য বক্সারের ওপর নির্ভরশীল ছিলো
পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজ কোম্পানি বাংলায় বিনাশুল্কে অবাধ বানিজ্য সহ একাধিক জমিদারি সত্ত্ব লাভ করেছিলো। কিন্তু এই সুফলের স্থায়িত্ব সম্পূর্ণ ভাবেই বক্সারের যুদ্ধের সাফল্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলো।
যদি বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজ কোম্পানি নবাব বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে যেতো, তাহলে পলাশীর যুদ্ধের ফলে বাংলায় ইংরেজদের যেটুকু আধিপত্য স্থাপিত হয়েছিলো তাও ধুলিসাৎ হয়ে যেতো। এই কারনে ইতিহাস পর্যালোচনায় পলাশীর যুদ্ধ থেকে বক্সারের যুদ্ধকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
(৪.) স্বাধীন নবাবীর অবসান
পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলায় নবাব বদল হয়েছিলো মাত্র। কিন্তু স্বাধীন নবাবী আমলের অবসান ঘটে নি। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধের পর বাংলার নবাব সম্পূর্ণ ভাবে কোম্পানির অধীন হয়ে পড়েন।
বক্সারের যুদ্ধের পর ইংরেজরা পুনরায় মিরজাফরকে বাংলার নবাব করে। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যে কুষ্ঠরোগে মিরজাফরের মৃত্যু হলে তার নাবালক পুত্র নজমউদ্দৌলাকে মসনদে বসানো হয়। নজমউদ্দৌলা একটি চুক্তি দ্বারা সব ক্ষমতা কোম্পানি মনোনীত নায়েব সুবাদারের হাতে ছেড়ে দেন।
ফলে পলাশীর যুদ্ধের পর যেখানে শুধুই নবাবের বদল ঘটেছিলো, বক্সারের যুদ্ধের পর সেখানে সার্বভৌম নবাবী আমলেরই অবসান ঘটে।
সুতরাং বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির আধিপত্য স্থাপনের ক্ষেত্রে পলাশীর যুদ্ধ থেকে বক্সারের যুদ্ধ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।
(৫.) দেশীয় রাজাদের দুর্বলতা
পলাশীর যুদ্ধ নিঃসন্দেহে একটি প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক যুদ্ধ ছিলো। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধ ছিলো দেশীয় রাজাদের সম্মিলিত শক্তি জোটের লড়াই। এই যুদ্ধে সম্মিলিত নবাব বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ইংরেজদের সামনে দেশীয় রাজাদের দুর্বলতাকে প্রকট করে তুলেছিলো।
বক্সারের যুদ্ধের ফলে বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির প্রত্যক্ষ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অযোধ্যায় পরোক্ষ আধিপত্য স্থাপিত হয়। এছাড়া, এই যুদ্ধের পর মুঘল সম্রাট কোম্পানির বৃত্তিভোগীতে পরিনত হন।
দেশীয় রাজন্যবর্গের এমন ভাগ্য বিপর্যয় পলাশীর যুদ্ধ তো দূরে থাক, এর আগে কোন যুদ্ধেই এত ব্যাপকভাবে দেখা যায় নি।
(৬.) শাসন ক্ষমতার আইনগত অধিকার লাভ
বক্সারের যুদ্ধের পর ১৭৬৫ খ্রিঃ মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে ইংরেজ কোম্পানি বাংলাদেশের দেওয়ানী অর্থাৎ রাজস্ব আদায় করার প্রশাসনিক দায়িত্ব লাভ করে। এর ফলে ইংরেজ কোম্পানি ভারতের শাসন ব্যবস্থার একটি অংশ বা পার্টে পরিনত হয়। এই ঘটনার ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছিলো ৩ টি -
- এর ফলে বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির আধিপত্যের একটি আইনসঙ্গত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
- পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলায় ইংরেজদের যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, তা বৈধতা লাভ করে।
- দেওয়ানী লাভ করার পর বাংলায় ইংরেজ আধিপত্যকে নসাৎ করা আর কারো পক্ষেই সম্ভব ছিলো না।
- এই ঘটনায় বোঝা যায়, কোম্পানি এখুনি বা খুব সহজে ভারত ত্যাগ করবে না।
ফলে বক্সারের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্যের যে "নীল নকশা" প্রতিভাত হয়েছিলো, তা পলাশীর যুদ্ধে লক্ষ্য করা যায় নি। এই কারনে ইতিহাস পর্যালোচনায় পলাশীর যুদ্ধ থেকে বক্সারের যুদ্ধ অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো বলে ঐতিহাসিকরা মনে করে থাকেন।
(৭.) সাম্রাজ্য বিস্তারে সাহায্য
বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব দেখে ভারতের অনেক দেশীয় রাজা মহারাজা তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এর ফলে অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত দেশীয় রাজন্যবর্গ ও রাজপরিবারের অনেকেই ক্ষমতা লাভের আশায় ইংরেজদের সামরিক সাহায্যের মুখাপেক্ষী হতে থাকেন।
এই সুযোগে ইংরেজ কোম্পানিও অন্যান্য দেশীয় রাজ্যে প্রবেশ, হস্তক্ষেপ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের সুযোগ পেয়ে যায়।ইতিমধ্যে দেওয়ানীর অর্থভান্ডার ইংরেজদের হাতে এসে যাওয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারে অর্থের অভাবও অনেকটা দূর হয়।
নিঃসন্দেহে ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের এই বিস্তৃত সুযোগ ও অনুকূল পরিবেশ পলাশীর যুদ্ধে পাওয়া যায় নি। এই কারনে পলাশীর যুদ্ধ থেকে বক্সারের যুদ্ধকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
(৮.) বুলিয়ানের সমস্যা দূর হয়
বক্সারের যুদ্ধের আগে ভারতে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য ইংরেজ কোম্পানিকে দেশ থেকে অর্থ অর্থাৎ সোনা বা রূপো আনতে হতো। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধের পর দেওয়ানী লাভ করার ফলে কোম্পানির বুলিয়ানের সমস্যা দূর হয়।
এর ফলে ভারতের আদায়ীকৃত রাজস্বের টাকাকে ইংরেজরা বানিজ্য পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করে এবং ভারতের টাকাতে ভারতেরই পন্য কিনে নিয়ে ইওরোপের বাজারে বিক্রি করে। অর্থাৎ ভারতের বানিজ্যের জন্য ইংল্যান্ডকে আর দেশ থেকে অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় না।
সিদ্ধান্ত ও মূল্যায়ন
খুব স্বাভাবিক ভাবেই সবদিক বিচার করে সবশেষে তাই একথা বলাই যায়, শুধু ভারতের ইতিহাসের ক্ষেত্রেই নয়, ইংরেজ কোম্পানির আধিপত্যের প্রশ্নেও পলাশীর যুদ্ধ থেকে বক্সারের যুদ্ধ কয়েক গুন বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।