পরিবেশের ইতিহাস

 সামাজিক ইতিহাস চর্চার একটি অন্যতম দিক হলো "পরিবেশের ইতিহাস" চর্চা।

পরিবেশের ইতিহাস
পরিবেশের ইতিহাস চর্চা 


পরিবেশের ইতিহাসের সংজ্ঞা

আমাদের চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানব সমাজের ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়ার ইতিহাসকেই সাধারন ভাবে "পরিবেশের ইতিহাস" বলা হয়।

অর্থাৎ সহজ করে বলতে গেলে আমরা প্রকৃতির সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করছি এবং প্রকৃতি পাল্টা আমাদের ব্যবহারের কি ফিডব্যাক দিচ্ছে, এটাই এই ইতিহাস চর্চার মূল আলোচ্য বিষয়।

পরিবেশের ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্য

পরিবেশের ইতিহাস চর্চার মূল উদ্দেশ্য ৩ টি -
  1. পরিবেশের পরিবর্তনশীল রূপের চর্চা বা পর্যালোচনা করা। অর্থাৎ মানুষের বিভিন্ন কাজকর্ম এবং পরিবেশের প্রতি তার ব্যবহার পরিবেশকে কিভাবে প্রভাবিত করছে, তা তুলে ধরা,
  2. প্রাকৃতিক পরিবেশ কিভাবে মানুষের জীবনযাত্রা তার সভ্যতাকে প্রভাবিত করে তা তুলে ধরা, এবং 
  3. পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। 

পরিবেশের ইতিহাসের সূত্রপাত

  • ১৯৪০ এবং ১৯৫০ দশকে আমেরিকাতেই প্রথম পরিবেশকে নিয়ে ইতিহাস চর্চা শুরু হয়।
  • পরবর্তীকালে পৃথিবীর নানা দেশের ইতিহাস চর্চায় পরিবেশ বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করতে শুরু করে। 
  • ১৯৭০ দশকে "পরিবেশের ইতিহাস" সামাজিক ইতিহাস চর্চার একটি অন্যতম শাখা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে।

পরিবেশের ইতিহাস চর্চার সঙ্গে যুক্ত ঐতিহাসিক

পরিবেশের ইতিহাস চর্চায় যেসব ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তাদের কয়েকজন হলেন -
  • আলফ্রেড ক্রসবি,
  • মাইকেল মান, 
  • রিচার্ড গ্রোভ।
ভারতে পরিবেশের ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন -
  • রামচন্দ্র গুহ,
  • মহেশ রঙ্গরাজন
  • মাধব গ্যাডগিল,
  • ইরফান হাবিব, 
  • শুভেন্দু গুপ্ত,
  • শমিত কর, 
  • সুধাংশু পাত্র।

পরিবেশের ইতিহাসের গুরুত্ব 

পরিবেশের ইতিহাস চর্চার একাধিক গুরুত্বের দিক রয়েছে - 
  1. পরিবেশের ইতিহাস চর্চা আমাদের পরিবেশের গুরুত্ব ও তার ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। পৃথিবীতে শুধু মানুষের একার বেঁচে থাকবার অধিকার নেই। অন্যান্য জীবজন্তু ও কীটপতঙ্গদেরও সমান অধিকার রয়েছে। কিন্তু দিনের পর দিন মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কার্যকলাপ প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণীদের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এর ফলে নষ্ট হয়েছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। পরিবেশের ইতিহাস চর্চা তাই পরিবেশ এবং অন্যান্য জীবজন্তুদের অধিকারগুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে তোলে। 
  2. বর্তমানে অবৈজ্ঞানিক শিল্পায়ন, নগরায়ন, কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিকের ব্যবহার, বাঁধ নির্মাণ, বৃক্ষচ্ছেদন, অরন্য নিধন, মোবাইল টাওয়ারের যত্রতত্র প্রতিস্থাপন প্রকৃতির জগতে ভারসাম্য নষ্ট করছে। বহু কীটপতঙ্গ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়ার বদল ঘটছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটে চলেছে। পরিবেশের ইতিহাস চর্চা আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট এবং জলবায়ু বদলের কার্যকারন সম্বন্ধ গুলিকে বুঝতে সাহায্য করে। 
  3. পরিবেশের সঙ্গে মানব সমাজ ও তার ইতিহাসের এক গভীর যোগ রয়েছে। পরিবেশের ইতিহাস চর্চা থেকে জানা যায়, একটি জাতীর জীবন যাত্রার ধরন, সংস্কৃতি এবং ধর্মাচার পরিবেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। রামচন্দ্র গুহ তার "অশান্ত অরন্যজীবন" গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক ভারতে অরন্যের ওপর ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রন কিভাবে আদিবাসী ও কৃষক সমাজকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। 
  4. মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা গুলি পরিবেশকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিলো, তাও পরিবেশের ইতিহাস চর্চা থেকে জানা যায়। ভারতে ইংরেজদের রেলপথ স্থাপন পরিবেশের ক্ষেত্রে কি প্রভাব ফেলেছিলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে কতখানি প্রভাবিত করেছিলো, ইত্যাদি দিক গুলি পরিবেশের ইতিহাস চর্চা থেকে জানা যায়। 
  5. পরিবেশের ইতিহাস আমাদের "সভ্যতা ও প্রকৃতির সহাবস্থানের" অপরিহার্যতার গুরুত্বের দিকটিকে তুলে ধরে। প্রকৃতিকে নিজের অনুকূলে এবং নিয়ন্ত্রনে রেখেই মানুষ সভ্যতার জন্ম দিয়েছিলো। কালক্রমে পৃথিবীর সব যুগেই দেখা গেছে, প্রকৃতির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রন ও দোহন যত বেড়েছে, সভ্যতাও তত চরম শিখরে উঠেছে। কিন্তু এই নির্মম দোহনে নষ্ট হয়েছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। দেখা গেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যা বারে বারেই সভ্যতাকে বিনাশের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসাবে হরপ্পা সভ্যতার পতনের কথা আমরা বলতে পারি। 
পরিবেশের ইতিহাস চর্চা তাই সভ্যতা ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার অনিবার্যতার গুরুত্বকে তুলে ধরে। এখানেই পরিবেশের ইতিহাস চর্চার সবথেকে বড়ো ঐতিহাসিক তাৎপর্য। 

পরিবেশের ইতিহাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য 

  • পরিবেশের ইতিহাস চর্চা প্রথম শুরু হয় - উত্তর আমেরিকাতে। 
  • বিশ্ব পরিবেশ দিবস বা ইকো ডে হল - ৫ জুন (১৯৭৪)।
  • ভারতের দুটি পরিবেশ আন্দোলন হল - নর্মাদা বাঁচাও আন্দোলন এবং চিপকো আন্দোলন।
  • মহারাষ্ট্রের নর্মাদা বাঁচাও আন্দোলনে (১৯৮৫) নেতৃত্ব দেন - মেধা পাটেকর। 
  • উত্তরাখন্ডের চিপকো আন্দোলনের (১৯৭৪) নেতৃত্ব দেন - সুন্দরলাল বহুগুনা। 
  • চিপকো কথার অর্থ - জড়িয়ে ধরা। 
  • আপিক্কো আন্দোলন হয় - কর্নাটকের ১৯৭৩ খ্রিঃ। 
  • পশুরক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন - মেনকা গান্ধী। 
  • দ্য সাইলেন্ট স্প্রিং গ্রন্থের বিষয়বস্তু - মশা, মাছি নিধনে কৃষিক্ষেত্রে ডিডিটির ব্যবহার কিভাবে পরিবেশের ক্ষতি করছে এবং প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছে, তাই রেচ্যাল কারসনের লেখা এই গ্রন্থে তুলে ধরা হয়। এই গ্রন্থটির প্রভাবে ডিডিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। 

পরিবেশের ইতিহাসর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ 

  1. দ্য সাইলেন্ট স্প্রিং - রেচ্যাল কারসন। 
  2. অশান্ত অরন্য জীবন - রামচন্দ্র গুহ। 
  3. গ্রিন ইম্পেরিয়্যালিজম - রিচার্ড গ্রোভ। 
  4. ইকোলজিক্যাল ইম্পেরিয়্যালিজম - আলফ্রেড ক্রসবি।
  5. ফেসিং দ্য ফরেস্ট - মহেশ রঙ্গরাজন। 
  6. হ্যান্টিং অ্যান্ড শুটিং - মহেশ রঙ্গরাজন। 
  7. শব্দের আর্শীবাদ,শব্দের অভিশাপ - আবিরলাল মুখোপাধ্যায়। 
  8. বিপন্ন পরিবেশ, বিপন্ন মানুষ - শমিত কর। 
  9. বিশ্ব পরিবেশ ও মানুষ - সুধাংশু পাত্র। 
  10. প্রাচীন ভারতে পরিবেশ চিন্তা - শুভেন্দু গুপ্ত। 

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post