ভারতে কিভাবে রেলপথের বিস্তার ঘটে?

 ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে আধুনিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিলো এদেশে রেলপথের প্রবর্তন

কোম্পানি সরকার অবশ্য প্রথমদিকে এদেশে রেলপথ নির্মানে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করে নি। কিন্তু ১৮২৫ খ্রিঃ ইংল্যান্ডে রেলপথ স্থাপনের পর ব্রিটিশ বনিকসভা, পুঁজিপতি শ্রেনী এবং ল্যাঙ্কাশায়ারের মিল মালিকরা ভারতে রেলপথ স্থাপনের জন্য কোম্পানি সরকারের ওপর একটি চাপ সৃষ্টি করেন।

এর ফলেই মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে রেলপথ স্থাপনের সূত্রপাত ঘটে।

ভারতে কিভাবে রেলপথের বিস্তার ঘটে?
ভারতে কিভাবে রেলপথের বিস্তার ঘটে? 

লর্ড ডালহৌসীর ভূমিকা

১৮৫৩ খ্রিঃ লর্ড ডালহৌসীই প্রথম ভারতে রেলপথ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। তার পরিকল্পিত "নীল নকশার" ভিত্তিতেই ভারতে রেল পথ স্থাপনের সূচনা হয়েছিল বলে তাকে "ভারতে রেলপথ স্থাপনের জনক" বলে অভিহিত করা হয়।

যদিও এদেশে রেলপথ নির্মানের চিন্তা ভাবনা ১৮৩২ খ্রিঃ থেকেই শুরু হয় এবং রেলের জন্য জমি জরিপের কাজ শুরু হয় ১৮৪৯ খ্রিঃ

ডালহৌসীর "রেলওয়ে মিনিট"

১৮৫৩ খ্রিঃ লর্ড ডালহৌসী তার বিখ্যাত "রেলওয়ে মিনিট" এ ভারতে রেলপথ স্থাপনের নীল নকশা প্রস্তুত করেন। এখানে ভারতীয় রেল ব্যবস্থার নির্মান কাজ, ব্যবস্থাপনা এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থান বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

রেলওয়ে মিনিটের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ গুলিতে বলা হয় -

  1. কলকাতা, বোম্বাইমাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিকে পরস্পর রেলের মাধ্যমে জুড়ে দেওয়া হবে,
  2. ওখানকার বন্দর গুলিকেও রেলের মাধ্যমে যুক্ত করে দেওয়া হবে, 
  3. রেলপথ নির্মানের যাবতীয় কাজটাই করবে বেসরকারি সংস্থা বা কোম্পানি,
  4. কোম্পানি গুলো যে অনেক টাকা খরচ করে ঝুঁকি নিয়ে রেলের কাজ করবে, সেইজন্য তাদের বিনিয়োগ করা টাকার ওপর ৫% সুদ "গ্যারান্টি" হিসাবে দেওয়া হবে।
  5. ৯৯ বছরের জন্য কোম্পানি গুলিকে রেলপথ বসানোর জন্য বিনামূল্যে জমি দেওয়া হবে। 
  6. ৯৯ বছর পর বিনা ক্ষতিপূরনে রেলপথ সরকারের হাতে চলে আসবে। 
  7. তবে ৯৯ বছরের আগে ৬ মাসের নোটিস দিয়ে সরকার রেলপথে লগ্নি করা অর্থ ফেরত দিয়ে বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে রেলপথ অধিগ্রহণ করে নিতে পারবে। 
লর্ড ডালহৌসীর রেলওয়ে মিনিটের প্রস্তাব বিলাতের কোম্পানির পরিচালক সভা পুরোপুরি ভাবেই মেনে নেন।এর পর খুব দ্রুত ভারতে রেলপথ স্থাপনের কাজ শুরু হয়ে যায়। 

ভারতে রেলপথ নির্মানের পর্যায়

১৮৫৩ থেকে ১৯৪৭ খ্রিঃ পর্যন্ত, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় রেলপথের সম্প্রসারন ঘটে। এই গোটা পর্বে চারটি পৃথক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে রেলপথের বিস্তার ঘটেছিলো। এই ৪ টি পর্যায় ছিলো - 

  1. প্রথম পর্যায় - গ্যারান্টি প্রথার মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোগে রেলপথ স্থাপন, 
  2. দ্বিতীয় পর্যায় - সরকারি উদ্যোগে রেলপথ স্থাপন, 
  3. তৃতীয় পর্যায় - সংশোধিত গ্যারান্টি প্রথায় বেসরকারি উদ্যোগ পুনরায় রেলপথের নির্মাণ, 
  4. চতুর্থ পর্যায় - রেলের রাষ্ট্রীয়করন ও সরকারি উদ্যোগ। 

প্রথম পর্যায় - গ্যারান্টি প্রথা

১৮৫৩ থেকে ১৮৬৯ খ্রিঃ পর্যন্ত, গ্যারান্টি প্রথায় বেসরকারি কোম্পানি দ্বারা ভারতে রেলপথ নির্মানের কাজ শুরু হয়। এই পর্বে যেসব বিদেশী কোম্পানি গুলো এদেশে রেলপথ স্থাপনে অর্থ বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছিলো, তাদের বিনিয়োগ করা অর্থের ওপর ৫% নিশ্চিত সুদের গ্যারান্টি দেওয়া হয়। 

প্রথম পর্যায়ে গ্যারান্টি প্রথার ফলে - 
  • ১৮৫৩ খ্রিঃ বোম্বে থেকে থানে পর্যন্ত ভারতের প্রথম রেলপথ তৈরি হয়। এটি তৈরি করে "The great Indian peninsular company"।
  • ১৮৫৪ খ্রিঃ হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত রেলপথ তৈরি হয়। এটি তৈরি করে "East India Rail Company"।
  • ১৮৫৬ খ্রিঃ মধ্যেই বোম্বাই, মাদ্রাজ ও কলকাতা বন্দরের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ রেল যোগাযোগ গড়ে ওঠে। এবং 
  • ১৮৬৮ খ্রিঃ পর্যন্ত গ্যারান্টি প্রথার ফলে মোট ৪,২৫৫ মাইল রেলপথের নির্মাণ হয়। 

গ্যারান্টি ব্যবস্থার ক্রুটি ও সমালোচনা

গ্যারান্টি ব্যবস্থায় লাভের গ্যারান্টি থাকায় কোম্পানি গুলো ইচ্ছে করে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি টাকা খরচ করে প্রচুর বার্ষিক ঘাটতি দেখাতে থাকে। 

 এই ঘাটতির টাকা ভারতের রাজস্ব থেকে মেটানো হতে থাকে। এর ফলে এই প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠলে গ্যারান্টি প্রথা বাতিল করে দেওয়া হয় এবং সরকার নিজ উদ্যোগে রেলপথ নির্মানের সিদ্ধান্ত নেয়। 

দ্বিতীয় পর্যায় - সরকারি উদ্যোগ

১৮৬৯ থেকে ১৮৮২ পর্যন্ত সময়ে সরকারি উদ্যোগে রেলপথ নির্মানের কাজ চলে। এই পর্বে সরকারি মালিকানায় খুবই ধীর গতিতে রেল লাইন বসানোর কাজ চলেছিলো। 

তৃতীয় পর্যায় - সংশোধিত গ্যারান্টি প্রথা

১৮৮২ খ্রিঃ পর সরকার আবার রেলপথ নির্মানের ক্ষেত্রে গ্যারান্টি প্রথায় ফিরে যায়।

গ্যারান্টি প্রথায় ফিরে যাওয়ার কারন 

১৮৮২ খ্রিঃ পর সরকারের "গ্যারান্টি প্রথায়" ফিরে যাওয়ার পিছনে অনেক গুলি কারন ছিলো - 
  1. ১৭৭৮ খ্রিঃ আফগান যুদ্ধে সরকারের অর্থ ব্যয়ের ফলে রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। 
  2. এই সময় ভারতে দুর্ভিক্ষ ঘটায় সরকার আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট চাপের মধ্যে ছিলো। 
  3. গ্যারান্টি প্রথা বাতিল হয়ে যাওয়াতে ইংল্যান্ডের বেসরকারি কোম্পানি গুলির মুনাফা লাভের সম্ভাবনা কমে যায়। তাই রেলপথ স্থাপনে সরকারি উদ্যোগ বন্ধ করার জন্য তারা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চাপ সৃষ্টি করেন। 
  4. ইতিমধ্যে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা ও অন্যান্য প্রয়োজনে দ্রুত গতিতে রেলপথ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়।
এমতাবস্থায়, সরকার বাধ্য হয়েই গ্যারান্টি প্রথায় ফিরে যায়। ১৮৮২ খ্রিঃ নতুন গ্যারান্টি প্রথায় কয়েকটি বিষয় সংশোধন করে সরকার ঘোষনা করে - 
  • রেলপথে নিযুক্ত বেসরকারি কোম্পানি গুলিকে লগ্নি করা অর্থের ওপর সাড়ে তিন টাকা সুদের গ্যারান্টি দেওয়া হবে। 
  • ২৫ বছর পর সরকার ইচ্ছে করলে টাকা দিয়ে বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে রেলপথ কিনে নিতে পারবে। 
নতুন গ্যারান্টি প্রথার ফলে  - 
  • ১৯০০ খ্রিঃ মধ্যে ২৫ হাজার মাইল রেলপথ তৈরি হয়। 
  • ১৯০৫ খ্রিঃ তা বেড়ে হয় ২৮ হাজার মাইল। 
  • ১৯১০ খ্রিঃ মধ্যে ভারতীয় রেলপথ পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম রেলপথের গৌরব অর্জন করে। 

চতুর্থ পর্যায় - রেলের রাষ্ট্রীয়করন ও সরকারি উদ্যোগ

বিংশ শতাব্দীর সূচনায় ভারতীয় রেল ব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। এই পর্বে বেশ কতকগুলি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। যেমন - 
  1. বিংশ শতাব্দীর মধ্যে ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল রেলপথের মাধ্যমে জুড়ে গিয়েছিলো। 
  2. রেলে পন্য সরবরাহ, যাত্রী চলাচল ও মুনাফা লাভ অনেকখানি বেড়ে গিয়েছিলো।
  3. ইতিমধ্যে অনেক বেসরকারি রেললাইনের চুক্তির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ন হয়ে যায়। 
এইসব কারনে সরকার নিজের হাতে সম্পূর্ন ভাবে রেলকে অধিগ্রহণ করে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। মোটামুটি ১৯০০ খ্রিঃ পর থেকেই ধীরে ধীরে ভারতীয় রেলের রাষ্ট্রীয়করনের কাজ আরম্ভ হয়। 
  • এই সময় ২৫ বছর পূর্ন হওয়া রেলপথ গুলি সরকার কিনে নেয়। 
  • রেলকে পরিচালিত করবার জন্য ১৯০৫ খ্রিঃ একটি আলাদা রেল বোর্ড গঠিত হয়। 
  • রেলের সংস্কারের সুপারিশের জন্য ১৯১৯ খ্রিঃ "অ্যাকওয়ার্থ কমিশন" গঠিত হয়। এই কমিশন গ্যারান্টি প্রথা বাতিল, প্রতি ৫ বছরে ১৫০ কোটি টাকা রেলে বিনিয়োগ, পৃথক রেলবাজেটের প্রস্তাব করে। 

অ্যাকওয়ার্থ কমিশনের সুপারিশ কার্যকর

১৯২৫ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার অ্যাকওয়ার্থ কমিশনের সুপারিশ গুলি কার্যকর করে। এর ফলে - 
  • ১৯২৫ খ্রিঃ পর কয়েকটি রেল কোম্পানির দায়িত্ব সরকার নিজের হাতে গ্রহন করে। 
  • রেলের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রন স্থাপিত হয়। 
  •  সরকারি উদ্যোগে রেলপথের নির্মাণ শুরু হয়। 
  • ১৯২৫ খ্রিঃ সরকারি উদ্যোগে রেলপথ সম্প্রসারিত করবার জন্য পৃথক রেল বাজেট পেশ করা শুরু হয়। 
  • ১৯২৫ থেকে ১৯৪৭ খ্রিঃ স্বাধীনতা লাভের আগে পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই বজায় থাকে এবং সরকারি উদ্যোগে রেলপথের বিস্তার ঘটতে থাকে। 

শেষ কথা  

১৯৪৭ খ্রিঃ ইংরেজরা ভারত ত্যাগের সময়ে এদেশে ৬৫,২১৭ হাজার কিলোমিটার রেলপথ তৈরি হয়ে যায়। এর ফলে দেশের ৭৮ ভাগ এলাকাই রেল ব্যবস্থার আওতায় চলে আসে। 

ক্রমে রেল স্টেশন গুলিতে পৌঁছাবার প্রয়োজনে নতুন নতুন সড়কপথ তৈরি হতে থাকে। ফলে রেল যোগাযোগকে সূত্র করে ভারতের রাস্তাঘাট নির্মান ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটে যায়। রেল ভারতের আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা ও স্থানীয় অচলায়তনকে ভেঙ্গে চূড়মার করে দেয়। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post