সামাজিক ইতিহাস চর্চার একটি অন্যতম দিক হলো - "পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাসের চর্চা"।
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস |
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাসের সংজ্ঞা
সময়ের হাত ধরে মানুষের সাজ পোশাকে যে বদল আসে, তার ইতিহাসের আলোচনাই এককথায় "পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস" নামে পরিচিত।
অর্থাৎ পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়ে -
পোশাক পরিচ্ছদের (১.) উদ্ভব,(২.) প্রচলন ও (৩.) বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হয়। যেমন -
- শাড়ির ইতিহাস,
- ধুতি বা পাজামার ইতিহাস,
- জিন্সের ইতিহাস,
- বাঙালিদের বেশবাসের ইতিহাস,
- ঔপনিবেশিক আমলে বাঙালিদের পোশাক পরিচ্ছদের বিবর্তনের ইতিহাস ইত্যাদি।
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত
- ১৯৬০ এর দশক থেকেই পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে।
- ভারতে অবশ্য ১৯৫০ এর দশক থেকেই পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে লেখালেখির সূচনা ঘটে।
- পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস করবার জন্য ১৯৯১ খ্রিঃ ইংল্যান্ডে "দ্য অ্যাসোসিয়েশন অব ড্রেস হিস্টোরিয়ানস" প্রতিষ্ঠিত হয়।
- বর্তমানে পোশাকের ইতিহাস চর্চা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং অনেক ঐতিহাসিকই পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন -
- কর্নেল ডালটন,
- টমাস হোপ,
- ফরাসি ঐতিহাসিক ক্যামেলি বোনার্ডস,
- ব্রিটিশ ঐতিহাসিক সি ডব্লিউ ক্যানিংটন,
- জেমস ল্যাভর,
- দিলীপ মেনন,
- পিটার ম্যাকলিন,
- মলয় রায়।
পোশাক পরিচ্ছদের ৫ টি মূল দিক
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস চর্চা থেকে মানুষের পোশাক পরিচ্ছদ সম্পর্কে ৫ টি মূল দিক জানা যায় -
- সভ্য - অসভ্যের ধারনার সঙ্গে পোশাক পরিচ্ছদের ভাবনা ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্কযুক্ত। পৃথিবীর প্রতিটি সভ্য জনজাতির মধ্যেই তাই পোশাক পরিচ্ছদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
- পোশাক পরিচ্ছদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের দিকটি হলো পোশাক বৈচিত্র্য। পৃথিবীর সব জনগোষ্ঠীর এমনকি একটি দেশের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষদের পোশাক একই রকমের হয় না। পোশাকের মধ্যে একটি বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য দেখা যায়।
- মানুষের পোশাক পরিচ্ছদ তার নিজস্ব এলাকার জলবায়ু ও আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করেই গড়ে ওঠে। উষ্ণ আবহাওয়ার জন্য ভারতীয় উপমহাদেশের বেশিরভাগ অনেকেই সুতির ঢিলেঢালা পোশাক ব্যবহার করেন। অন্যদিকে ইওরোপের লোকেরা ঠান্ডার জন্য গরম পোশাকের ব্যবহার করে থাকেন।
- পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই নারী পুরুষের পোশাক পরিচ্ছদের একটি ভিন্ন রূপ চোখে পড়ে। নারীর পোশাকের বৈচিত্র্য প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত বিচিত্র হলেও পুরুষের পোশাকের ক্ষেত্রে সেই বৈচিত্র্য বরাবরই কম।
- সাম্প্রতিক কালে পোশাক পরিচ্ছদের বিশ্বায়ন ঘটছে। আঞ্চলিক প্রভেদকে দূরে সরিয়ে রেখে আমরা ক্রমশ একই পোশাক পরিচ্ছদের অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে পড়ছি।
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাসের গুরুত্ব
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস চর্চার একাধিক ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক রয়েছে। যেমন -
(১.) পোশাক পরিচ্ছদের উৎপত্তির কথা
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস চর্চা থেকে যেকোন পোশাকের বা পরিধান রীতির উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাসটি জানা যায়। ভারতের পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস চর্চার ফলেই জানা গেছে -
- ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে বাঙালির পোশাক পরিচ্ছদের বিবর্তনে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।
- পুরুষদের আধুনিক স্টাইলে ধুতি, পায়জামা ও পাঞ্জাবী পরার রীতি স্বদেশী আন্দোলনের সময় জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রচলন করেন।
- অন্যদিকে পারসি মেয়েদের মতো কুচি দিয়ে শাড়ি পড়বার নতুন স্টাইল প্রচলন করেন ভারতের প্রথম I. C. S সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, যা "ব্রাহ্মিকা স্টাইল" নামে পরিচিত ছিলো।
- এছাড়াও মেয়েদের পেটিকোট, ব্লাউজ, অন্তর্বাস, সবকিছুই তিনি প্রচলন করেন।
চিত্রা দেবের "ঠাকুরবাড়ীর অন্দরমহল" গ্রন্থ থেকে বাঙালির বেশবাসের এই বিবর্তনের কথা জানা যায়।
(২.) সংস্কার ভাবনার নানা দিক
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস চর্চা থেকে কোন জনগোষ্ঠীর রুচি, সংস্কৃতি এবং সংস্কার ভাবনার নানা দিকের কথা জানা যায়। যেমন -
- হিন্দু ধর্মে সেলাই করা পোশাক পরা নিষিদ্ধ ছিলো বলে প্রাচীনকালে লম্বা একখন্ড কাপড় মেয়েরা শাড়ি হিসাবে এবং ছেলেরা ধুতি হিসাবে পরিধান করতেন।
- আজও হিন্দু ধর্মে যেকোন শুভ ক্রিয়াকলাপে সেলাই করা কাপড় বর্জন করা হয়ে থাকে।
- মধ্যযুগে মুসলিম অভিযানের পরেই ভারতে সেলাই করা পোশাকের প্রচলন শুরু হয়।
(৩.) জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশ
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস চর্চা একটি অঞ্চলের জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কেও ধারনা করা যায়। কারন গ্রীষ্মপ্রধান এবং শীতপ্রধান অঞ্চলের মানুষ তাদের নিজস্ব এলাকার জলবায়ুর সঙ্গে সাযুর্জ্য রেখেই তাদের পোশাক নির্বাচন করে থাকেন।
(৪.) সামাজিক বৈষম্যের পরিচয়
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস চর্চা থেকে সমাজে ধনী দরিদ্রের বৈষম্যের দিকটি সম্পর্কে ধারনা করা যায়। কারন ধনীরা যেমন দামি পোশাক পরতে পারেন, গরিব ও দরিদ্র মানুষেরা তেমন দামি পোশাক পরতে পারেন না। ফলে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রকৃত পরিচয় অনেক সময়েই তাদের পোশাক পরিচ্ছদের মধ্যে ফুটে ওঠে।
(৫.) ফ্যাশনের নথিবদ্ধকরন
যুগের বদলের সাথে সাথে মানুষের রুচি ও ফ্যাশনেরও বদল ঘটে। সাজ পোশাকের ধরনে এবং পোশাকের কাটিং ও ডিজাইনে বদল ঘটে।
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস চর্চা মানুষের এই ক্রমপরিবর্তিত ফ্যাশনেরও নথিবদ্ধকরন করে।
(৬.) শ্রেনী শোষনের পরিচয়
পোশাক পরিচ্ছদকে ব্যবহার করে সমাজে শ্রেনী শোষনের ঘটনাও ঘটনাও ঘটে থাকে। উদাহরন হিসাবে রক্ষনশীল হিন্দু সমাজের বিধবাদের কথা বলা যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর আজীবন তাদের মুন্ডিত মস্তকে সাদা থান পরে থাকতে বাধ্য করা হতো। রঙিন শাড়ি বা শৃঙ্গার করবার কোন অধিকার তাদের ছিলো না।
(৭.) কারিগরি জ্ঞানের বিকাশ
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস চর্চা থেকে কারিগরি জ্ঞানের দক্ষতার কথাও জানা যায়। উদাহরন হিসাবে বাংলার মসলিনের সূক্ষ্ম বুননশৈলীর কথা উল্লেখ করা যায়।
(৮.) ধর্ম বিশ্বাসের দিক
পোশাক ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কারের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে।
- ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কারের জন্য প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়েরই আলাদা আলাদা পরিধান রীতি থাকে।
- মুসলিমরা নামাজের সময় বা খ্রিষ্টানরা প্রার্থনার সময় যেরকম পোশাক পরে থাকেন, হিন্দুরা পুজোর সময় তেমন পোশাক পরিধান করেন না।
- জৈন ধর্মে শ্বেতাম্বর ( যারা শ্বেতবস্ত্র পরিধান করতেন) ও দিগম্বরের ( এরা পোশাক পরিচ্ছদকে বর্জন করে নগ্ন ) ধারনা পোশাক পরিচ্ছদকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিলো।
পোশাক পরিচ্ছদ কিভাবে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটায়?
পোশাক পরিচ্ছদের সঙ্গে জাতীয়তা বোধেরও একটি অভিন্ন সম্পর্ক রয়েছে। যেমন -
- প্রত্যেক জাতির স্বতন্ত্র পোশাক থেকে স্বতন্ত্রবাদী চেতনার জন্ম হয়। এই স্বতন্ত্রবাদী চেতনা থেকেই জন্ম নেয় জাতীয়তা বোধের ধারনা।
- স্বদেশী আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে পোশাক। এই সময় বিদেশী পোশাক বর্জন করে তাতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
- স্বদেশী আন্দোলনের সময় বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদকে সঞ্চারিত করবার জন্য জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধুতি পায়জামা সহযোগে বাঙালিদের একটি জাতীয় পোশাক প্রবর্তনে উদ্যোগী হন।
- মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের সব জাতীয়বাদী আন্দোলনেই "চরকা" এবং "খাদিবস্ত্র" হয়ে ওঠে আত্মনির্ভরতা ও জাতীয়তাবোধের প্রতীক।
পরাধীন ভারতে গান্ধীজিকে সারা ভারতের অবিসংবাদি নেতা হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলো তার পরিচ্ছদ এবং পরিধান রীতি। একখন্ড লজ্জা নিবারনের খাটো ধুতি আর নগ্ন বদনে ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচারে জর্জরিত, নিরন্ন,অর্ধনগ্ন দরিদ্র দেশবাসীর কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কাছের মানুষ, কাছের নেতা এবং তাদেরই একজন।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই ইতিহাসের ঘটনাক্রম এবং কার্যকারন সম্বন্ধকে যথার্থ ভাবে উপলব্ধি করতে গেলে আমরা কখনোই পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাসকে উপেক্ষা করতে পারি না।
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- ব্রাহ্মকা স্টাইল প্রচলন করেন - জ্ঞানদানন্দিনী দেবী।
- জ্ঞানদানন্দিনী দেবী পারসি মহিলাদের অনুকরনে শাড়ি পরবার যে রীতির প্রচলন করেন, তাই ব্রাহ্মকা স্টাইল নামে পরিচিত হয়।
- ভারতে বিত্তবান পারসিকরাই প্রথম পাশ্চাত্য পোশাক পরা শুরু করেন।
- জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ছিলেন - সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী।
- সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন - ভারতের প্রথম আই সি এস।
- স্বদেশী আন্দোলনের সময় ধুতি পায়জামা সহযোগে বাঙালিদের একটি জাতীয় পোশাক প্রবর্তনে উদ্যোগী হন জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
- বাঙালিদের আধুনিক পোশাক পরিচ্ছদের সূচনা হয়েছিলো - জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী থেকে।
- ঠাকুরবাড়ীর অন্দরমহল গ্রন্থটি রচনা করেন - চিত্রা দেব।
- বাঙালির বেশবাস লিখেছিলেন - মলয় রায়।
- ভারতের কোন প্রদেশের মেয়েরা শাড়ির পিছনে কাছা রাখেন - মহারাষ্ট্র।
কিছু বিশেষ পোশাকের নাম ও পরিচয়
পোশাক পরিচ্ছদ সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ
- কসটিউম হিস্ট্রি - ক্যামেলি বোনার্ডস।
- বাঙালির বেশবাস - মলয় রায় ।
- কালচারাল হিস্ট্রি অব মর্ডান ইন্ডিয়া - দিলীপ মেনন।
- ঠাকুরবাড়ীর অন্দরমহল - চিত্রা দেব।
- ফ্যাশন ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড প্রাইমারি সোর্সেস - পিটার ম্যাকলিন।
- ক্লথিং : আ গ্লোবাল হিস্ট্রি - রবার্টস রস।
- আর্ট অব ড্রেস ডিজাইনিং - মাইকেল ডেভিস।
- ফ্যাশন টেকনোলজি :টুডে অ্যান্ড টুমরো - নিরুপমা পুন্ডি।
- ক্লোদিং ম্যাটারস্ : ড্রেস অ্যান্ড আইডেন্টিটি ইন ইন্ডিয়া - নিরুপমা পুন্ডি।
- ক্লোথিং ম্যাটারস : ড্রেস অ্যান্ড আইডেন্টিটি ইন ইন্ডিয়া - এমা টারলো।
- স্ত্রী লোকের পরিচ্ছদ - সৌদামিনি খাস্তগির।
- জীবিত সমরম - সি কেশব।