ভারতে রেলপথ স্থাপনের প্রভাব ও ফলাফল

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা ছিলো - রেলপথ স্থাপন ও রেলপথের বিস্তার। ভারতীয় জনজীবনে এর একাধিক ইতিবাচকনেতিবাচক ফলাফল লক্ষ্য করা যায়। 

 ভারতে রেলপথ বিস্তারের প্রভাব ও ফলাফলকে ৩ টি দিক থেকে তুলে ধরা যায় -

  1. ভারতে রেলপথ স্থাপনের ফলে ইংরেজরা কিভাবে, এবং কতখানি লাভবান হয়েছিলো? 
  2.  রেল ব্যবস্থা ভারতীয়দের জনজীবনকে কতখানি প্রভাবিত করেছিলো? এবং 
  3. ভারতীয় অর্থনীতি ও জনজীবনে রেলপথ স্থাপনের কি কুফল লক্ষ্য করা যায়? 
ভারতে রেলপথ স্থাপনের প্রভাব ও ফলাফল
ভারতে রেলপথ স্থাপনের প্রভাব ও ফলাফল 

ভারতে রেলপথ স্থাপনে ইংরেজদের সুবিধা 

ভারতে রেলপথ স্থাপনে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিলো ইংরেজ শক্তি। কারন ভারতে রেলপথ স্থাপনের ফলে - 
  1. ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত পুঁজি বা মহাজনী পুঁজির লাভজনক ভাবে লগ্নি করা হয়। ভারতীয় রেলে পুঁজি বিনিয়োগ করে ব্রিটিশ কোম্পানি গুলি প্রভূত মুনাফা লাভ করে।
  2. ভারতীয় রেলকে হাতিয়ার করে ব্রিটিশ পন্য ভারতের গ্রাম গঞ্জের কোনায় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। 
  3. একই ভাবে ইংল্যান্ডের বস্ত্র শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিশেষত, তুলো ও নীল রেলের মাধ্যমে খুব দ্রুত বন্দর গুলিতে পৌঁছে যায়। 
  4. ভারতে রেল পথ স্থাপনার মাল জোগান দিতে গিয়ে ইংল্যান্ডের লৌহ ও ইস্পাত শিল্প ফুলে ফেঁপে ওঠে। 
  5. রেলের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ প্রেসিডেন্সি অঞ্চল গুলোর মধ্যে যোগাযোগ খুবই সহজ হয়ে যায়। এর ফলে দেশের বিভিন্ন অংশে ব্রিটিশ প্রশাসনের মধ্যে ঐক্য স্থাপিত হয়। ফলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত আরোও শক্ত হয়। 
  6. রেল ব্যবস্থার সাহায্যে দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সৈন্য প্রেরন, বিদ্রোহ মোকাবিলা করা, সংবাদ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। ফলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ফাঁস আরোও শক্ত হয়ে ওঠে। 

ভারতীয়দের ওপর রেলপথ স্থাপনের সুফল

ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ পূরনের তাগিদে এদেশে রেলপথের বিস্তার ঘটলেও, তাদের অলক্ষে এবং অজান্তেই রেল ব্যবস্থার একাধিক সুফল ভারতীয়রা পেতে শুরু করেছিলেন।

 সংক্ষেপে এই সমস্ত দিক গুলোকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি - 

(১.) যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি 

রেল প্রবর্তিত হওয়ার আগে ভারতের যোগাযোগ বলতে ছিলো পায়ে হাঁটা, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি বা পালকি। রেল প্রবর্তিত হওয়ার ফলে রেলের মাধ্যমে খুব দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যোগাযোগ সম্ভব হয়। 

তাছাড়া, নতুন নতুন রেল স্টেশন গড়ে উঠবার পর সেগুলিতে পৌঁছাবার জন্য নতুন শাখাপথ ও সড়কপথও তৈরি হয়। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিধি ও আয়োতন অনেক বৃদ্ধি পায়। 

(২.) সামাজিক প্রভাব 

রেলপথ যোগাযোগ সামাজিক ক্ষেত্রে ভারতীয়দের মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। জাতি, ধর্ম, ভাষা খাদ্যাভ্যাস, ছুঁৎমার্গ, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদি সম্পর্কে ভারতীয়দের দীর্ঘ দিনের অভ্যাস ও কুসংস্কার গুলি রেল যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে পড়তে থাকে। রেল যাত্রার সুবিধা নেবার জন্য সকলেই সব কিছুকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। 

এর ফলে ভারতীয়দের মধ্যে সামাজিক ও প্রাদেশিক বিভেদ এবং বৈষম্য দূর হয়ে যায়। 

(৩.) আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবোধের অবসান

রেল ভারতীয়দের আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা ও স্থানীয় অচলায়তনকে ভেঙ্গে চূড়মার করে দেয়। 

রেল যোগাযোগের ফলে গ্রামীন স্বয়ং সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন জীবনযাত্রার অবসান ঘটে। এর ফলে গ্রামাঞ্চলেও আধুনিক জীবন যাত্রার উপকরন গুলি পৌঁছে যেতে থাকে। গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলে যাতায়াতের ফলে শহর গুলির চরিত্রজনসংখ্যায় তারতম্য ঘটতে থাকে। 
 
এছাড়া, এক প্রদেশের সঙ্গে অন্য প্রদেশের মানুষদের মধ্যে ব্যপক যোগাযোগ ও যাতায়াতের ফলে প্রাদেশিকতা বোধ ও আঞ্চলিকতা বোধের অবসান ঘটতে থাকে।

(৪.) জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় আন্দোলনে সাহায্য 

রেল ব্যবস্থার ফলে আঞ্চলিকতাবোধের অবসান ঘটায় তা  ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ হতে সাহায্য করে। রেল যোগাযোগের ফলে খুব সহজেই - 
  • ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের শিক্ষিত মানুষেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও মতামতের আদান প্রদান করতে পারেন। 
  • এর ফলে জাতীয়তাবাদী পত্রপত্রিকা গুলি সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে দেশব্যাপী জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনার প্রসার ঘটতে থাকে। 
  • রেলে চড়ে খুব সহজেই অন্য প্রদেশে গিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন বা কর্মসূচি গুলিকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। ফলে রেলকে ব্যবহার করে ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী সর্বভারতীয় আন্দোলনের প্রসার ঘটতে থাকে। 
  •  এছাড়া, সহজ রেল যোগাযোগের ফলেই সুদূর পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের সঙ্গে বাংলার বিপ্লবীদের সংযোগ স্থাপন ও বিভিন্ন বিপ্লবী আন্দোলন সংগঠিত করা সম্ভব হয়। 
এককথায়, রেল এদেশে ব্রিটিশ শাসনকে যতটা সংহত করেছিলো, ভারতীয়দের ঠিক ততটাই সংঘবদ্ধ করে তুলতে সাহায্য করেছিলো। 

(৫.) ব্যবসা বাণিজ্য ও বৃহৎ বাজারের পত্তন

রেলপথের বিস্তারের ফলে দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। রেলে করে একস্থানের দ্রব্য খুব সহজেই অন্য স্থানে পৌঁছে যায়। ফলে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বড়ো বড়ো বাজার গড়ে ওঠে। ক্রমে এই সব বৃহৎ বাজার গুলি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। 

রেল যোগাযোগের ফলে ভারতে পাট, কয়লা, চা, এবং কিছু পরিমানে লৌহ ইস্পাত শিল্পের উন্নতি ঘটে। 

(৬.) কৃষির বানিজ্যিকিকরন 

রেলপথ স্থাপন ভারতের কৃষিক্ষেত্রকে ব্যপক ভাবে প্রভাবিত করে। রেল যোগাযোগের ফলে কৃষিপন্যের চলাচল ও আমদানি রপ্তানি বেড়ে যায়। 

ফলে কৃষকরা তাদের উদ্বৃত্ত ফসল দূরবর্তী বাজারে বিক্রি করার সুযোগ লাভ করে। এর ফলে উৎপাদনের চরিত্রে বদল ঘটে। আগে কৃষক যেখানে স্থানীয় প্রয়োজন মেটানোর জন্য চাষ করতো এখন স্থানীয় প্রয়োজন ব্যতিরেকে বিক্রির উদ্দেশ্যে সে কৃষিকাজ করতে থাকে। এর ফলে কৃষির বানিজ্যিকিকরন ঘটতে থাকে। 

এছাড়া রেলপথ স্থাপনের ফলে তুলো, পাট, গম ইত্যাদি নানা নগদ ফসলের উৎপাদনও অনেক বেড়ে যায়। 

(৭.) কৃষিক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আসে

রেলপথ পরোক্ষভাবে কৃষিক্ষেত্রে বৈচিত্র্য এনেছিল। বানিজ্যিক চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে এরপর যে এলাকায় যে যে ফসল ভালো হয়, সেখানে তাই বেশি বেশি করে চাষ করা হতে থাকে। 

যেমন পূর্ববঙ্গে পাটচাষ ভালো হতো বলে, এখন থেকে কেবল তাই স্থানীয় ভাবে, একচেটিয়া আকারে উৎপন্ন হতে শুরু করে। আবার পশ্চিম উপকূলে তুলো ভালো হতো বলে, বানিজ্যিক লাভের দিকটি খেয়াল রেখে সেখানে শুধু তুলো উৎপাদনেই গুরুত্ব দেওয়া হতে থাকে। 

(৮.) দামের ক্ষেত্রে সমতা 

রেলপথ স্থাপনের আগে ভারতের আঞ্চলিক বাজার গুলির ক্ষেত্রে জিনিস পত্রের দামে কোন সমতা ছিলো না। কিন্তু রেলপথ গড়ে উঠবার পরে আঞ্চলিক বাজারের দামের তারতম্য ও পার্থক্য অনেকটাই কমে আসে। 

(৯.) ভারতের সীমিত শিল্পায়নে সাহায্য 

ভারতে যথেষ্ট কাঁচামাল থাকা সত্ত্বেও, ইংরেজরা কখনই চাই নি ভারতে শিল্পের বিকাশ ঘটুক। তা সত্ত্বেও ভারতে যে ধীরগতিসম্পন্ন শিল্পায়ন শুরু হয়েছিলো, তাতে রেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। 

রেলের সহজ ও সস্তা যোগাযোগ এবং ইস্পাত ও কয়লার চাহিদা নানা ভাবে ভারতীয় শিল্পক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছিলো।

(১০.) ভারতীয়দের কর্মসংস্থান 

রেলের উচ্চপদ গুলি ইংরেজরা নিজেদের জন্য সংরক্ষণ করে রাখলেও, নীচু পদ গুলিতে তারা ভারতীয়দের নিয়োগ করতো। এছাড়া, রেললাইন বসানোর যাবতীয় কাজটাই ভারতীয় কুলিদের দিয়ে করানো হতো। 

ফলে রেলকে কেন্দ্র করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বহু সংখ্যক ভারতীয়দের কর্মসংস্থান হয়েছিলো। স্বাধীনতার আগে ভারতীয় রেলে কর্মী হিসাবে কাজ করতো প্রায় দশ লক্ষ লোক। 

ভারতের ওপর রেলপথ স্থাপনের কুপ্রভাব 

রেলপথের বিস্তারে একদিক থেকে ভারতীয়রা যেমন নানা ভাবে লাভবান হয়েছিলেন, তেমন ভারতের অর্থনীতি ও জনজীবনের ওপর রেলপথ স্থাপনের একাধিক কুফলও পড়েছিলো।

সংক্ষেপে এইসব কুফলকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি - 

(১.) সম্পদের বহির্গমন 

ভারতে রেলপথের বেশিরভাগটাই ঘটেছিলো গ্যারান্টি প্রথায়। রেলে অর্থ বিনিয়োগের জন্য ইংল্যান্ডের কোম্পানি গুলোকে শতকরা ৫ টাকা ও পরে সাড়ে ৩ টাকা সুদের গ্যারান্টি দেওয়া হয়। সুদের গ্যারান্টি থাকায় কোম্পানি গুলো ইচ্ছে করেই খরচের পরিমান বাড়ায় এবং ঘাটতি দেখায়। এই ঘাটতি ও সুদের টাকা ভারতীয় রাজস্ব থেকেই মেটানো হতো। 

ফলে ঘাটতি, সুদ ও মুনাফা বাবদ প্রচুর টাকা দেশ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইংল্যান্ডে জমা হতে থাকে। এছাড়া, রেলের মাধ্যমে দেশের অন্যতম প্রধান সম্পদ বিভিন্ন কাঁচামালও নামমাত্র মূল্যে দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। এইভাবে রেলপথের বিস্তার ভারতীয় সম্পদের "বহির্গমন" এর পথ প্রশস্ত করেছিলো। 

(২.) কুটির শিল্পের ধ্বংস 

রেলপথ স্থাপনের ফলে ম্যাঞ্চেস্টারের সস্তা কাপড় ও অন্যান্য বিলিতি শিল্প পন্য খুব সহজেই গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে যায়। ক্রমে বিলিতি পন্যে সারা দেশ ছেয়ে যায়। উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভারত ব্রিটেনের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়তে শুরু করে। ভারতের কুটির শিল্প, যা তখনও গ্রামাঞ্চলে টিকে ছিলো, তাও এর ফলে ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে পড়তে থাকে। 

এর ফলে খুব শীঘ্রই ভারত ব্রিটেনের কাছে কাঁচামালের জোগানদারব্রিটিশ পন্যের একটি লাভজনক বাজারে রূপলাভ করে।

(৩.) দেশীয় শিল্প বানিজ্যের সর্বনাশ

রেলের মাধ্যমে বিলিতি পন্য ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে, দেশীয় পন্য গুলি অসম প্রতিযোগীতার মুখে পড়ে। ফলে দেশীয় শিল্প বানিজ্য মার খেতে থাকে। 

(৪.) প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পরনির্ভর করে রাখা 

রেলপথ নির্মানের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড কখনোই "উচ্চ প্রযুক্তিগত" দক্ষতা ভারতীয়দের শেখায় নি। শুধুমাত্র রেললাইন পাতা, সেতু নির্মাণ বা সুড়ঙ্গ কাটার মতো নিন্মমানের প্রযুক্তি ভারতীয়দের শিখিয়ে ছিলো।

রেলপথ নির্মানে উচ্চ প্রযুক্তিগত দক্ষতা ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা হতো এবং সুকৌশলে তার "ভারতীয়করন" করা হতো না যাতে প্রকৃতপক্ষে কোন "ভারতীয় প্রযুক্তি" গড়ে না উঠে। এই ভাবে অর্থনৈতিক দিকের মতো প্রযুক্তিগত দিক থেকেও ইংরেজরা ভারতকে পরাধীন করে রাখতে চেয়েছিলো।

ভারতে "ইংল্যান্ডের প্রযুক্তি" রপ্তানি করেও প্রতি বছর প্রচুর টাকা ইংরেজরা ইংল্যান্ডে চালান করতো। 

(৫.) জলসেচের ক্ষতি 

রেলপথ স্থাপনের ফলে ভারতে নানা ভাবে জলসেচের ক্ষতি হয়। যেমন - 
  • রেললাইন বসানোর ফলে দু প্রান্তের মধ্যে কৃষিজমি ভাগ হয়ে যায়। ফলে রেললাইন অতিক্রম করে অপর প্রান্তের জমিতে জলসেচ করা যায় নি। 
  • তাছাড়া, রেললাইন বসানোর ফলে একপাশের বিস্তৃর্ন জমিতে কোন নদী বা পুকুর থেকে যাওয়াতে অপর প্রান্তের জমিগুলিতে সেচের জল খাল কেটে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি। 
  • রেললাইন বসাতে গিয়ে অনেক নদীনালা, খাল বিলের ওপর সেতু তৈরি করতে হয়। সেতু তৈরির ফলে নদীনালায় পলি সঞ্চিত হয়, জলস্রোত কমে যায়। নদী নালার জলধারন ক্ষমতাও এর ফলে হ্রাস পায়। ফলে কৃষি জমিতে সেচের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

(৬.) দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব

রেলপথ স্থাপনের ফলে এদেশে দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পায়। দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির পিছনে রেল নিন্মলিখিত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো - 
  • রেলপথ স্থাপনের ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অর্থকরী ফসলের চাষ বেড়ে যায়। ফলে খাদ্য শস্যের উৎপাদন কমে যেতে থাকে। 
  • রেলকে ব্যবহার করে ভারতের সস্তা খাদ্যশস্য ব্রিটেনে রপ্তানি করা হতে থাকে। এর ফলে ভারতে খাদ্যের ভান্ডারে টান পড়ে। এইজন্য সমকালীন জাতীয়তাবাদী লেখকরা খাদ্য শস্য রপ্তানির কঠোর সমালোচনা করেন। 
  • রেলপথ নির্মান করতে গিয়ে রেল পথের দু প্রান্তের জমির জলসেচ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষির ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। 
  • এছাড়া, দুর্ভিক্ষের সময় রেলকে ব্যবহার করে ব্রিটিশ সরকার ভারতে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিক ও সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্য শস্য মজুত করতে থাকলে, দুর্ভিক্ষ প্রবল আকার ধারন করতে থাকে। 
এই সমস্ত কারনে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ দেখা যেতে থাকে। 

(৭.) মহামারীর প্রাদুর্ভাব 

রেলপথ স্থাপনের আরেকটি কুফল হল ভারতে মহামারীর উৎপত্তি। 

রেলপথ স্থাপনের আগে ভারতে কোন মহামারী ছিলো না। অর্থাৎ কোন ছোঁয়াচে রোগ সহজে ছড়িয়ে পড়তো না। দুর্বল যানবাহন ও যোগাযোগের কারনে তা নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। 

কিন্তু রেলপথ প্রবর্তিত হওয়ায় ভারতে যোগাযোগ ও যাতায়াত বেড়ে যায়। ফলে মানুষের চলাচলের সূত্রে খুব সহজেই কিছু রোগ মহামারীর আকারে সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। প্লেগের কথা উদাহরন হিসাবে উল্লেখ করা যায়। 

(৮.) পরিবেশ দূষণের প্রসার

রেলপথ স্থাপন করতে গিয়ে এদেশে পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পায়। বড়ো বড়ো গাছের গুড়ি দিয়ে রেললাইন পাততে গিয়ে প্রচুর গাছকে কেটে ফেলা হতে থাকে। এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে থাকে। 

এছাড়া, বাংলায় রেললাইন স্থাপন করতে গিয়ে রেলের জমির পাশে বড়ো বড়ো গর্ত কেটে দেওয়া হয়, যাতে লাইনের জমির জল ঐ খালে এসে জমা হয়ে যায়, এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিতে  লাইন বসে না যায়। 

এর ফলে ঐ খাল ও নালা গুলিতে জল জমে ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। উনিশ শতকে ম্যালেরিয়া গ্রাম বাংলায় মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিলো।

(৯.) সামাজিক শোষন ও বৈষম্য 

রেলপথ স্থাপনের ফলে ভারতীয়দের ওপর ইংরেজদের সামাজিক বৈষম্যমূলক শোষন দ্বিগুন ভাবে বৃদ্ধি পায়। উদাহরন হিসাবে বলা যায় - 
  • রেলে সবসময়ই ভারতীয়দের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরন করা হতো। 
  • উপযুক্ত ভাড়া দিয়েও রেলের প্রথম শ্রেণীতে চড়বার কোন অধিকার ভারতীয়দের ছিলো না। 
  • রেলে শ্বেতাঙ্গ কর্মচারী ও যাত্রীরা প্রায়ই ভারতীয়দের প্রতি দুর্ব্যবহার করতেন। 
  • মালপত্র পরিবহনে শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে ভারতীয়দের অনেক বেশি ভাড়া দিতে হতো। 
  • বৈষম্যমূলক মনোভাবের কারনে রেলের উচ্চপদে কখনো কোন ভারতীয়দের নিয়োগ করা হতো না। 
  • রেলে কর্মরত কুলীদের নামমাত্র মজুরিতে প্রচুর কাজ করিয়ে নেওয়া হতো। এছাড়া নানারকম অত্যাচার ও শোষনও তাদের ওপর চালানো হতো। 

(১০.) ব্রিটিশ শাসনের শক্ত ফাঁস

রেলপথ স্থাপনের ফলে ভারতীয়দের ওপর ব্রিটিশ শাসনের ফাঁস আরোও শক্ত হয়ে বসে যায়। রেলপথ স্থাপনের সূত্রে  প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মফঃস্বল, সর্বত্র ব্রিটিশ সরকারের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ কঠোর হয়ে পড়ে। রেলকে ব্যবহার করে খুব সহজেই যেকোন বিদ্রোহ বা জাতীয় আন্দোলনকে দমন করে দেওয়া সম্ভব হয়।

এছাড়া, নির্বিঘ্নে রেললাইন বসানোর জন্য ব্রিটিশ সরকার অরন্য ও কাঠ সংরক্ষণে জোর দেয়। এর ফলে ১৮৬৫ খ্রিঃ "অরন্য আইন" তৈরি হয়। এই অরন্য আইনের ফলে দুর্গম অরন্য অঞ্চলে আদিবাসী ও উপজাতিদের ওপরেও ব্রিটিশ সরকারের শাসন ও নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত হয়। আদিবাসীরা তাদের চিরাচরিত অরন্যের অধিকার গুলি থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। 

কালক্রমে, তাদের ওপর ব্রিটিশ সরকারের শোষন ও নিয়ন্ত্রণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে, তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এর ফলে ইংরেজ শাসনকালে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক আদিবাসী ও উপজাতি বিদ্রোহ ঘটতে শুরু করে। 

উপসংহার 

সুতরাং ভারতে রেলপথ স্থাপন কিছু সুফলের পাশাপাশি একাধিক কুফলও ভারতবাসীকে ভোগ করতে হয়েছিলো। এই কারনে দাদাভাই নৌরজী, রমেশচন্দ্র দত্ত, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে প্রমুখ অর্থনৈতিক প্রবক্তারা ভারতে রেলপথের প্রসারকে "আর্শীবাদ" হিসাবে দেখেন নি, দেখেছিলেন "অভিশাপ" হিসাবে। 

এমনকি রামগোপাল ঘোষ, দ্বারকানাথ ঠাকুর, যারা এদেশে রেলপথ স্থাপনের পক্ষে মতামত প্রকাশ করেছিলেন, পরে তাদেরও মোহ ভঙ্গ হয়। তারা উপলব্ধি করেন, রেলপথ অন্যান্য দেশের উন্নতিতে যেভাবে সাহায্য করেছে, তার এতটুকুও ভারতবাসী পায় নি। এর প্রধান কারন অবশ্য ছিলো এদেশে আধুনিক শিল্প গড়ে না তোলা। 

এদেশে যথেষ্ট কাঁচামাল ও খনিজ দ্রব্য থাকা সত্ত্বেও ইংরেজরা কোন শিল্পই এদেশে গড়ে তোলে নি। অথচ ভারতে লোহার অফুরন্ত ভান্ডার ছিলো। অনায়াসে এদেশে লৌহ ইস্পাত শিল্পের বিকাশ ঘটানো যেতো। কিন্তু এটি ঘটালে ব্রিটেনের ইস্পাত শিল্প মার খেতো। তাই ভারী শিল্পের বিকাশে ব্রিটেন কোন আগ্রহ এদেশে দেখায় নি। 

শিল্পায়ন না ঘটায় ভারতে রেল আদপেই ভারতীয়দের কোন অর্থনৈতিক কল্যান সাধন করতে পারে নি। ইংরেজরা ভারতে আধুনিক কোন শিল্প গড়ে না তোলায় দ্রুতগতির রেল পরিবহন আসলেই ভারতীয়দের কোন কাজে আসে নি। 

উল্টে রেল ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে ভারতের কৃষি ও সেচব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯০২ - ৩ খ্রিঃ পর্যন্ত ভারতে জলসেচের উন্নতির জন্য মাত্র ৪৩ কোটি টাকা খরচ করা হয়। অথচ রেলপথ বসাতে সরকার ৩৫৯ কোটি টাকা খরচ করে।

তাই সবশেষে বলা যায়, ভারতীয় রাজস্বের টাকায় ভারতে রেল ব্যবস্থার পত্তন হলেও, তার মূল আর্থিক সুফল ইংরেজরাই লাভ করে এবং ভারতীয়রা "উচ্ছিষ্ট" হিসাবে তার ছিটেফোটারই অংশীদার হয়। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post