মানুষের আঁকা ছবি এবং ফটোগ্রাফির ইতিহাস চর্চাকেই এককথায় দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস বলা হয়ে থাকে। প্রথম পর্বটিতে চিত্রকলা বা আঁকা ছবি নিয়ে আমরা বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছিলাম। আজ দৃশ্য শিল্পের দ্বিতীয় পর্বে আমরা ফটোগ্রাফিকে নিয়ে আলোচনা করবো।
দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস - দ্বিতীয় পর্ব |
ফটোগ্রাফির অর্থ
ফটোগ্রাফি শব্দটি গ্রিক শব্দ "ফটোস" এবং "গ্রাফিক্স" শব্দের মিলনে সৃষ্টি হয়েছিলো। ফটোস শব্দের অর্থ হলো আলো এবং গ্রাফিক্স শব্দের অর্থ হলো অঙ্কন বা চিত্র।
অর্থাৎ ফটোগ্রাফি শব্দটির বাংলা অর্থ হলো আলোক চিত্রন।
ফটোগ্রাফির সংজ্ঞা
সাধারন অর্থে সূর্যের আলো কিংবা কৃত্রিম আলোকে ব্যবহার করে কোন বস্তুর প্রতিবিম্ব আঁকার যান্ত্রিক পদ্ধতিকেই "ফটোগ্রাফি" বলা হয়।
অর্থাৎ সহজ করে বলতে গেলে ক্যামেরায় তোলা ছবিকেই ফটোগ্রাফি বলা হয়।
ফটোগ্রাফির সূচনা
- ক্যামেরার সাহায্যে ছবি তোলার চেষ্টা ১৮০০ খ্রিঃ থেকে শুরু হলেও, ১৮৩০ এর দশকেই তা স্বার্থক রূপ পায়।
- ১৮৩৯ খ্রিঃ বানিজ্যিক ভাবে ফটোগ্রাফির সূচনা হয়।
- ১৮৬১ খ্রিঃ সূচনা হয় রঙিন ফটোগ্রাফির।
- প্রথম দীর্ঘস্থায়ী রঙিন ছবি তোলেন থমাস সাটন।
- এর প্রায় ১০০ বছর পর ১৯৫৭ খ্রিঃ ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়।
ইতিহাস চর্চায় ফটোগ্রাফিকে কেন গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়?
ইতিহাস চর্চায় ৩ টি কারনে ফটোগ্রাফিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। যথা -
- ফটোগ্রাফি যেভাবে পুরানো সময়কে প্রায় অবিকৃত ভাবে ধরে রাখতে পারে, কোন লেখক বা চিত্রকর অথবা ইতিহাসের অন্য কোন উপাদান তা কখনই পারে না।
- সাহিত্য বা শিল্পের মতো ফটোগ্রাফিতে কল্পনা বা অনুভূতির স্থান নেই। আলোকচিত্র শিল্পী নিজের চোখে যা দেখেন, তাইই ক্যামেরায় তুলে রাখেন।
- ফটোগ্রাফি বিভিন্ন রকম অতিরঞ্জন দোষ থেকেও অনেকটাই মুক্ত। সাহিত্য বা অন্যান্য মাধ্যম গুলির থেকে অনেকটাই নিরপেক্ষ। এককথায়, ফটোগ্রাফি বাস্তব সময়েরই এক "জীবন্ত জীবাস্ম"।
ফটোগ্রাফির সীমাবদ্ধতা
তবে একটি কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, ফটোগ্রাফি কিন্তু পুরোপুরি নিরপেক্ষ নয়। কে কেমন ভাবে এবং কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে ফটো তুলছেন তার উপরেই ফটোগ্রাফির নিরপেক্ষতা নির্ভর করে।
একটি ঘটনাকে বিভিন্ন দিক থেকে লেন্সবন্দী করা যেতে পারে। তাই ফটোগ্রাফারের মানসিকতার ওপরেই ফটোগ্রাফির নিরপেক্ষতা ও গুরুত্ব নির্ভর করে।
ইতিহাস রচনায় ফটোগ্রাফির গুরুত্ব
ইতিহাস চর্চায় ফটোগ্রাফির গুরুত্বের প্রধান দিক গুলি হল -
- ফটোগ্রাফি বাস্তব দৃশ্যকে অপরিবর্তিত ও অবিকৃত অবস্থায় আমাদের সামনে তুলে ধরে। ফলে ফটোগ্রাফির মধ্য দিয়ে ইতিহাস চর্চা প্রকৃত অর্থেই হয়ে ওঠে যথার্থ ইতিহাস চর্চা।
- সিপাহী বিদ্রোহের সময় ড: জন মুরে এবং ফেলিক্স বিয়াতোর তোলা ফটোগ্রাফি যেমন মহাবিদ্রোহের নানা বাস্তব খন্ডযুদ্ধের ছবি তুলে ধরে। তেমনই ব্রিটিশ শাসনকালে নৌ বিদ্রোহ, একাধিক দাঙ্গা এবং বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলন গুলির বাস্তব ছবি ফটোগ্রাফির মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
- দুর্ভিক্ষ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, এবং দেশ ভাগের ইতিহাস চর্চায় ফটোগ্রাফি একটি শক্তিশালী ঐতিহাসিক মাধ্যম। এই ৩ টি বিপর্যয়ে মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা কত দুঃসহ ও অবর্ননীয় হয়ে পড়েছিলো, তা একমাত্র ফটোগ্রাফির ইতিহাস চর্চা থেকেই বোঝা সম্ভব।
- ফটোগ্রাফির সাহায্যে তুলনামূলক পদ্ধতি প্রয়োগ করে অতীত এবং বর্তমান সময়কালের পরিবর্তনকে সহজেই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষন করা যায়। এই পদ্ধতি শহরের ইতিহাস চর্চার জন্য খুবই উপযোগী। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, বহু আগে তোলা শহরের কোন একটি এলাকার ফটোগ্রাফি দেখে তার অতীত এবং বর্তমানের চেহারা খুব সহজেই বুঝে নেওয়া যায়।
- ফটোগ্রাফির আরেকটি বিশেষ ব্যাপার হলো, ফটোগ্রাফি তার সময়কালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা গুলিকে লেন্সবন্দী করে রাখে। উদাহরন হিসাবে বলা যায় -
- পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা মুহুর্তের বাস্তব ছবি আমরা ফটোগ্রাফির মাধ্যমেই দেখতে পাই।
- শুধু তাই নয়, ফটোগ্রাফিতে ধরা পড়েন ইতিহাসের নায়করাও। ফলে ফটোগ্রাফি ইতিহাসকে করে তোলে আরোও প্রানবন্ত।
ফটোগ্রাফির ইতিহাস চর্চার সঙ্গে যুক্ত ঐতিহাসিক
যে সমস্ত ঐতিহাসিকদের হাত ধরে ফটোগ্রাফির ইতিহাস জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন -
- রবার্ট হার্শ,
- রবার্ট ই ক্রেবস,
- মাইকেল আর পেরেশ,
- আর ডগলাস নিকেল,
- সোফি গর্ডন।
দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য তথ্য
- ছবি আঁকা ও ফটোগ্রাফির ইতিহাসকেই বলা হয় দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস।
- আধুনিক ভারতের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য চিত্রশিল্পী হলেন - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়।
- ভারতে আল্ট্রামর্ডান আর্টের উদ্ভাবক ছিলেন - গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
- অ্যাবস্ট্রাক আর্টের উল্লেখযোগ্য ভারতীয় চিত্রশিল্পী ছিলেন - গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
- ভারতের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী ছিলেন - গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
- ভারতের চিত্রশিল্পের প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় - মধ্য প্রদেশের ভীমবেটকা গুহাতে।
- ফটোগ্রাফির বাংলা অর্থ হলো - আলোক চিত্রন।
- সাধারন অর্থে সূর্যের আলো কিংবা কৃত্রিম আলোকে ব্যবহার করে কোন বস্তুর প্রতিবিম্ব আঁকার যান্ত্রিক পদ্ধতিকেই ফটোগ্রাফি বলা হয়।
- ফটোগ্রাফির সবথেকে বড়ো গুরুত্ব হলো - ফটোগ্রাফি সময়ে প্রায় অবিকৃত ভাবে ধরে রাখতে পারে।
- বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলীর লেখক হলেন - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
- চিত্রকথা গ্রন্থের লেখক - বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়।
- নাইনটিনথ সেঞ্চুরি ইন্ডিয়ান ফটোগ্রাফি র লেখক - সোফি গর্ডন।
- কনটেম্পোরারি ইন্ডিয়ান আর্টিস্ট গ্রন্থের লেখক - গীতা কাপুর।
- ভারতমাতা চিত্র টি আঁকেন - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
- বিশ্বে প্রথম ফটোগ্রাফি তোলেন - ফ্রান্সের নিপস নামে এক ব্যক্তি। চার ঘন্টার পরিশ্রমের বিনিময়ে তিনি ছবি তুলতে সক্ষম হন।
ফটোগ্রাফি সম্পর্কিত গ্রন্থ
- এ শর্ট হিস্ট্রি অব দ্য ক্যামেরা - জন ওয়েভ।
- হিস্ট্রি অব ফটোগ্রাফি - ডগলাস নিকেল।
- নাইনটিনথ সেঞ্চুরি ইন্ডিয়ান ফটোগ্রাফি - সোফি গর্ডন।