সামাজিক ইতিহাস চর্চার একটি অন্যতম দিক হলো - "শহরের ইতিহাস চর্চা"।
শহরের ইতিহাস |
শহরের ইতিহাসের সংজ্ঞা
যে ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়ে কোন একটি শহরের পত্তন (প্রতিষ্ঠা), বিবর্তন (বিকাশ) এবং তার অবক্ষয়ের ইতিহাস নিয়ে অথবা এর মধ্যে কোন একটিকে নিয়ে আলোচনা করা হয়, তাকেই সাধারণত "শহরের ইতিহাস" বলা হয়।
শহরের ইতিহাসের বিষয়বস্তু
শহরের ইতিহাস চর্চার এক বহুমুখী দিক রয়েছে -
- এক সমৃদ্ধ গ্রামীন জনপদ কিভাবে ধীরে ধীরে একটি শহরে রূপান্তরিত হয়, সেই ইতিহাস শহরের ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়ে উঠে আসে।
- এই ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়েই কোন একটি শহরের বড়ো হয়ে ওঠার ইতিহাস, তার হারিয়ে যাওয়া বা অবক্ষয়ের নানা ইতিকথাও উঠে আসে।
- এছাড়া, একটি শহরের আর্থ - সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের উত্থান পতনের নানা কাহিনীও এই ইতিহাস চর্চায় ঐতিহাসিকরা তুলে ধরেন।
- এগুলি ছাড়াও, একটি শহরে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের উপস্থিতি, শহরে তাদের কাজকর্ম, শহর থেকে তাদের হারিয়ে যাওয়া, ইত্যাদি নানা দিক গুলিও এই ইতিহাস চর্চায় ঐতিহাসিকরা তুলে ধরছেন।
শহরের ইতিহাস চর্চার সূচনা
ইওরোপ
- ১৯৬০ এর দশক থেকেই ইওরোপে শহরের ইতিহাস রচনার প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়।
- তবে ১৯৭০ এর দশকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফেন থার্নস্টমের নেতৃত্বেই "শহরের ইতিহাস চর্চা" বিকাশ লাভ করে এবং ইতিহাস চর্চার একটি আলাদা শাখা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে।
- পরবর্তীকালে ইওরোপের বহু গবেষক শহরের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন।
- শহরের ইতিহাস চর্চার জন্য ইংল্যান্ডের লিসেস্টার ইউনিভার্সিটিতে স্থাপিত হয় - "শহরের ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র"। এখানে ঐতিহাসিক ব্যারি হেন্সের উদ্যোগে গবেষকরা ইওরোপীয় শহর গুলির ইতিহাস রচনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভারত
ভারতে শহরের ইতিহাস নিয়ে বহু গবেষক ইতিহাস রচনা করেছেন।
- কলকাতা শহরকে নিয়ে ইতিহাস চর্চা করেছেন - সৌমেন্দ্রনাথ মুখার্জি, পুর্নেন্দু পত্রী, রাধারমন মিত্র, শ্রীপন্থ, প্রদীপ সিনহা,
- মধ্য যুগের ভারতের শহর গুলি নিয়ে ইতিহাস চর্চা করেছেন - অনিরুদ্ধ রায়,
- লখনউ শহরকে নিয়ে ইতিহাস চর্চা করেছেন - রীনা ওন্ডেনবার্গ,
- মুম্বাইকে নিয়ে ইতিহাস লিখেছেন - জিম গর্ডন, ক্রিস্টিন ডবিন,
- দিল্লির ইতিহাস রচনা করেছেন - নরায়নী গুপ্ত।
শহরের ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব
শহরের ইতিহাস চর্চার একাধিক ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক রয়েছে। যেমন -
(১.) শহরের উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাস
গ্রামীন জনপদ থেকে ধীরে ধীরে শহরে পরিনত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বলা হয় "আরবানাইজেশন" বা নগরায়ন।
শহরের ইতিহাস গ্রামীন জনপদ থেকে শহরে রূপান্তরিত হওয়ার নগরায়নের প্রক্রিয়াটি নিয়ে আলোচনা করে। ফলে শহরের ইতিহাস চর্চা থেকে একটি শহরের উৎপত্তি ও বিকাশ লাভের ইতিহাস জানতে পারা যায়।
(২.) শহরের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা
প্রত্যেকটি শহরের গড়ে ওঠার ভিন্ন ভিন্ন কারন থাকে। সাধারনত -
- প্রশাসনিক কেন্দ্র,
- সামরিক ছাউনি বা দূর্গ,
- বানিজ্য কেন্দ্র,
- বহু সংখ্যক শিল্পী, কারিগর বা বনিকদের একত্রে বসবাস,
- বন্দর অঞ্চল,
- তীর্থস্থান,
- মেলা - প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে শহর বা নগর গড়ে ওঠে।
ফলে শহরের ইতিহাস চর্চায় শহরের বিকাশ লাভের মূল কারণটির পাশাপাশি কোন একটি শহরের প্রকৃতি বা চরিত্র সম্পর্কেও জানা যায়।
(৩.) সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের পরিচয়
শহরের ইতিহাস চর্চায় ঐতিহাসিকরা শহরের বাসিন্দাদের পরিচয়, তাদের জন বিন্যাস, অভিপ্রয়ান, এবং তাদের আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিবর্তনকে তুলে ধরেন।
ফলে এই আলোচনা থেকে একটি শহরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
(৪.) শহরের স্থাপত্যের পরিচয়
একটি শহরের বাড়ি ঘরের নির্মান শৈলী থেকে ঐ শহরের স্থাপত্য ভাষ্কর্যের পরিচয় এবং বৈদেশিক প্রভাবের দিক গুলি সম্পর্কেও জানা যায়। যেমন ইংরেজ আমলে কোলকাতার অধিকাংশ বাড়িঘর গথিক স্থাপত্য শৈলীর অনুকরনে গড়ে তোলা হয়েছিলো।
(৫.) অবলুপ্ত শহরের ইতিহাস
কালের নিয়মে যেমন বেশ কিছু শহরের উত্থান ঘটে তেমনি অনেক শহর অবলুপ্তও হয়ে পড়ে। শহরের ইতিহাস চর্চা থেকে অবলুপ্ত নানা শহরের অবক্ষয় বা পতনের ইতিহাস জানতে পারা যায়।
(৬.) শহর হলো সভ্যতার মূল কেন্দ্রস্থল
শহরের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্কের এক নিবিড় সংযোগ ও সম্পর্ক থাকে। যেকোন সময়কালে শহর গুলিই সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
আধুনিকতা ও উন্নয়নের সুফলের প্রথম ছোঁয়া পায় শহরগুলি। পরে তা ধীরে ধীরে গ্রামীন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
ফলে যেকোন সভ্যতার মূল কেন্দ্রবিন্দু বা সেন্টার হলো তার শহর। আর একারনেই শহরকে বাদ দিয়ে কখনই সভ্যতার বিবর্তনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের অন্বেষণ করা যায় না। শহরের ইতিহাস চর্চার সবথেকে বড়ো ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখানেই ।
শহরের ইতিহাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- ফুটবলের মক্কা বলা হয় - কলকাতা শহরকে।
- সংস্কৃতি নগরি বলে পরিচিত - কলকাতা।
- স্বপ্ন নগরি বলা হয় - মুম্বাই কে।
- বানিজ্য নগরী বলা হয় - মুম্বাই কে।
- গোলাপী শহর বলা হয় - জয়পুরকে।
- আধুনিক শহর গুলিকে বলা হয় - ম্যাট্রোপলিস।
- ভারতের প্রথম নগরায়ন হয় - হরপ্পা সভ্যতায়।
- ভারতে দ্বিতীয় নগরায়ন ঘটে - খ্রিঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকে।
- উনিশ শতকে ভারতে বিকাশ লাভ করা শহর - কলকাতা, বোম্বে, মাদ্রাজ, লখনউ, লাহোর।
- উনিশ শতকে বিশ্বের বৃহত্তম শহর ছিলো - লন্ডন।
- উনিশ শতকে ভারতের বৃহত্তম শহর ছিলো - বোম্বাই।
- প্রাচীন ভারতের দুটি শহর - হরপ্পা, পাটলিপুত্র, চম্পা।
- ধর্ম বা তীর্থস্থান থেকে গড়ে ওঠা দুটি নগর হল - রোম, বারানসী।
- রাজধানী বা প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠা দুটি নগর হলো - কলকাতা, দিল্লি।
- মধ্য যুগের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শহর ছিলো - দিল্লি, আগ্রা, লাহোর, মূলতান, জয়পুর, আমেদাবাদ, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, সুরাট, হায়দরাবাদ, জৌনপুর।
- মধ্যযুগের শহর নিয়ে ইতিহাস চর্চা করেছেন - অনিরুদ্ধ রায়।
- ইংরেজ আমলে গড়ে ওঠা শহর - কলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বাই, দার্জিলিং, সিমলা, পন্ডিচেরী, চন্দননগর।
- পরিকল্পিত নগরী কাকে বলে - কৃত্রিম ভাবে পরিকল্পনা করে যে সব নগর গড়ে তোলা হয়, তাদেরই পরিকল্পিত নগরী বলা হয়।
- পরিকল্পিত নগরীর উদাহরণ - চন্ডীগড়, দুর্গাপুর, কল্যানী, নয়ডা, জামসেদপুর।
- শহরের ইতিহাস চর্চা করেছেন এমন কিছু ঐতিহাসিক হলেন - অনিরুদ্ধ রায়, সৌমিত্র শ্রীমানী, বিজয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন রায়, সুভাষ বিশ্বাস, আব্দুল মোমিন চৌধুরী।
শহরের ইতিহাস সম্পর্কিত গ্রন্থ
- কলিকাতা দর্পন - রাধারমন মিত্র।
- কলিকাতা কলিকাতা - সৌমিত্র শ্রীমানী।
- মধ্যযুগের নগর - অনিরুদ্ধ রায়।
- প্রাচীন নগরী সোনারগাঁও - শামসুদ্দোহা চৌধুরী।
- শহর বহরমপুর - বিজয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
- ঢাকা : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী - মুনতাসির মামুদ।
- নদীয়া জেলার নগরায়ন প্রক্রিয়া - সুভাষ বিশ্বাস।