ভারতে "আধুনিক পরিকাঠামো" গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রেলপথের নির্মাণ কে অনেকেই ব্রিটিশ শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে মনে করে থাকেন।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ভারতে রেলপথ স্থাপনের কিছু সুফল ভারতীয়রা পেয়েছিলো। কিন্তু যেভাবে রেলপথ তৈরি করা হয়েছিলো এবং তাকে পরিচালিত করা হয়েছিলো, তা থেকে ২ টি বিষয় খুব পরিষ্কার -
- ভারতবাসীর সুবিধে করে দেওয়া বা তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানোর জন্য ইংরেজরা এদেশে রেলপথ তৈরি করে নি।
- তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের স্বার্থ পূরন করা।
আর এই কারনেই ঔপনিবেশিক প্রশাসকদের কাছে ভারতের মতো কৃষিপ্রধান একটি দেশে সেচ ব্যবস্থার বিকাশের থেকেও রেল ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছিলো এবং তা সরকারি কর্মসূচির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার লাভ করেছিলো।
প্রথমদিকে অবশ্য ইংরেজরা ভারতে রেলপথ স্থাপনে আগ্রহী ছিলো না। কিন্তু উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের (১.) মিল মালিক, (২.) বনিক সভা ও (৩.) ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের ক্রমাগত চাপ সৃষ্টির ফলে ঔপনিবেশিক সরকার রেলপথ স্থাপনে উদ্যোগী হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এইসব পুঁজিপতিদের প্রতিনিধিরা সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হন, ভারতে রেলপথের স্থাপন হলে ঔপনিবেশিক সরকারও নানা দিক থেকে লাভবান হতে পারে।
ইতিমধ্যে ভারতে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এর ফলে শেষপর্যন্ত লর্ড ডালহৌসীর ১৮৫৩ সালের "রেলওয়ে মিনিটের" নীল নকশার হাত ধরে ভারতে রেলপথ স্থাপনের সূচনা ঘটে।
ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য |
ভারতে রেলপথ স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) বিলিতি পন্যসামগ্রী বাজারে পৌঁছে দেওয়া
শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে অল্প সময়ে প্রচুর পন্য সামগ্রী উৎপন্ন হতে থাকে। কিন্তু দ্রুত গতির যানবাহনের অভাবে তা ভারতের দূর দূরান্তের বাজার গুলিতে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। এই জন্য ১৮৩০ খ্রিঃ থেকেই ভারতে রেলের মতো সস্তা ও দ্রুত গতির যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা চাপ দিতে থাকেন।
এদেশে রেলপথ নির্মানের প্রথম পর্বে এইজন্য পন্য চলাচলের সুবিধার্থে বোম্বাই, কলকাতা ও মাদ্রাজ বন্দর গুলির সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের রেল যোগাযোগ গড়ে তোলায় জোর দেওয়া হয়। ১৮৫৬ খ্রিঃ মধ্যেই অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এই রেল যোগাযোগ গড়ে তোলা হয়।
(২.) কাঁচামাল সংগ্রহ করা
ইংল্যান্ডের কারখানা গুলিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে দ্রুত কাঁচামাল যোগানের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু ভারতে উন্নত পরিবহনের অভাবে গ্রাম গঞ্জ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে বন্দরের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে পাঠাতে অনেক সময় লেগে যেতো।
তাই এদেশে রেলপথ স্থাপনের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য ছিলো রেলের মাধ্যমে সহজে ও কম সময়ে ইংল্যান্ডে কাঁচামাল সরবরাহ করা। ১৮৫৪ খ্রিঃ হাওড়া পান্ডুয়া রেলপথ কে এই কারনেই ১৮৫৫ খ্রিঃ রানিগঞ্জ পর্যন্ত প্রসারিত করা হয়, যাতে খুব সহজেই রেলের মাধ্যমে ভারতের কয়লা ইংল্যান্ডে চালান করা যায়।
(৩.) তুলো পরিবহনের সমস্যা দূর করা
ভারতে রেলপথ স্থাপনের একটি বড়ো কারন ছিলো তুলো পরিবহনের সমস্যা দূর করা। ভারতে ঠেলাগাড়ী করে দীর্ঘ সময় ধরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় তুলো পরিবহনের সময় ধুলোবালিতে ময়লা হয়ে তুলোর মান কমে যেতো।
ল্যাঙ্কাশায়ারের তুলো ও সুতো ব্যবসায়ীরা এজন্য ভারতে রেল যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য বারংবার কোম্পানির কাছে দরবার করেছিলো। ১৮৫৩ খ্রিঃ লর্ড ডালহৌসী তার মিনিটে খোলাখুলিই লেখেন, ভারতের উন্নত তুলো ব্রিটেনে পাঠাবার জন্য রেল যোগাযোগ গড়ে তোলা প্রয়োজন।
"lnvestment in Indian Railway" প্রবন্ধে ডব্লিউ জে. ম্যাকফারসন দেখিয়েছেন, তুলো পাঠাবার সুবিধার দিকটিকে গুরুত্ব দিয়েই ভারতে রেলপথের নকশা আঁকা হয়।
ভারতে এমন ভাবে রেলপথের বিস্তার ঘটানো হয়, যাতে খুব সহজেই তুলো উৎপাদনকারী এলাকা গুলি বন্দর এলাকা গুলির সাথে জুড়ে যায়।
(৪.) ইস্পাত ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষা করা
শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে লৌহ ইস্পাত শিল্পের চরম উন্নতি ঘটেছিলো। তাই লৌহ ও ইস্পাত রপ্তানির জন্য ব্রিটিশ ইস্পাত ব্যবসায়ীরা চেয়েছিলো, ভারতে রেলপথের বিস্তার ঘটুক। কারন ভারতে রেলপথ স্থাপনের সঙ্গে তাদের স্বার্থ বিভিন্ন দিক থেকে জড়িত ছিলো।
ভারতে রেললাইন পাতা হলে এদেশে প্রচুর লোহার সরঞ্জাম, রেলের ইঞ্জিন, বগি, ইত্যাদি সরঞ্জামের প্রয়োজন পড়বে। ইংল্যান্ড থেকে সেগুলি ভারতে এলে একদিকে যেমন ইংল্যান্ডের ইস্পাত শিল্পের উন্নতি ঘটবে,তেমনি ইস্পাত বিক্রির বাজারও পাওয়া যাবে।
(৫.) ব্রিটিশ পুঁজির বিনিয়োগ করা
শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডের পুঁজিপতিদের হাতে প্রচুর উদ্বৃত্ত পুঁজি জমা হয়। তারা তাদের সঞ্চিত পুঁজি বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগ করে আরোও একটু বাড়িয়ে নিতে চাইছিলেন।
রেলের মতো বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ছিলো উদ্বৃত্ত পুঁজি বিনিয়োগের সেরা উপায়। এই কারনে ইংল্যান্ডের বনিক সভা গুলি বারংবার ব্রিটিশ সরকারকে ভারতে রেলপথ নির্মানের জন্য চাপ দেয়।
মূলত এদের চাপেই এবং ব্রিটিশ পুঁজির লাভজনক লগ্নির উদ্দেশ্যেই ভারতে ঔপনিবেশিক সরকার রেলপথ স্থাপন করেছিলো।
(৬.) ইংরেজদের কর্মসংস্থান তৈরি করা
ভারতে ব্রিটিশ নাগরিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া রেলপথ স্থাপনের আরেকটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো। ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র "বঙ্গবাসী" ও "নববিভাকর" পত্রিকায় এই উদ্দেশ্যের কথা লিখেছিলেন।
ভারতে রেলপথের বিস্তার ঘটলে ডিরেক্টর থেকে ইঞ্জিনিয়ার, হিসাব পরীক্ষক ইত্যাদি পদ গুলিতে ব্রিটেনের উচ্চশিক্ষিত লোকেদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। ভারতে রেলপথ স্থাপিত হবার পর এই উদ্দেশ্যটি আরোও ভালো ভাবে বোঝা যায়। কুলির কাজ ছাড়া, রেলের সমস্ত উচ্চ পদ গুলিই ইংরেজরা নিজেদের দখলে রেখেছিলো।
(৭.) সামরিক উদ্দেশ্য
ভারতে রেলপথ স্থাপনে ঔপনিবেশিক সরকারের সামরিক প্রয়োজন ও উদ্দেশ্যও জড়িত ছিলো।
উনিশ শতকের প্রথম দিকের বিদ্রোহ গুলিতে দ্রুতগতির পরিবহনের অভাবে সৈন্য সামন্ত পাঠিয়ে সেগুলিকে তাড়াতাড়ি দমন করা যায় নি। এই অভিজ্ঞতা থেকে প্রশাসনিক মহল ভারতে রেলপথের দাবিতে সোচ্চার হয়। মহাবিদ্রোহের পর রেলের সামরিক উপযোগীতার দিকটির গুরুত্ব আরো ভালো ভাবে বোঝা যায়।
এই কারনে -
- মহাবিদ্রোহের পর ভারতে খুব দ্রুত রেল যোগাযোগ গড়ে তোলায় জোর দেওয়া হয়।
- ভারতের প্রত্যেক গভর্নর জেনারেল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার বিষয়টির সঙ্গে রেল যোগাযোগের বিষয়টিকে সংযুক্ত করেন।
- সামরিক কারনে সরকার এমন অনেক জায়গায় রেলপথ স্থাপন করে, যার কোন বানিজ্যিক বা অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছিলো না। উদাহরন হিসাবে ১৮৬৮ খ্রিঃ পেশোয়ার দিল্লি রেলপথ স্থাপনের কথা বলা যায়। যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো উত্তর পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা।
(৮.) রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রন স্থাপন
সময়ের সাথে সাথে ব্রিটিশ আধিপত্যের আয়োতন বৃদ্ধি পেলে, প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরাঞ্চল, ভারতের সর্বত্র নিয়ন্ত্রনের প্রয়োজন দেখা যায়। এইজন্য উন্নত পরিবহনের প্রয়োজন পড়ে। কারন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারনে -
- এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যোগাযোগ স্থাপন,
- সংবাদ সংগ্রহ ও সংবাদ আদান প্রদান করা,
- প্রশাসনিক নির্দেশ বা অর্ডার পাঠানো,
- সেনাবাহিনী ও ভারতের ব্রিটিশ নাগরিকদের জন্য খাদ্য, রসদ ইত্যাদি পাঠানো ও মজুত করবার জন্য রেলের প্রয়োজন পড়ে।
তাছাড়া, লর্ড ডালহৌসীর সম্প্রসারনশীল বিস্তার নীতির জন্য দ্রুত যোগাযোগ সম্পন্ন রেলপথের প্রয়োজন পড়েছিলো। ভারতের রেলপথ স্থাপনের পিছনে তাই অর্থনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উদ্দেশ্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।
(৯.) দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা
ভারতে রেলপথ স্থাপনের আরেকটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা।
ব্রিটিশ সরকারের উচ্চহারে ভূমি রাজস্ব নীতি ও সাম্রাজ্যবাদী শোষনের কারনে সমগ্র ব্রিটিশ শাসনকালে ভারত বেশ কয়টি বড়ো বড়ো দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছিলো। "দুর্ভিক্ষ নিরোধ কমিশন" এইজন্য দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ভারতে রেলপথ নির্মানের সুপারিশ করে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, দুর্ভিক্ষ গুলিতে ব্রিটিশ সরকার রেলকে পীড়িত এলাকার মানুষদের সাহায্য করার বদলে ব্রিটিশ নাগরিক ও সেনাদের খাদ্য মজুত করতেই অধিক পরিমানে ব্যবহার করেছিলো।
উপসংহার
সুতরাং এই পর্যন্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায়, ভারতের কল্যাণ বা ভারতবাসীর সুবিধা করে দেবার উদ্দেশ্যে ইংরেজরা কখনই এদেশে রেলপথের বিস্তার করে নি।
ভারতে রেলপথ স্থাপনে ঔপনিবেশিক উদ্দেশ্য গুলি আরোও স্পষ্ট হয়ে ওঠে রেল সংক্রান্ত ঔপনিবেশিক সরকারের আচার আচরণ গুলিতে -
- রেলকে কেন্দ্র করে ভারতীয়দের ওপর বর্নবৈষম্যবাদের প্রকাশ ঘটিয়ে ইংরেজরা বুঝিয়ে দিয়েছিলো ইংরেজদের স্বার্থেই এ দেশে রেলপথ তৈরি করা হয়েছে।
- রেলের পরিষেবা গ্রহনের ক্ষেত্রে তাই ভারতীয়রা সর্বদাই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বলে গন্য হতেন।
- রেলের উচ্চ পদ গুলিতে বা ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর কামরায় ভারতীয়দের এইকারনে প্রবেশের কোন অধিকারই ছিলো না।
- রেলের পন্য পরিবহনের ক্ষেত্রে পক্ষপাত মূলক ভাড়ার ব্যবস্থা করে ঔপনিবেশিক স্বার্থকে সংরক্ষিত করা হয়েছিলো।
- ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে বন্দরে কাঁচামাল পাঠাতে অথবা ইংল্যান্ড থেকে বন্দরে আসা শিল্প পন্য গুলি ভারতের অভ্যন্তরে পরিবহনে, রেলের ভাড়া খুবই কম করে বসানো হয়েছিলো।
- উল্টো দিকে বন্দর থেকে ভারতের অভ্যন্তরগামী ট্রেনে ঐ একই কাঁচামালের ভাড়া ছিলো অত্যন্ত বেশি। এমনকি ভারতের বাজার থেকে যে সমস্ত শিল্প পন্য গুলি বিদেশে বিক্রির জন্য বন্দরে যেতো, তার রেল পরিবহন ভাড়াও ছিলো বৈষম্যমূলক ও অত্যন্ত চড়া।
ঔপনিবেশিক সরকারের এইসব আচার আচরনই বুঝিয়ে দিয়েছিলো, ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য ও স্বার্থ রক্ষার তাগিদেই এদেশে রেলপথের স্থাপনা ও পরিচালনা করা হয়েছিলো।